২০ মার্চ, ১২৫-এ লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে এ্যাংলিকান বিখ্যাত যাজক ও ক্রিস্টান সোশ্যাল ইউনিয়নের সদস্য এবং মেয়েদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পক্ষের প্রবক্তা ফ্রেডরিক লুইস ডোনাল্ডসনের (১৮৬০—১৯৫৩) দেওয়া একটি উপদেশ হল:
সাতটি সামাজিক পাপ হল:
কাজ ছাড়া সম্পদ।
বিবেক ছাড়া আনন্দ।
চরিত্রহীন জ্ঞান।
নৈতিকতা ছাড়া বাণিজ্য।
মানবতা ছাড়া বিজ্ঞান।
ত্যাগ ছাড়া পূজা।
নীতিহীন রাজনীতি
এই সাতটি সামাজিক পাপ থেকে বাঁচার জন্য সভ্যতাকে সর্বদা সচেতন থাকা জরুরি। মানবসভ্যতা মানবিক সমুদ্রের স্বরূপ। তাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি মানুষকেই মানবিক হতে হয়। তাই প্রতিটি কর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানবিক হওয়া দরকার। বিশ্ববিখ্যাত রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয় বলেছেন: ‘জীবনের একমাত্র অর্থ মানবতার সেবা করা।’ আমরা জানি এই মানবতার মৃত্যু হয় না। মানুষ মরে যায়, কিন্তু মানব বেঁচে থাকে। বিখ্যাত লেবানিজ-আমেরিকান কবি,লেখক শিল্পী কাহলিল জিবরান(১৮৮৩-১৯৩১) তাঁর কবিতার এক অংশে উল্লেখ করেছেন:
“Humanity is the spirit of the Supreme Being on earth, and that humanity is standing amidst ruins, hiding its nakedness behind tattered rags, shedding tears upon hollow cheeks, and calling for its children with pitiful voice.
But the children are busy singing their clan’s anthem; they are busy sharpening the swords and cannot hear the cry of their mothers.” (A Poets Voice XV)
অর্থাৎ মানবতা হল পৃথিবীতে পরম সত্তার আত্মা, এবং সেই মানবতা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তার নগ্নতাকে ছেঁড়া ন্যাকড়ার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে, ফাঁপা গালে অশ্রু ঝরছে এবং করুণ কণ্ঠে তার সন্তানদের ডাকছে।
কিন্তু শিশুরা তাদের বংশের সঙ্গীত গাইতে ব্যস্ত; তারা তরবারি ধারালো করতে ব্যস্ত এবং তাদের মায়ের কান্না শুনতে পায় না।
একজন কবি তখনই তিনি কবি, যখন তিনি মানুষ থেকে মানব হয়ে উঠতে পারেন। অর্থাৎ তাঁর সাধনা মানবের সাধনা। গান্ধীজী বলেছেন: ‘মানবতার মাহাত্ম্য মানুষ হওয়ার মধ্যে নয়, মানবিক হওয়ার মধ্যে।’ বিখ্যাত আমেরিকান কবি ল্যাংস্টন হিউজের (১৯০১-১৯৬৭) একটি মানবিক কবিতা এখানে উল্লেখযোগ্য:
I Dream A World
I dream a world where man
No other man will scorn,
Where love will bless the earth
And peace its paths adorn
I dream a world where all
Will know sweet freedom’s way,
Where greed no longer saps the soul
Nor avarice blights our day.
A world I dream where black or white,
Whatever race you be,
Will share the bounties of the earth
And every man is free,
Where wretchedness will hang its head
And joy, like a pearl,
Attends the needs of all mankind-
Of such I dream, my world!
আমি একটি বিশ্বের স্বপ্ন
আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে মানুষকে
অন্যকোনো মানুষ অপমান করবে না,
যেখানে ভালবাসা পৃথিবীকে আশীর্বাদ করবে
এবং শান্তি তার পথে শোভা পাবে।
আমি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাই
জানবে মিষ্টি মুক্তির পথ,
যেখানে লোভ আর আত্মাকে ক্ষয় করবে না
কিংবা লোভ আমাদের দিনকে নষ্ট করবে না।
আমি স্বপ্নে এমন একটি পৃথিবী দেখি যেখানে কালো বা সাদা,
আপনি যে জাতিরই হোন না কেন,
পৃথিবীর অনুগ্রহ ভাগ করে নেবেন
এবং প্রতিটি মানুষ স্বাধীন,
যেখানে জঘন্যতার মাথা ঝুলবে
এবং আনন্দ, একটি মুক্তার মতো,
সমস্ত মানবজাতির চাহিদা পূরণ করবে—
এমনই স্বপ্ন আমার, আমার পৃথিবী!
মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেই প্রতিটি কবির যাত্রা শুরু হয়। কবিতায় আত্মগত শূন্যতা বা অন্তরায়গুলি লেখাই কবির একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ভালবাসার পৃথিবী রচনা এবং প্রেমের স্বপ্ন বুননে জীবন নির্মাণের ব্যাকুলতা নিয়েই তাঁর কবিতা রচনা। মানবিকতার অবক্ষয় এবং অবমাননায় তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধেই কবিতায় আরেক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যে যুদ্ধের তরবারি শুধু শব্দ। যে যুদ্ধের রসদ শুধু প্রেম। যে যুদ্ধে শুধু হৃদয়েরই কারবার। কবিতার আদি যুগ থেকেই এই মানবিক স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার জন্যই কবির উদ্যোগ। ঋষি বাল্মীকির মুখে উচ্চারিত প্রথম শ্লোক যে কবিতার জন্ম দিয়েছিল, তা মানবিক চেতনারই প্রকাশ। হৃদয়ে যে স্নেহ-প্রেমের উদ্রেক হয়েছিল, তা থেকেই কারুণ্য রস স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কবিতায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী অভয়ামঙ্গল কাব্যে মানবিক বোধের দ্বারাই চালিত হয়েছিলেন। বর্ধমানের দামুন্যায় ডিহিদার মাহমুদ শরিফের অত্যাচারে মানবিক সংকট দেখা দিলে তিনি দেশ থেকে উৎখাত হয়েছিলেন। নিজের দৈন্যদশা উল্লেখ করেই যুগসঙ্কটের পরিচয় দিয়েছিলেন:
“তৈল ও বিনা কৈলু স্নান করিলু উদক পান
শিশু কান্দে ওদনের তরে।”
ওদনের অভাব মানবিক সংকটের পরিচয় দেয়। একদিকে শাসকের অত্যাচার এবং শোষণ, অন্যদিকে প্রজাদের অভাব, অস্থির জীবনযাত্রা মানবসভ্যতার ইতিহাসকেই পাল্টে দিয়েছিল। মধ্যযুগের শেষলগ্নে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও মানবসঙ্কটের মূলে অন্নের অভাবই বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। তাই ঈশ্বরী পাটনীর মুখেও বর প্রার্থনায় যুগের কণ্ঠস্বরই শোনা গিয়েছিল:
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
দুধে-ভাতে থাকা তখনই সম্ভব যখন মানবিক যুগ বিরাজ করবে। কেউ কারো অন্ন কেড়ে খাবে না। যখন সমাজে মূল্যবোধ থাকবে। যখন মানুষ পরস্পরকে ভালবাসতে পারবে। যখন প্রত্যেকেই মানবিকতাবাদের সৈনিক হয়ে উঠতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মানবিক পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাই ‘চিত্রা’ কাব্যে বলতে চেয়েছিলেন:
“ওরে তুই ওঠ্ আজি;
আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল? কোন্ অন্ধকারামাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায়?স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া ; বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার ; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে। ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে — ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী ; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার —
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি,
নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে —
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা — এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা —”
এখানেও সেই গর্জন শোনা গেছে। অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবিতায় মানবিক গর্জন ফিরে এসেছে। বাস্তব পৃথিবীর এবং মানবসভ্যতার সঙ্কটকে কবি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। যে সভ্যতায় মানুষের জীবনযাত্রা সচ্ছল নয়, অবারিত নয়, সংকুচিত নিষ্পেষিত কলুষিত এবং খণ্ডিত—সেই সভ্যতার স্বপ্ন একজন কবির হতে পারে না। তাই শুধু এই কবিতা নয়, সমগ্র সৃষ্টিতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবিক চেতনার তীব্র ঝাঁকুনি প্রয়োগ করেছেন। কালান্তরে ঘোষণা করেছেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তাই কবির বিশ্বাস মানবিক পৃথিবীর এই স্বপ্নযাত্রায় শব্দ-অভিঘাত অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। যে মানবিক পৃথিবীতে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মানব হয়ে বাঁচতে চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন:
“সেই ধন্য নরকুলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্বজন,—
কিন্তু কোন গুণ আছে,
যাচিব ও যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্মদে!
তবে যদি দয়া করো,
ভুল দোষ, গুণ ধরো,
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!—
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কি বসন্ত, কি শরদে!”
