অতীতের অনেক গবেষকেরই ধারণা ছিল যে, খেলারাম চক্রবর্তী বাংলার ধর্মমঙ্গলকাব্যের প্রাচীনতম কবি ছিলেন। তাঁদের এই ধারণার পিছনে যে কারণটি ছিল, সেটা হল যে— ১৩০২ বঙ্গাব্দের ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে হারাধন দত্ত ভক্তিনিধি দাবি করেছিলেন যে, তিনি খেলারামের ধর্মমঙ্গলের একটি প্রাচীন পুঁথি দেখেছিলেন এবং সেই পুঁথিটির থেকে তিনি সেটির রচনাকাল-নির্দেশক যে ছত্র দুটি উদ্ধৃত করেছিলেন, সেটা নিম্নরূপ ছিল—
“ভুবন শকে বায়ু মাস শরের বাহন।
খেলারাম করিলেন গ্রন্থ আরম্ভণ॥”
উপরোক্ত অংশে ভুবন = ১৪, বায়ু = ৪৯ ধরে অতীতের অনেকেই খেলারামের ধর্মমঙ্গলের রচনাকাল ১৪৪৯ শকাব্দ = ১৫২৭-২৮ খৃষ্টাব্দ বলে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষকরা তাঁদের এই মতের সাথে একমত হতে পারেননি। এছাড়া নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, তিনি খেলারামের ধর্মমঙ্গলের আরও কয়েকটি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেলেও সেগুলোর কোনোটির মধ্যেই রচনাকালজ্ঞাপক উপরোক্ত ছত্রদুটি ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে খেলারাম নামক ধর্মমঙ্গল-রচয়িতার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব— হারাধন দত্ত ও নগেন্দ্রনাথ বসু— মাত্র এই দু’জন গবেষকের সাক্ষ্যের উপরে নির্ভর করে রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ডঃ সুকুমার সেন রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থের ৪র্থ সংস্করণের ৮৫ নং পৃষ্ঠা থেকে জানা যায় যে, গবেষক পঞ্চানন মণ্ডল খেলারামের বাসভূমি বলে পরিচিত পশ্চিমপাড়া গ্রামে গিয়ে সেখানকার একজন বৃদ্ধের মুখে নিম্নলিখিত ছত্র দুটি শুনেছিলেন—
“খেলারাম চক্রবর্তী শণ কাটিছেন বসে।
ধর্ম এসে দেখা দিলেন কুষ্ঠরোগীর বেশে॥”
অন্যান্য গবেষকদের মতে— এই দুই ছত্র কিন্তু আবার রূপান্তরিত আকারে অতীতের বাংলায় প্রচলিত একটি ছড়ার মধ্যেও পাওয়া যায়; ছড়াটি নিম্নরূপ—
“নিধিরাম চক্রবর্তী শন কাটিছেন বসে।
খেলারাম ভট্টাচার্য্য উত্তরিলা এসে॥”
যাই হোক, হারাধন দত্ত ভক্তিনিধি খেলারামের রচনার নিদর্শনস্বরূপ তাঁর লেখায় যে ছত্রগুলি উদ্ধৃত করেছিলেন, সেটির ভাষার দিকে লক্ষ্য রাখলে বোঝা যায় যে, খেলারামের রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যটি খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর রচনা হওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ কাব্যটি কয়েকটি চোটের এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে—
“স্থিত শৈলেশ্বর শিব বঙ্গের অঞ্চলে।
সুরম্য সরসী এক তার মাঝে ঝলে॥
কমল কুমুদ আদি নানা ফুলফল।
বিকাশিয়া ভূষে তার নীল উরঃস্থল॥
শুন বাছা লাউসেন বলি রে তোমায়।
এওজাত দিও নেড়া দেউল তলায়॥”
বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে, এই ভাষা খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধের আগেকার হওয়া সম্ভব নয়। তাই ভাষার দিক থেকে বিচার করলে খেলারামের ধর্মমঙ্গল যেমন এই সময়ের আগে রচিত হয়নি বলা চলে, তেমনি অন্যদিক থেকে বিচার করলেও খেলারামকে খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধের বেশি পরবর্তী বলা চলে না। কারণ— খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি মাণিকরাম গাঙ্গুলী তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্যে, সুরিক্ষার পাটের বন্দিদের তালিকায় প্রচ্ছন্নভাবে যে ক’জন পূর্ববর্তী কবির নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে— কৃত্তিবাস, নরোত্তম, নিধিরাম, গোবিন্দ, কৃষ্ণদাস, মুকুন্দরাম, কাশীরাম, ঘনরাম, চণ্ডীদাস, নরহরি প্রমুখের সঙ্গে খেলারামের নামও পাওয়া যায়।
