খৃষ্টীয় ঊনিশ শতকের বাংলায় যাঁরা বাংলা গদ্যসাহিত্যের সযত্ন চর্চা করেছিলেন, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০-১৮৯৯) তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের মতে, মাত্র ঊনত্রিশ বছরের স্বল্পস্থায়ী জীবনে বলেন্দ্রনাথ যে গদ্যকীর্তি রেখে গিয়েছেন, তা ভাষানৈপুণ্যে অতুলনীয়। কিন্তু এখানে বলেন্দ্রনাথের লিখিত প্রবন্ধাবলীর মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব নয় বলে, ভাষাশিল্পী বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করাই যুক্তিযুক্ত হবে।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে অতীতের গবেষকরা প্রথম যে কথাটি জানিয়েছিলেন, সেটা হল যে, তিনি আমৃত্যু একজন রচনা রসিক (stylist) ছিলেন। অতীতে প্রিয়নাথ সেন তাঁর যে বিশেষত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা হল যে, বলেন্দ্রনাথের—‘কিছু মূলধন ছিল’; আর তাই তিনি সে সময়কার সর্বাতিশয়ী রবীন্দ্র-প্রভাবের মধ্যে থেকেও নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এছাড়া অতীতের বিভিন্ন সাহিত্য সমালোচক ও গবেষকরা বলেন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনার বর্ণনায় প্রাচুর্য্য, সূক্ষ্মতা, চারুতা ও নাটকীয়তা লক্ষ্য করেছিলেন। এবং তাঁদের মতে, এসবের মধ্যে বলেন্দ্রনাথের রচনার বর্ণনার পিছনে তাঁর অতন্দ্র শিল্পচেতনা ছিল।
আসলে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন যথার্থ গদ্যশিল্পী হওয়ার সব ক’টি গুণই বলেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল। সেযুগের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্র পরিবেশ থেকে তিনি যেমন সৌন্দর্যজ্ঞান ও সুরুচি পেয়েছিলেন, ঠিক তেমনি আবার নিজের সাধনার মাধ্যমে বাংলা ভাষার ওপরে দখল ও ভাবের প্রতি নিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। আর এই দু’য়েরই সম্মিলনে শেষপর্যন্ত গদ্যশিল্পী বলেন্দ্রনাথকে পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ভাষাচর্চাকে একরকম আর্টের চর্চা বলেই মনে করতেন, যার পেছনে তাঁর সযত্ন অনুশীলন ছিল। সাহিত্য সমালোচকদের মতে রবীন্দ্র-গদ্যে যেমন বিশেষণের বহুল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি বলেন্দ্রনাথের গদ্যে আবার বিশেষ্যপদের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়।
এছাড়া বলেন্দ্রনাথ ভাব ও ভাষার একজন নিষ্ঠাবান শিল্পীও ছিলেন। তাই বলেন্দ্রনাথের বাংলা গদ্যকে শুধুমাত্র সরস বলা চলে না, বরং তা কোমল; এবং শুধু সমঞ্জস নয়, বরং তা সংযমেও বাঁধা। তাঁর রচিত গদ্যে শব্দ চয়নের তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য ও বাক্য রচনায় তাঁর সযত্ন নিরীক্ষা পরিচয়ও পাওয়া যায়। একারণেই অতীতে আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যের এই গুণগুলি লক্ষ্য করে বলেছিলেন—