কবি যখন মানবিক পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠেন, তখন মানবিক পৃথিবীতেই তিনি মৃত্যুর পরেও জাগ্রত থাকেন। মানুষের কাছে পূজিত হন। তাঁর সৃষ্টি সকলের কাছেই তখন স্মরণীয় হয়ে ওঠে। সুতরাং তাঁর সাধনা মানবিক সাধনারই অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন। তাই মুক্তকণ্ঠে তিনিও ঘোষণা করেছিলেন:
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাহি।”
এখানে উল্লেখ্য সুন্দর ‘ভুবন কথাটি’ human world যা beauty is truth, truth beauty এরই নামান্তর। মানবিক সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় আমাদের হৃদয়ের অন্তর্গত চেতনায় ও কর্মে শুভবোধের অবিমিশ্র প্রবাহ যা সবরকম ধ্বংসাত্মক কার্যকারণ থেকে আমাদের প্রাণশস্য ও চৈতন্যশস্যকে রক্ষা করবে। কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের অস্থির সময়ের অবক্ষয়ী ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি হতে দেখেছিলেন।১৯৪৬-৪৭-এর দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু জীবনযাত্রা, এবং মনুষ্যেতর জীবনের মিছিল তাঁকেও বিপন্ন বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তখনো কবিতায় জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিক সভ্যতার প্রত্যাশাকে জারিত করেছিলেন। প্রবল লোভ এবং হিংসার পৃথিবী থেকে অসহায় মানুষের মৃত্যু তাঁকেও আতঙ্কিত করেছিল। মানবিক জাগরণের প্রত্যয়কেই কাব্যিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন:
“যদি ডাকি রক্তের নদী থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি’,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ‘পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে-রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন,শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার,শ্যামবাজারের,গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির—'”
যে রক্তের নদী বয়ে গেছে, রক্তের নদী থেকে যাতনার আর্তনাদ উঠেছে, মানুষের যে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসে সভ্যতা ভরে গেছে তা কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তা যেমন ইতিহাসের কলঙ্ক, তেমনি সভ্যতারও কলঙ্কিত অধ্যায়। মানবিকসভ্যতা কখনোই মানুষের মৃত্যু সমর্থন করে না। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ কখনোই মানবিকসভ্যতায় স্থান পায় না। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই নৈবেদ্য কাব্যে এ কথা বলেছেন:
“শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী
ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে
ঘটেছে সংগ্রাম — প্রলয়মন্থনক্ষোভে
ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি
পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি
জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।
কবিদল চীৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি
শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।”
এই রক্তপাত সভ্যতায় বারবার ঘটেছে। ভদ্রবেশী বর্বরতা বারবার দেখা দিয়েছে। মানুষকে মানবতার শিক্ষা দিতে পারেনি। বরং খণ্ডিত, বিভাজিত সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে। স্বার্থে স্বার্থে প্রবল সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জেগে উঠেছে। আর সেইসব সাম্রাজ্যবাদী রাজাদের গুণগান গেয়েছেন সভাকবিগণ। শ্মশানকুকুরদের মতোই তারা। প্রবল ঘৃণায় কবি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যে চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন:
“শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
কোথায় সেই মানুষ পরিচয়? মানুষকে যখন মানুষ ভাবা হয় না, ধর্মের নামে, জাতের নামে, সম্প্রদায়ের নামে নাম ধরে ডাকা হয় তখন তো কবিরাও চুপ করে থাকতে পারেন না। বারবার মানবিক সভ্যতার পক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন:
“জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষজাতি।
একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবিশশী মোদের সাথী।।”
মানুষের ভাগ কেন হবে? এ প্রশ্ন প্রায় সমস্ত কবিরই। পৃথিবীতে মাত্র দুটি জাতি বাস করে: নারী ও পুরুষ জাতি। প্রত্যেকটা মানুষের শরীরে বয়ে চলেছে একই রক্ত। একই অনুভূতি। একই জন্ম-মৃত্যুর পদ্ধতিও। তাহলে কেন মানুষকে আলাদা করে দেখা হয়? কারো গায়ের রং কালো, কেউ ফর্সা। কেউ বেটে, কেউ লম্বা। কিন্তু সবাই মানুষ ব্রাহ্মণ-শূদ্রে কোনো তফাত নেই। কবি নজরুল ঠাকুর পূজারী, মৌলভী, পুরোহিতের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হলেন। মানুষকে না ভালবেসে আল্লাহ বা ভগবানকে ভালোবাসা যায় না। মন্দির-মসজিদ কখনোই দেবতার স্থান হতে পারে না। একটি ক্ষুদ্র হৃদয়ের থেকে বড় কাবা-মন্দির কোথাও নাই। যাঁরা দেবতা বা আমাদের পূজনীয় তাঁরা এই মানুষের রূপ ধরেই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ গরুর রাখাল, কেউ মেষের রাখাল। অতএব মানুষদের ঘৃণা করা নয়। ধর্মশাস্ত্র পাঠ করলেই ঈশ্বরকে বা খোদাকে সন্তুষ্ট করা যায় না। ‘মানুষ’ কবিতায় এদের বিরুদ্ধেই নজরুলের ঘোষণা:
“তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয় !
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !–মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে বাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান , জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেস না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম
আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদি ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ–দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজানালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ-জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখেনি–হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!
ও কে? চন্ডাল? চমকাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চণ্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে কর হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
চাষা বলে কর ঘৃণা!