এইসব কারণে অতীতে গবেষক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়— “ভুবন শকে বায়ু মাস” —ছত্রটির যে ব্যাখ্যা করেছিলেন, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ গবেষকের কাছে সেটাই সমীচীন বলে মনে হয়। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন—
“গ্রন্থকার সম্ভবতঃ শতাব্দীর উল্লেখ করেন নাই, কেবল মাত্র বৎসরের উল্লেখ করিয়াছেন। যেমন ‘বাহাত্তর সালের বন্যা’, ‘ছিয়াত্তরে মন্বন্তর’ ইত্যাদি। বায়ু মাস শব্দে সপ্তম মাস অর্থাৎ কার্তিক মাস বুঝাইতে পারে। ‘শরের বাহন’ বোধ হয় কার্তিক মাসেরই দ্যোতক। তাহা হইলে শতাব্দীটি ইহাতে আন্দাজে জুড়িয়া লওয়া যাইতে পারে। যদি ১৬১৪ শক ধরা যায়, তাহা হইলে ১৬৯২ খ্রীষ্টাব্দ পাওয়া যায়।”
এবং আশ্চর্যের বিষয় হলে যে, ঠিক সেই সময়েই ধর্মমঙ্গলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন খেলারামের অস্তিত্বের প্রমাণ বর্তমান সময়ের গবেষকরা পেয়েছেন। খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশকে রচিত যাদুনাথের ধর্মপুরাণের একটি ভনিতায় পাওয়া যায়—
“বন্দিয়া পণ্ডিত রাম যাদুনাথ ভনে।
খেলারামে ধর্মরাজ রাখিবে কল্যাণে॥”
এর কিছু আগে— ১৬৬২-৬৩ খৃষ্টাব্দে রচিত রূপরামের ধর্মমঙ্গলের একটি প্রাচীন পুঁথিতে রূপরামের গায়ন হিসাবে নিম্নলিখিতভাবে জনৈক খেলারামের উল্লেখ পাওয়া যায়—
“খেলারাম গাএন করিল বহু হিত।
হাতে যন্ত্র দিঞা শিখাইল নাটগীত॥
ধর্ম্মের চরণে মাগিঞা নিএ বর।
খেলারামের কল্যাণ করিবে মায়াধর॥
অনাদ্যমঙ্গল দ্বিজ রূপরাম গায়।
হরিধ্বনি বল সভে পালা হল্য সায়॥”
(বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম অধ্যায়, ২য় সংস্করণ, পৃ- ১৫৩)
বর্তমান সময়ের গবেষকদের মত— যে খেলারাম রূপরামের গায়ন ছিলেন, তাঁরই সঙ্গে ‘ধর্মপুরাণ’ গ্রন্থের রচয়িতা যাদুনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল; তাই যাদুনাথ কাব্যের ভনিতায় তাঁর কল্যাণ কামনা করেছিলেন; এবং এই খেলারামই ধর্মমঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন। সুতরাং— বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনুমিত ১৬১৪ শকাব্দ বা ১৬৯২ খৃষ্টাব্দকেই বর্তমান সময়ের গবেষকরা খেলারামের ধর্মমঙ্গলের প্রকৃত রচনাকাল বলে মনে করে থাকেন।
মধ্যযুগের বাংলার সমস্ত ধর্মমঙ্গলকাব্যের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী রচিত ধর্মমঙ্গলই সর্বপ্রথম আধুনিকযুগে মুদ্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। গবেষকদের মতে, সাহিত্যরসের দিক থেকে এটিই শ্রেষ্ঠ ধর্মমঙ্গল কাব্য বলে স্বীকৃত। একইসাথে আয়তনের দিক থেকেও এটিই সম্ভবতঃ সমস্ত প্রাচীন ধর্মমঙ্গলকাব্যের মধ্যে বৃহত্তম। এই কাব্যের মুদ্রিত গ্রন্থের শেষে যে রচনাকালসূচক শ্লোকটি পাওয়া যায়, সেটি নিম্নরূপ—
“শক লিখে রাম গুণ রস সুধাকর।
মার্গকাদ্য অংশে হংস ভার্গব বাসর॥
সুলক্ষ বলক্ষ পক্ষ তৃতীয়াখ্য তিথি।
যামসংখ্য দিনে সাঙ্গ সঙ্গীতের পুঁথি॥”
এর প্রথম ছত্র থেকে ১৬৩৩ শকাব্দ বা ১৭১১-১২ খৃষ্টাব্দ পাওয়া যায়। এই সময়ের সমর্থক অন্য ঐতিহাসিক প্রমাণও কাব্যটির মধ্যে রয়েছে। ঘনরাম তাঁর কাব্যের মধ্যে একজায়গায় তৎকালীন বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের কল্যাণ কামনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন—
“অখিলে বিখ্যাত কীর্ত্তি মহারাজ চক্রবর্তী কীর্তিচন্দ্র নরেন্দ্রপ্রধান।