“লেখকের ভাবুকতা ও লিপিকৌশল উভয়ের মূলস্থ শক্তি সামঞ্জস্যবোধ ও সংযম। এই দুইটি না থাকিলে সুরভি থাকে না। … বলেন্দ্রনাথের যে এই সংযম প্রচুর পরিমাণে ছিল, তাহা তাঁহার ভাষাতেও যেমন বুঝা যায়, ভাবগ্রাহিতাতেও তেমনি বুঝা যায়। তিনি ভাবের রাজ্যে বিচরণ করিতেন ও ভাবের বায়ুভরে উড়িয়া বেড়াইতেন; অথচ আপনাকে একান্ত পরবশ করিয়া মেরুদণ্ডহীনের মত ভাবের স্রোতে আপনাকে ভাসাইয়া দিয়া আপনাকে শোচনীয় ও কৃপাপাত্র করিয়া তুলেন নাই।”
তবে শুধু এটুকুই নয়,—বলেন্দ্রনাথের গদ্যে যে সংযম ও কোমলতা এবং স্নিগ্ধতা ও শান্তি লক্ষ্য করা যায়, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর বলেন্দ্রনাথের মুখমণ্ডলেও এই গুণগুলির প্রতিফলন দেখেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। অতীতে এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন্দ্র-রচনাবলীর ভূমিকায় জানিয়েছিলেন—
“তাঁহাকে মিতভাষী ও মিষ্টভাষী দেখিতাম। তাঁহার রচনায় যে কোমল, স্নিগ্ধ, প্রশান্ত শ্রী ছিল, তাঁহার মুখে চোখে ও কথাবার্তায় তাহা আরও স্পষ্ট দেখা যাইত। এখানে যেন তাহা সমস্ত তারল্য ও চাঞ্চল্য ত্যাগ করিয়া আরও ঘনাইয়া আসিয়াছিল। বালকের মূর্তির ভিতরে প্রৌঢ়ের গাম্ভীর্য্য দেখিতে পাইতাম। তাঁহার পরিমিত স্বল্পাকন উক্তি প্রত্যুক্তির ভিতর যেন একটা নির্লিপ্ততার ভাব দেখিতাম। তিনি যেন পর্যবেক্ষক মাত্র, সংশয়ের চক্রে তাঁহাকে যেন কেহ বাঁধিয়া দিয়াছে, কিন্তু তিনি তাহার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছেন মাত্র, উহাতে আগ্রহের সহিত যোগ দিতেছেন মাত্র।”
অন্যান্যদের মতে, বলেন্দ্র-চরিত্রের এই বিশ্লেষণেই বলেন্দ্র-স্টাইলের ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে। বস্তুতঃ, ‘style is the man’—এই কথাটি বলেন্দ্র-জীবনে সম্পূর্ণ সার্থকতা লাভ করেছিল বললেও ভুল কিছুই বলা হয় না। তবে এসব ছাড়া বলেন্দ্রনাথের বাংলা গদ্যের আরো কিছু লক্ষ্যণীয় গুণ হল—গঠন-সৌষ্ঠবের নৈপুণ্য, কারুশিল্পীর নিষ্ঠা, ডিটেলের (detail) প্রতি ঝোঁক, নাটকীয়তা সৃষ্টির কৌশল, প্রৌঢ়ের দুর্লভ অন্তর্দৃষ্টি, এবং সৌম্য বিচারবুদ্ধি। এসব গুণের সমবায়েই বলেন্দ্রনাথের গদ্য রচনার স্টাইল গঠিত হয়েছিল। আর তাই বলেন্দ্রনাথকে ঊনিশ শতকের বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম শ্রেণীর একজন শিল্পী (artist) বললে ভুল কিছুই বলা হয় না। কিন্তু বলেন্দ্রনাথের বাংলা গদ্যে যে অনায়াসনৈপুণ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, সংযম ও প্রশান্তি লক্ষ্য করা যায়, সেটা যে তাঁর বহু প্রযত্নের ফলমাত্র ছিল, একথা একথা এখন বিস্মৃতপ্রায়। মাত্র ঊনত্রিশ বছরের জীবনে বলেন্দ্রনাথ আমৃত্যু বাংলা গদ্যের সাধনা করেছিলেন বলেই এর পরিপূর্ণ-রূপটি এখন সকলের নজরে পড়ে, ফলে সেযুগের নিরিখে এবিষয়ে তাঁর দুরূহ সাধনার দিকটি তেমনভাবে কারো চোখে পড়ে না। অতীতে তাঁর এই সাধনার বিষয়ে বলতে গিয়ে আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন—
“আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্যে ভাষার প্রতি এইরূপ যত্ন অতি দুর্লভ; অধিকাংশ লেখক ভাষাকে কেবল ভাব-প্রকাশের যন্ত্রমাত্র দেখেন, উহাকে কারুশিল্পের হিসাবে দেখেন না। কবিতা রচনায় ছন্দের আবশ্যকতা আছে; বলেন্দ্রের গদ্য রচনাতেও সেই ছন্দের ঝঙ্কার শুনিতে পাওয়া যায়; এই ছন্দ ভাবের সহিত মিলিয়া মিশিয়া অপরূপ কলাকৌশলের উৎপত্তি করিয়াছে।”
তাই বলেন্দ্র-গদ্যের সঙ্গে পূর্ণ কোন স্রোতস্বতীর অনায়াস তুলনা করা চলে; কারণ, স্রোতস্বতীর মতোই তাঁর গদ্যও স্থির মন্থর গতিতে নিজের নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে গিয়েছিল; এর গতিপথে কখনো ফেনিল আবর্ত উপস্থিত হয়নি; উত্তাল তরঙ্গের কোলাহল কখনো এর ধ্যান ভঙ্গ করেনি; এবং উপলব্ধির পথে এর শান্তগতি কখনো ব্যাহত হয়নি। আর তাই বলেন্দ্র-গদ্য-প্রবাহে আজও শুধু শান্তি, কোমলতা, প্রসন্নতা এবং উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করা যায়; আর এই প্রবাহের নিয়ামক হলেন অতন্দ্র শিল্পসাধক গদ্যশিল্পী বলেন্দ্রনাথ নিজেই। সমালোচকদের মতে—‘প্রাচীন উড়িষ্যা’, ‘দিল্লীর চিত্রশালিকা’, ‘কণারক’ প্রমুখ প্রবন্ধে বলেন্দ্রনাথের অতিযত্নে গড়ে তোলা স্টাইলের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। আসলে বলেন্দ্রনাথের হাতে ভাষার এক বীণাযন্ত্র ছিল, আর তাঁর সেই বীণাযন্ত্রে কখনো গম্ভীর, কখনো মন্থর, কখনো উদাত্ত, কখনো স্তিমিত, কখনো ব্যথাহত, তো কখনো আবার লাস্যচঞ্চল ধ্বনি বেজে উঠেছিল। একথার উদাহরণস্বরূপ এখানে তাঁর ‘প্রাচীন উড়িষ্যা’ শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি ছত্র তুলে ধরা যেতে পারে, যা থেকে বলেন্দ্র-গদ্যের ধ্বনিরোল শুনতে পাওয়া সম্ভব—
“জীবনস্রোত ভাবতবর্ষে তখনও মন্দীভূত হইয়া আসে নাই। জীবনে সুখও ছিল, সখও ছিল—সুরম্য হর্মমধ্যে সুসজ্জিত কক্ষে প্রমদাগণ দুগ্ধফেননিভ শয্যায় বসিয়া প্রিয়জনের সহিত সুখে প্রেমালাপ করিতেন; অনতি উচ্চ মঞ্চোপরি সরক ও পানপাত্র থাকিত, এবং সুন্দরীর পাণ্ডু কপোলদেশ বারুণীরাগসঞ্চারে অরুণিম শোভা ধারণ করিত। কলাবিদ্যার তখন বিশেষ প্রাদুর্ভাব। বীণার তারে তারে নাচিয়া নাচিয়া তম্বঙ্গীর চম্পক অঙ্গুলি সৌদামিনীর মত খেলিয়া বেড়াইত এবং প্রিয়জন সেই চঞ্চল অঙ্গুলি চালনার মধ্যে পথ খুঁজিয়া পাইতেন না। কেবল, সেই মধুর বীণাধ্বনি, সুন্দরীর অঙ্গরাগসৌরভ ও চঞ্চল রূপের তরঙ্গ মিলিয়া মলয়সেবিত চন্দ্রালোকস্নিগ্ধ নিশাকে স্বপ্নের মত মনোহর করিয়া তুলিত।”