দেখো চাষা রুপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারও ধরিল হাল
তারাই আনিল অমর বাণী–যা আছে র’বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে
দ্বার দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলৈ।”
এক ভিখারির মধ্যেও ঈশ্বরের দর্শন পাওয়া যায়। ‘আমি’ কে, কোথা থেকে এসেছি তা কি কেউ বলতে পারি? আমরা নিজেকেই নিজেরা চিনি না। ঈশ্বরকে চিনব কী করে? সমস্ত কবিতাতেই নজরুল মানুষের জয় ঘোষণা করেছেন। জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবমহিমার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কেননা মানবতাবাদ ছাড়া সভ্যতাকে রক্ষা করা যাবে না। হিংসাকেও জয় করা যাবে না। জাতের নামে বজ্জাতি মানুষের কাজ হতে পারে না। আমাদের পরিচয় আমরা মানুষ। এই আমাদের শেষ কথা। প্রেমেন্দ্র মিত্র মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে মানুষের কর্মস্রোতে নিজেকে মিশিয়ে দিলেন। বিলীন করে দিলেন শহুরে আভিজাত্য এবং শিক্ষার ভণ্ডামিকেও। ফেরারী ফৌজ হয়ে কখনো হলেন বন্দর শ্রমিক। মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে ফেললেন মাল বয়ে বয়ে। জগতের মানুষকে ‘ভাই’ বলে আপন করতে চাইলেন। পাওদ্ল হয়ে পথে নামলেন। ‘কবি’ কবিতায় লিখলেন:
“আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর
ছুতোরের মুটে মজুরের,
—-আমি কবি যত ইতরের!
আমি কবি ভাই কর্মের আর ঘর্মের;
বিলাস- বিবশ মর্মের যত স্বপ্নের তরে,ভাই,
সময় যে হয় নাই!
মাটি মাগে ভাই হলের আঘাত
সাগর মাগিছে হাল,
পাতালপুরীর বন্দিনী ধাতু,
মানুষের লাগি কাঁদিয়া কাটায় কাল।
দুরন্ত নদী সেতু বন্ধনে বাঁধা যে পড়িতে চায়,
নেহারি আলসে নিখিল মাধুরী—-
সময় নাহি যে হায়!
মাটির বাসনা পুরাতে ঘুরাই
কুম্ভকারের চাকা,
আকাশের ডাকে গড়ি আর মেলি
দুঃসাহসের পাখা,
অভ্রংলিহ মিনার -দম্ভ তুলি,
ধরণীর গূঢ় আশায় দেখাই উদ্ধত অঙ্গুলি!
আমি কবি ভাই কামারের আর কাঁসারির
আর ছুতোরের, মুটে মজুরের,
—-আমি কবি যত ইতরের।”
কোনো কর্মই ছোট নয়। কোনো সম্প্রদায়ই নির্দিষ্ট কোনো কর্ম করবে কেন? তাই কবি যেকোনো কর্ম করতেই প্রস্তুত হলেন। মানবিক পৃথিবীতে সবাই মানুষ। কামার কুমোর ছুতোর কাঁসারি শ্রমিক আবার ভদ্র-ইতরও সবাই মানুষ। কারো সঙ্গে কারোর তফাত নেই। দুর্ভিক্ষে সবাই পীড়িত হয়। মহামারীতে সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পরাধীনতায় শোষিত হয়। আবার বসন্তে সবাই রঙিন হয়। তাহলে বিভেদ কেন?
কবিদের কাব্যচর্চার মূল উদ্দেশ্যই হল মানবিক পৃথিবীর সন্ধান। মানুষকে ভালোবাসার বাণী ঘোষণা করা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা অমানবিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেমন বিদ্রোহ করেন, তেমনি সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধেও তাঁদের বিদ্রোহ। মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমাজে যেমন সাম্য দরকার, তেমনি প্রতিটি মানুষের ন্যায্য অধিকার রক্ষাও। স্বাভাবিকভাবেই কবিরা পুঁজিবাদের এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সর্বদা কথা বলেছেন। এই জন্য কখনো কখনো কবিদের জেলও খাটতে হয়েছে। এমনকী মৃত্যুদণ্ডও পেতে হয়েছে।মানবতাবাদের পক্ষে বিদ্রোহী ও বিপ্লবী কবিতা লেখার দায়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে কবি বেঞ্জামিন মোলায়েস (Benjamin Moloise)কে ১৯৮২ সালে আটক করে এবং ১৮ অক্টোবর ১৯৮৫ সালে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়েছে স্বৈরচার বোথা সরকার। ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহন করেন বেঞ্জামিন মোলয়েস। তিনি একটি ফ্যাক্টরীতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর অনেক বিদ্রাহী ও বিপ্লবী কবিতার মধ্যে peace বা শান্তি নিয়ে লেখা কবিতার প্রথম স্তবকটি ছিল:
“শান্তি তুমি কোথায়?
তোমাকে খুঁজি ল্যাটিন আফ্রিকা–আমেরিকায়।
তুমি কত দূর?
ভীষণ প্রয়োজন তোমাকে এসময়ে আফ্রিকায়!”