চিন্তি তার রাজ্যোন্নতি কৃষ্ণপুর নিবসতি দ্বিজ ঘনরাম রস গান॥”
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্র ১৭০৩ থেকে ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। অতীতে আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় ঘনরামের গ্রন্থের রচনাকালসূচক শ্লোকটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন—
“মার্গণী বা অগ্রহায়ণ মাসের আদ্য অংশে হংস—সূর্য্য ছিলেন (১লা কি ২রা), শুক্রবার, সুলক্ষণ শুরু পক্ষের তৃতীয়া তিথি। পাঁজি গণিয়া দেখিতেছি, ১৬৩৩ শকে ১লা অগ্রহায়ণ শুক্রবার শুরু তৃতীয়া। ১লা হওয়াতে ‘আদ্য অংশ’ও বটে। ‘যাম সংখ্য দিনে’— যাম অর্থে প্রহর। এক প্রহর বেলার সময় সঙ্গীত সাঙ্গ হয়।” (প্রবাসী, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৬৪১)
সুতরাং— ঐ তারিখে, অর্থাৎ— ১৭১১ খৃষ্টাব্দের ২রা নভেম্বর তারিখে ঘনরামের ধর্মমঙ্গলকাব্যটি সমাপ্ত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
তবে ঘনরামের ধর্মমঙ্গল ১৭১১ খৃষ্টাব্দে শেষ হলেও সেটি কিন্তু এর বহু আগেই আরম্ভ হয়েছিল। এত আগে যে, কবি নিজেই তাঁর কাব্যের একজায়গায় বলেছিলেন—
“সঙ্গীত আরম্ভকাল নাহিক স্মরণ।”
মধ্যযুগের বাংলার এরকম বিরাট একটি কাব্য, যেটাকে দীনেশচন্দ্র সেন— “কবির অধ্যবসায়ের এক বিরাট দৃষ্টান্ত” —বলেছিলেন, সেট লিখতে এরকম সুদীর্ঘকাল লাগাই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়। তাই খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশকে ঘনরাম তাঁর ধর্মমঙ্গলকাব্যটি রচনা করতে শুরু করেছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে।
ধর্মমঙ্গলকাব্য ছাড়া ঘনরাম চক্রবর্তী— ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ বা ‘সত্যনারায়ণরসসিন্ধু’ —নামের আরেকটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। অতীতের কেউ কেউ উক্ত গ্রন্থটিকে কবির প্রথম বয়সের রচনা বলে মনে করলেও বর্তমান সময়ের গবেষকরা তাঁদের সাথে একমত হতে পারেননি। কারণ— উক্ত গ্রন্থে কবির চারজন পুত্রের নামই পাওয়া যায়। ঘনরামের সত্যনারায়ণের পাঁচালীতেও তৎকালীন বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়— “দ্বিজভক্ত মহারাজা কীর্তিচন্দ্র রায়।”
সুতরাং— এই গ্রন্থটিও নিশ্চিতভাবে ১৭০৩ থেকে ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। অতীতের গবেষকদের মধ্যে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন যে— “ঘনরাম ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।”
দীনেশবাবু এই সালটি খুব সম্ভবতঃ কবির একজন বংশধরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এরকম ধারণা করবার কারণ হল যে, তিনি তাঁর লেখায় ঘনরামের একজন জীবিত বংশধরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে ঘনরামের জন্মসাল হিসেবে দীনেশচন্দ্র সেনের উল্লেখ করা সালটি সঠিক হওয়া অসম্ভব নয়। ঘনরাম যে রামচন্দ্রের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, সেকথার প্রমাণ তাঁর ধর্মমঙ্গলকাব্যের বহু জায়গা থেকে পাওয়া যায়। নিজের ‘সত্যনারায়ণরসসিন্ধু’ গ্রন্থের একজায়গায় তিনি সত্যনারায়ণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—
“শ্রীরামপদারবিন্দে দিবে মোর মতি।”
তাছাড়া তাঁর পুত্রদের প্রত্যেকের নাম ‘রাম’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছিল বলে দেখা যায়; যথা— রামরাম, রামগোপাল, রামগোবিন্দ এবং রামকৃষ্ণ। ধর্মমঙ্গলের ভনিতায় তিনি তাঁর নিজের সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন—