তবে বলেন্দ্রর গদ্যে শুধু দূর-অতীত বিলাস উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় না, বরং জনতার উৎসবের বর্ণনাও রয়েছে; এবং এক্ষেত্রেও বলেন্দ্রনাথ রঙের পর রঙ চড়িয়ে নিজের বর্ণভাণ্ড নিঃশেষ করেছিলেন বলে লক্ষ্য করা যায়। যেমন—এই একই প্রবন্ধেরই অন্য অংশে তিনি লিখেছিলেন—
“এমনি দেখিতে দেখিতে ধান কাটার দিন আসিত। সোনার ধানে ক্ষেত ভরিয়া উঠিয়াছে। কৃষকেরা দলে দলে ধান কাটিতে বাহির হইয়াছে; কৃষকাঙ্গনারা গান গাহিতে গাহিতে ধানের আঁটি বাঁধিতেছে। গৃহে গৃহে উৎসব। দেবতা মন্দিরে পূজার ভারি ধূম। সিংহাসন হইতে রাজা নামিয়া আসিয়াছেন, প্রাসাদ হইতে অমাত্যের দল উপস্থিত, পশ্চাতে সমস্ত প্রজাপুঞ্জ; মন্দিরের প্রাঙ্গণ হইতে বাহিরের দিগন্ত অবধি লোকারণ্য। উজ্জ্বল নীলাকাশতলে বিচিত্র উজ্জ্বল বর্ণের বেশভূষা—ময়ূরকন্ঠী ধূপছায়া লাল নীল সোনালী গোলাপী বেগুণী নানা বর্ণের তরঙ্গ; মণিমুক্তা জরী জহরৎ ঝক্ করিতেছে। পট্টবস্ত্র পরিহিত ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রপাঠ করিতেছেন, হোমাগ্নিতে অনবরত ঘৃতাহুতি ও সাজাঞ্জলি প্রদত্ত হইতেছে, স্তূপাকার পুষ্পরাশিতে দেবতা দুনিরীক্ষ্য; বাহিরে নহবৎ বসিয়াছে, ভিতরে কাঁসরঘণ্টা শঙ্খধ্বনির বিরাম নাই; আবালবৃদ্ধবনিতা রাজা হইতে ভিক্ষুক অবধি নতশিরে দেবতার আশীষ গ্রহণ করিতেছেন।”
তবে সমালোচকদের মতে, ‘দিল্লীর চিত্রশালিকা’ প্রবন্ধেই বলেন্দ্রনাথের স্টাইলের চরম পরীক্ষা হয়েছিল। আসলে শুধুমাত্র বিশেষণ প্রয়োগের মাধ্যমে জীবন্ত বর্ণনায় কোনো চিত্রের প্রাণ-প্রতিষ্ঠার দুর্লভক্ষমতা বলেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল। মধ্যযুগের ভারতে আগত ফরাসি পর্যটক পিয়ের লোতির ‘ভারত-ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’– এ তাঁর এই দুর্লভ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া। সুতরাং এবিষয়ে বলেন্দ্রনাথ অন্ততঃ পিয়ের লোতির সমকক্ষ ছিলেন। ‘দিল্লীর চিত্রশালিকা’ প্রবন্ধে বলেন্দ্রনাথ বর্ণনার সূচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন—
“প্রাচ্য জীবনপ্রবাহেরই মত এই চিত্রার্পিত জীবনস্রোত রূপে বর্ণে আলোকে, বিচিত্র মিলন বিরহ সম্ভোগে, কখনও হাসিতে, কখনও অশ্রুচ্ছ্বাসে, কখনও সুখে, কখনও বেদনায়, কোথাও নিবিড় নির্জন দাম্পত্যের রমণীয় স্নিগ্ধচ্ছায়ে, অন্যত্র আলোকচ্ছটা-বিচ্ছুরিত সহস্রসখীপরিরস্তাকুলিত নৃত্যগীতরস-রভসে হিল্লোলিত ও বিহ্বলিত হইয়া মদালসময়ী মন্দগতিতে নিঃশব্দে বহিয়া চলিয়াছে।”