বেঞ্জামিনের ফাঁসির রায় ঘোষণা এবং ফাঁসির দড়িতে ঝুলানোর আগে তাঁর মা দেখা করেছিল বেঞ্জামিনের সঙ্গে এবং তাঁর চোখে হাত রেখে বলেছিল:”Don’t cry on my son. The world Human people crying for you.Don’t cry.” তাঁর মৃত্যুতে কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘আফ্রিকার প্রেমের কবিতা’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন:
“তোমার কবিতা আমরা একটিও পড়িনি আগে,
কিন্তু যেদিন
ওরা তোমাকে রাতের অন্ধকারে
ফাঁসিতে ঝোলালো-
তার পরদিন
সারা পৃথিবীর ভোরের কাগজে
ছাপা হলো তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
আমরা জানলাম,
কী গভীরভাবেই না তুমি
ভালোবেসেছিলে তোমার প্রিয়তম মাতৃভূমিকে।
আমরা জানলাম,কালো আফ্রিকার
শ্বেত-শত্রুদের বিরুদ্ধে কী ঘৃণাই না ছিল
তোমার বুক জুড়ে, শোণিতে, হৃদয়ে।
আমরা জানলাম
শুধু শব্দ দিয়ে নয় ,শুধু ছন্দ দিয়ে নয়
কখনো কখনো মৃত্যু দিয়েও লিখা হয় কবিতা।
তুমি কবি, বেঞ্জামিন মোলয়েস,
তুমি মৃত্যু দিয়ে
কবিতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছো তার মৃত্যুদশা থেকে।
বেঞ্জামিন মোলয়েস, তুমি এখন সারা-বিশ্বের কবি,
তোমার মা এখন পৃথিবীর তাবৎ কবিদের জননী।
তোমার জন্মভূমি,দক্ষিণ আফ্রিকা এখন পৃথিবীর
তাবৎ কবিদের শৃংখলিত মাতৃভূমি।
কারাগারের ফটকে নেলসন ম্যান্ডেলার পত্নী
যখন তোমার শোকাতুরা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন,
তখন,মোলয়েস,তখন তোমার মায়ের পুত্রশোকদগ্ধ
বুকের উদ্দেশে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ট কবিতাগুলি ছুটে গিয়েছিল;
এবং মাথা নত করে ফিরে এসেছিল
লজ্জায়, তোমার সাহসের যোগ্য হয়ে উঠবে বলে।
তোমার ভালবাসার যোগ্য হয়ে উঠবে বলে।
আমার সমস্ত কবিতাগুলি তোমার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে
আজ সারাদিন মাথা নত করে নীরবতা পালন করেছে।
মধ্যরাতেও আমাকে কলম হাতে জাগিয়ে রেখেছো তুমি।”
তখন মানবিকতা বলতে স্বাধীনতা, দেশপ্রেম এবং নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। মানবিকতা বৃহত্তর অর্থে তখন কবিতা হয়ে ওঠে। নির্মলেন্দু গুণ সেই কথাই লিখলেন তাঁর কবিতাটিতে। স্বাধীনতা ছাড়া মানবিকতাকে কে লালন করবে? পরাধীন দেশ তো অমানবিক স্বৈরাচারীর দেশ। এই বৃহত্তর মানবিকতাকে অনুধাবন করেই শামসুর রাহমান ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় লিখেছিলেন:
“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।”
কবিদের এই স্বাধীনতার লড়াই আজও থেমে নেই। সমাজে কুসংস্কার এবং ধর্মের ভ্রান্তিজাল যেভাবে বিস্তৃত হয়ে চলেছে তাতে সন্ত্রাসী হানাও বাড়ছে। ধর্মের নামে চলছে খুনোখুনি। সুশাসনের নামে চলছে জেলবন্দিকরণ। উগ্র মৌলবাদী শক্তি বারবার মাথাচাড়া দিচ্ছে। ভেঙে দিচ্ছে মানবশৃংখল। মানুষের মনে পারস্পরিক ঈর্ষা ও সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে। ধর্মের মধ্যেও রাজনীতিকরণ ঘটছে। ‘অন্ধ যে জন মারে আর শুধু মরে’ এর থেকে বাঁচার পথ কোথায়? মানুষকে দলদাসে পরিণত করা হচ্ছে। শিকারি কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিপরীত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রতি। তাহলে কি মানবিক স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে? কবি শঙ্খ ঘোষ বিবেকের কণ্ঠস্বর নিয়ে এলেন কবিতায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামির প্রতিবাদ জানালেন। খুন রাহাজানি ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ একের পর এক নৈরাজ্য ঘটতে দেখলেন চোখের সামনে। প্রজাদের জীবন কীভাবে নরক হয়ে উঠলো সে কথা বলতেও দ্বিধা করলেন না। ‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতায় লিখলেন:
“আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা ।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা ।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।”
শাসকের যখন এটাই চরিত্র সকলের জীবন নরক করে দেওয়ার অভিসন্ধি—তখন মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমাদের কাছে অধরাই থেকে যায়। নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অনৈতিক বলে কিছুই থাকে না। ভণ্ডামিও তখন সাধুতায় রূপান্তরিত হয়। একের পর এক অন্যায়ের বিচার হয় না। ধর্ষকেরা, দাঙ্গাকারীরা, হত্যাকারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে জীবন কাটাতে থাকে। সেই নরকের বসন্ত নিয়ে আজও কবিতা লেখা হয়। যে শঙ্খ ঘোষ ‘বাবরের প্রার্থনা’য় পিতৃত্বের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-শান্তি কামনা করেছিলেন। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ বেয়ে ‘ভাসন্ত শবের পাখি সূর্যের কুহরে উড়ে যায়’ বলে শিকড়ে গরল ঢেলে শিখরে জ্বালা জাগাতে চেয়েছিলেন—সেই কবিও রাষ্ট্রযন্ত্রের মানবহন্তারক সভ্যতায় দ্রোণের ভূমিকায় দাঁড়ালেন। মানবিক সৈনিক হিসেবেই তাঁর ভূমিকা জানান দিলেন। নরক হয়ে যাওয়া পৃথিবী যুগে যুগে কবিরা বারবার উপলব্ধি করেন। আর্থার রিম্বাউদও বলেছিলেন:“I believe I am in Hell, therefore I am.”- (Arthur Rimbaud)
অর্থাৎ আমি বিশ্বাস করি আমি জাহান্নামে আছি, তাই আমি আছি। এই জাহান্নাম, এই রক্তভূমি, এই বধ্যভূমি, এই দাহভূমি সভ্যতাকে শ্মশান করে দিয়েছে। তাই সেই সময়ের প্রত্যেক কবিই মানবিক চেতনায় কবিতায় বিবেকের ঘোষণা দিয়েছেন। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি জয় গোস্বামীও ‘দগ্ধ’ কাব্যে লিখলেন:
“আমার লেখার ঘরে মেঝেভর্তি করে একজনের উপর একজন
ওরা স্তূপীকৃত হয়ে আছে…
ওদের দাফন করব এখন কোথায়?“
রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে পুড়িয়ে মারা গৃহবন্দি লাশের স্তূপ দেখে কবিও শোকে কাতর হয়েছেন। চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠেছে লেখার টেবিলেও। শব্দ-অক্ষর জুড়ে মানুষ পোড়ার গন্ধ ছেয়ে ফেলেছে। দেখা দিয়েছে অনিশ্চিত জীবনযাপনের উদ্বেগ। কী করে এই সভ্যতা রক্ষা হবে? কবি লাশের নাম ও বয়স ধরে ধরে উল্লেখ করলেন। এমনকী কম বয়সী বাচ্চা মেয়েদের পুড়িয়ে মারাকেও দেখলেন স্বপ্ন-মুকুলের ঝরে যাওয়া পাপড়ির মতো। ক্রোধে দুঃখে উন্মত্ত হয়ে প্রশ্ন তুললেন:
“এই ঘটনার পর কবিতা বলে কিছু থাকে নাকি?
ঘৃণায় লজ্জায় শোকে ক্রোধে”
কবিতা লেখার খাতা ছিঁড়ে ফেলতে থাকি নদিয়ার হাঁসখালির ধর্ষিতা মেয়েটির লাশ পুড়িয়ে দেওয়াকেও কবি মানবতাবাদেরই দাহ মনে করেন। সেখানেও বিচারহীন বিবেকহীন স্বৈরাচারী শাসনের প্রভাব লক্ষ করেন। তাই সেখানেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।
যদিও বহু আগেই ‘অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা’ বলেই কবি মেরুদণ্ড টানটান করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ‘মা নিষাদ’ নামক দীর্ঘ কবিতায়। সেখানেই উল্লেখ করেছেন:
“অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা
আমাদের পায়ে রাত্রিচক্র ঘোরে
আমরা এসেছি মহাভারতের পর
আমরা এসেছি দেশকাল পার করে”
বারবার যুদ্ধ এসেছে, মানবিক পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, কিন্তু তবুও মানুষ মানব হবার সাধনায় অগ্রসর হয়েছে। কবিতা সেই মানবিক সৌন্দর্যেরই প্রজ্ঞা বহন করে নিয়ে চলেছে। তাই এই মননযুদ্ধ, এই শব্দযুদ্ধ, এই অক্ষর সৈনিকের পরন্তপ লড়াই চলে আসছে। এর কখনোই শেষ হবে না। নবারুণ ভট্টাচার্য আটটি রক্তাক্ত হত্যার লাশ দেখে গর্জে উঠে ছিলেন। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতা লিখেছিলেন:
“যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি—
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি”
কিন্তু পরক্ষণেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন:
“কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়”
কবিতা তখন হাতিয়ার যুদ্ধ ঘোষণার, যুদ্ধে জয়লাভেরও। মৃত্যুকে ভয় পাওয়া নয়, মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোই কবির কাজ। তাই তিনি কবিতার শেষটিতে উল্লেখ করলেন:
“প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দূরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি—
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।”
বিপ্লবের উৎসবের দিন কবিরা জানতে চেয়েছেন বারবার। ভিয়েতনামের যুদ্ধে কবিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কবিতাকে রণসংগীত করে। মানবিকসভ্যতা নির্মাণ করা এবং রক্ষা করা কবিদেরই দায়িত্ব। জীবমন্ত্রের সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি কবিতার ঝংকার। সুবোধ সরকারও একের পরে এক কবিতায় সেই উচ্চারণই করেছেন। তাঁর ‘মণিপুরের মা’ ধর্ষিতা নারীর প্রতিবাদে নগ্ন হয়ে পথে নামে মায়ের দল। অসম রাইফেলস্-এর সৈনিকরা ইজ্জত লুট করেছে সেই ইজ্জত সকল সৈনিকের মায়েরও আছে। তাই মায়েদের এই প্রতিবাদ ছিল ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। মানবিক চেতনা জাগ্রত করার প্রতিবাদ। কবিতায় লিখলেন:
“নগ্ন উঠে দাঁড়ালাে আমার মণিপুরের মা
এই মায়ের দু’চোখ থেকে চোখ পেয়েছি
আশিরনখ ভাষা পেয়েছি, পেয়েছি সারেগামা
নগ্ন উঠে দাঁড়ালাে আমার মণিপুরের মা।
যা খুশি তাই করতে পারে আর্মি আর
পুলিশ, পথে কার্ফ্যু, জ্বলে চারমিনার
কারও কিছু বলার নেই, বলার কথা না
নগ্ন উঠে দাঁড়ালাে আমার মণিপুরের মা।
আর্মি জিপ চলে গগনতলে
আর্মি জিপ ‘সারে জাঁহাসে’ বলে
আর্মি জিপে মেয়েটি আছড়ায়
আর্মি জিপে বােতাম খােলা চলে।
ও মেয়ে যদি ফিরেও আসে ঘরে
ও মেয়ে যদি গগনতলে মরে
পুলিশ মুছে দিয়েছে তার নাম
বাড়ি কোথায়? ইম্ফলের বাইরে কোনও গ্রাম!
এ সব ঘটে রােজ
কোথায় কোন তরুণী পড়ে আছে।
কোথায় তার অন্য বােন নিখোঁজ
শুধু তাদের চুনুরি ঝােলে গাছে
কিন্তু আজ জুলাই মাসে হারালাে বিপদসীমা।
উঠে দাঁড়ান মণিপুরের মা
উঠে দাড়ান নগ্ন হয়ে স্তন্যদায়িনীরা
পৃথিবী দেখ্, মায়ের বুকে ক’খানা উপশিরা।
কেমন লাগে নগ্ন হলে তাের নিজের মা?”
প্রতিবাদ হলেও কি আমাদের বিবেক ফিরেছে? ধর্ষণ কি রোধ হয়েছে? না তা কখনোই হয়নি। তাই আজও এই কবিতাই লেখা হয় অন্যভাবে, অন্য ভাষাতেও। কবি যতদিন থাকবেন, প্রতিবাদও ততদিন থাকবে। মন্দাক্রান্তা সেনও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর কবিতায়। গুজরাট দাঙ্গা থেকে শুরু করে দিল্লি দাঙ্গা, অসমে নাগরিক পঞ্জিকরণ এবং ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদের অমানবিক মৃত্যু নিয়েও তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র একের পর এক স্বৈরাচারী আইন তৈরি করে প্রতিবাদী নির্দোষ নাগরিকদের জেলে বন্দি করে রেখেছে। তারা সুবিচার পাইনি। সংবাদমাধ্যমগুলিরও কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তাঁর কবিতা সেসবের বিরুদ্ধেই শাণিত তরবারির মতো। সাম্প্রতিক ‘এই বধ্যভূমি’ নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“ঝালদা আমতা পানিহাটি,অতঃপর রামপুরহাটে
জীবনকে দু’পায়ে পিষে মৃত্যুর কারবারি হাঁটে
জীবন অমূল্য নয়, মৃত্যু তো নিছক মূল্যহীন
এই হীন ভাবনার শিকড় কি এতই গহীন !