“প্রভু যার কৌশল্যানন্দন কৃপাবান্।”
এছাড়া তিনি তাঁর কাব্যে নিজেকে— “শ্রীরামদাসের দাস”; অর্থাৎ— রামচন্দ্রের ভৃত্যের ভৃত্যও বলেছিলেন বলে দেখা যায়। ঘনরাম স্বয়ং রামচন্দ্রের আদেশে ধর্মমঙ্গল কাব্য লিখেছিলেন বলে অতীতে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল। (বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম অধ্যায়, ১ম সংস্করণ, পৃ- ১৮১) কিন্তু ডঃ সুকুমার সেনের মতে সেই কাহিনী ঘনরামের অধুনালুপ্ত আত্মকাহিনীর— ‘মর্ম’ —ছিল।
ঘনরাম শুধু বাংলা মঙ্গলকাব্যের কবি ছিলেন না, তিনি বৈষ্ণব পদ-সাহিত্যেরও কবি ছিলেন। ‘পদকল্পতরু’ গ্রন্থে তাঁর লেখা পনেরোটি সুন্দর বৈষ্ণব পদ সঙ্কলিত করা হয়েছিল বলে দেখা যায়। যদি তিনি তাঁর সময়ের একজন জনপ্রিয় ও সুপ্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণবপদকর্তা না হতেন, তাহলে তাঁর রচিত এতগুলি পদ ‘পদকল্পতরু’ গ্রন্থে জায়গা পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেদিক থেকে বিচার করলে ঘনরামই মধ্যযুগের বাংলার একমাত্র কবি ছিলেন, যিনি মঙ্গলকাব্য ও পদাবলী-সাহিত্য— প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এই দুই ধারাতেই সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন।
ধর্মমঙ্গলকাব্যের ভনিতা থেকে ঘনরাম সম্বন্ধে অনেক ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর বংশলতিকাটি নিম্নরূপ—
পরমানন্দ→ ধনঞ্জয়→ (ক) শংকর, (খ) গৌরীকান্ত;
(খ) গৌরীকান্ত→ ঘনারাম→ (১) রামরাম, (২) রামগোপাল, (৩) রামগোবিন্দ, (৪) রামকৃষ্ণ।
অতীতে ঘনরামের মায়ের নাম নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছু সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। ঘনরাম তাঁর কাব্যে নিজের মায়ের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—
“মাতা যার মহাদেবী সতী সাধ্বী সীতা।”
এথেকে বোঝা যায় যে, তাঁর জননীর নাম ছিল— সীতা। কিন্তু এই প্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেন বলেছিলেন—
“ঘনরামের মাতার নাম সীতা নয়, মহাদেবী। তিনি যদি রাজরানী হইতেন তবে, ‘মহাদেবী’ বিশেষণ ধরা চলিত। নিতান্ত গৃহস্থ নারীর বিশেষণ ‘মহাদেবী’ মনে করা চলে না।”
কিন্তু পরবর্তী সময়ের গবেষকদের মতে— তখনকার দিনের মানুষেরা তাঁদের নিজেদের মা’কে কোন রাজরানীর থেকেও বেশি সন্মান করতেন এবং তাঁকে— “নিতান্ত গৃহস্থ নারী” —বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন না। এই কারণে তাঁরা ডঃ সুকুমার সেনের মতের সাথে সহমত পোষণ করতে পারেননি। এরপরে ডঃ সেন লিখেছিলেন—
“… ‘সীতা’ নামও তখন চলিত না, কেন না কন্যা সীতার মত দুঃখিনী হইবে ইহা তখন কোন মাতাপিতা ভাবিতে পারিত না।”
বর্তমান সময়ের গবেষকরা তাঁর এই মতের সাথেও সহমত পোষণ করতে পারেননি। কারণ— ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রীর নাম ছিল— সীতা। সুতরাং— ঘনরামের জননীর নাম যে সত্যিই সীতা ছিল, সেবিষয়ে বর্তমান সময়ের গবেষকদের অন্ততঃ কোন সন্দেহ নেই।
ঘনরামের ধর্মমঙ্গলকাব্যের ভনিতা থেকে আরও জানা যায় যে, বর্তমান বর্ধমান জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত কইয়ড় পরগণার কৃষ্ণপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি ছিল। সেই জেলারই রায়নায় তাঁর মাতুলালয় ছিল এবং তাঁর মাতামহের নাম ছিল গঙ্গাহরি। পৌষম্বান বংশে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তিনি (বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের কাছ থেকে?) ‘কাব্যরত্ন’ উপাধি পেয়েছিলেন।#