তার চে’ গভীরে তবু আমাদের দৃঢ় জিজীবিষা
মৃত্যুকেই কাঁধে নিয়ে খুঁজে ফিরি জীবনের দিশা
যে যেখানে প্রাণ হারায়, তারা তো কেউই ফিরবে না
সকল হত্যার মুখ কী জানি কেমন চেনা চেনা
এখানে সস্তাদরে বিক্রি হচ্ছে আমার দেহই
বলো বলো বলো বলো আমরা এই দেশের কে হই
আমরা কি দাহ্যবস্তু, পুড়ে যাচ্ছি হিংসার আগুনে
জীবন-মিছিলে তবু হেঁটে যাচ্ছি লাশ গুনে গুনে
এই রাজ্য আপাতত হত্যার মুক্তাঞ্চল
অপেক্ষায় রাত জাগে রক্তমাখা মায়ের আঁচল
সেই মা আমার মা, সেই কথাটাই মনে জাগে
মৃত্যুর পর সব দলাদলি অকারণ লাগে
রামপুরহাট আর ঝালদা আমতা পানিহাটি
লাশ টেনে টেনে আমরা হাঁটি আর হাঁটি আর হাঁটি
হাঁটতে হাঁটতে পার হব মৃতদেহে ভরা বধ্যভূমি
নতুন দিগন্তে সেই যাত্রায়, হাত ধরো তুমি
এস সাথী এই রাত্রে যাত্রা শুরু করি আমি-তুমি…”
আমরা যেন বধ্যভূমিতেই রয়ে গেছি। মানুষ পোড়ার গন্ধ, সস্তা নারীদেহ বিক্রির কারবার, লাশ গুনে গুনে প্রতিটি মুহূর্ত পার করা আমাদের প্রতিটি দিন চলে যাচ্ছে। আর কখন আমাদের স্বপ্নভূমি পূর্ণতা পাবে? কখন মানুষের পাশে মানুষ এসে দাঁড়াবে? এর উত্তরও খুঁজেছেন অন্যান্য কবিরা। ছিন্নভিন্ন ধর্ষিতা মেয়েটির লাশ দেখেও ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ নামক কবিতায় কবি মৃদুল দাশগুপ্তও গর্জন করেছেন:
“ক্রন্দনরতা জননীর পাশে
এখন যদি না থাকি
তবে কেন এ লেখা, কেন গান গাওয়া
কেন তবে আঁকাআঁকি?
নিহত ভাইদের শব দেহ দেখে
না-ই যদি হয় ক্রোধ
কেন ভালোবাসা, কেন বা সমাজ
কীসের মূল্যবোধ!
যে-মেয়ে নিখোঁজ, ছিন্নভিন্ন
জঙ্গলে তাকে পেয়ে
আমি কি তাকাব আকাশের দিকে
বিধির বিচার চেয়ে?
আমি তা পারি না। যা পারি কেবল
সে-ই কবিতায় জাগে
আমার বিবেক, আমার বারুদ
বিস্ফোরণের আগে।”
কবিতা লেখার মূল ভিত্তিই হল মানবতাবাদ। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিকেও দাঁড়াতে হয়েছে। ছিন্নভিন্ন লাশ দেখে তিনি ঈশ্বরের কাছে বিচার চাইতে পারেন না। যারা এরকম দুর্দশা করেছে তাদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চান। তাই কবিকে বিপ্লবী হতে হয়। বারুদের মতো ফেটে পড়তে হয়। না হলে তিনি কবি কীসের? এই প্রশ্নই প্রতিটি বিবেকের প্রশ্ন। এই বিবেককে ঘুমিয়ে রাখা যায় না। কবি মৃদুল দাশগুপ্তও তা পারেননি। যতদিন না সভ্যতায় মানবিক সকাল হয়, ততদিন এই প্রতিবাদও চলতেই থাকবে। কবিতার ভাষা মানব-সৈনিকের ভাষার মতো ব্যবহৃত হবে। কবি বিভাস রায়চৌধুরী এ কথা লিখলেন ‘যতদিন আসবে না ভোর’ নামক কবিতায়:
“ছিঁড়ে যেতে যেতে আর
মুছে যেতে যেতে
ওই মেয়েটি গোঙায়!
আমাকে নীরব দেখে
সমস্ত কবিতা মরে যায়….
সব শব্দ শেষ হলে
বুক জুড়ে ভেঙে পড়ে ভূমি….
আমার প্রেমিকা শোনো,
আমি তো পারিনি,
যতদিন আসবে না ভোর
মৃতদেহ আগলে রাখো তুমি!”
আজ মেয়েটি গোঙাচ্ছে। কবি নীরব হতে পারেন না। কিন্তু যদি এমন সময় আসে কবি নীরব হয়ে যান, তাহলে কবিতাও বাঁচবে না। যে কবিতা প্রতিবাদ জানে না, যে কবিতায় প্রেম নেই, যে কবিতায় জীবনের দাবি নেই, সে কবিতা কখনো কবিতা হতে পারে না। তখন হৃদয়ও মৃত হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখার ডাঙা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই মৃতদেহ প্রেমিকাকেই আগলে রাখতে বলেন। প্রতিবাদ হবে একদিন প্রতিবাদ হবেই। সব রাষ্ট্র মানবিকরাষ্ট্র হবে কবিও তা বিশ্বাস করেন। প্রত্যেক কবির স্বপ্নই হল dream a world. তাই বিভাস এর কন্ঠেও প্রতিধ্বনিত হল “লাল ঘোড়া ছুটে যায় নীল মানুষের দিকে..” কালের ঘোড়া কখনো থামে না।♦