সমালোচকদের মতে, এখন এই বর্ণনাগুলি পড়লে একথাই মনে হয়, এতে যেন ভাষার মৃদঙ্গ বাজছে— কখনো মধুর, কখনো গম্ভীর, কখনো চটুল, আবার কখনো বা বিষণ্ণ। আর বলেন্দ্রনাথই এই মৃদঙ্গধ্বনির স্রষ্টা ছিলেন। তবে ‘দিল্লীর চিত্রশালিকা’ প্রবন্ধে বলন্দ্রনাথের গদ্য-স্টাইলের যদি চরম পরীক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর ‘কণারক’ প্রবন্ধে এর চরম বিকাশ ঘটেছিল। বস্তুতঃ, সমালোচকদের মতে, এই প্রবন্ধে ভাষাশিল্পী বলেন্দ্রনাথের যে পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এছাড়া এই প্রবন্ধের পিছনে একটি উদাস, বিধুর, বিদগ্ধ ও অতন্দ্র শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষের পরিচয়ও পাওয়া যায়; আর সেই মানুষটি হলেন বলেন্দ্রনাথ। এই প্রবন্ধে পরিত্যক্ত, নির্জন, অবহেলিত সূর্যমন্দিরের প্রাচীন বৈভব ও বর্তমান রিক্ততাকে বলেন্দ্রনাথ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তবে একাজ করতে গিয়ে এখানে তাঁর বর্ণভাণ্ডেরর রঙ নিঃশেষিত হয়ে যায়নি, বরং নিজের হৃদয়ের সমবেদনা উজাড় করে দিয়ে বলেন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। কণারকের বর্তমান উদাস-বিধুর রূপটি দীর্ঘায়ত বাকোর বাঁধনে ধরা পড়েছে। সমালোচকদের মতে, এর বর্ণনায় নিরুচ্ছাস বিবৃতি ও অনলংকৃত উপমার পিছনে তাঁর একটি সচেতন শিল্পীমন কাজ করেছিল। আর তাই এই প্রবন্ধের সূচনায় তিনি লিখেছিলেন—
“কণারকে এখন কিছুই নাই, ধূ ধূ প্রান্তর মধ্যে শুধু একটি অতীতের সমাধিমন্দির—শৈবালাচ্ছন্ন পরিত্যক্ত জীর্ণ দেবালয় এবং তাহারই বিজন বক্ষের মধ্যে পুরাতন দিনের একটি বিপুল কাহিনী।”
এরপরে এই মন্দিরের অতীত বৈভবের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন—
“এই বিলাসখচিত মন্দিরের দ্বারে কত লোকে কতদিন অন্তরের দারুণ নির্বেদ লইয়া আসিয়াছে। সংসার পাছে কামনার উদ্রেক করে, পাছে কোনদিন স্ত্রীর মুখ দেখিয়া মোহ উপস্থিত হয়, সন্তানের মায়া কাটান না যায়, বৃদ্ধ পিতামাতার অশ্রুজল বন্ধনচ্ছেদনে বাধা দেয়, গৃহ স্ত্রী পুত্র পিতামাতা সমস্ত পরিজন পরিত্যাগ করিয়া লোকে দেবদ্বারে আসিয়া হত্যা দিয়া পড়িয়াছে—হে দেবতা, রক্ষা কর, মায়াপাশ ছিন্ন করিয়া দাও, আমি তোমার দ্বারে চিরদিন সন্ন্যাসী হইয়া রহিব। হায়, জড় দেবতা, সে যদি বুঝিত-তুমি কি অন্ধকার মোহরাশিতে গঠিত! ক্ষীণ দীপালোকে তুমি ভক্ত হৃদয়ের বৈরাগ্য অনুমোদন কর; এবং শত দীপালোকে তোমারই সম্মুখ-প্রাঙ্গণে নিত্য মদন বিলাসের এক অঙ্ক অভিনীত হয়!”
আর তারপরে ‘কণারক’–এর বর্তমান রিক্তরূপের আশ্চর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন—
“কণারকে এখন দেবতা নাই—এত কথা বলা খাটে না। কিন্তু সমস্ত প্রান্তর জুড়িয়া সেখানে এক নিশ্চল বৈরাগ্য বাসা বাঁধিয়াছে। তাহার মুখে কেবল হায় হায়। … পরিত্যক্ত পাষাণস্তূপের নির্জন নিকেতনে নিশাচর বাদুড় বাসা বাঁধিয়াছে, হিমশিলাখণ্ডোপরি বিষধর ফণিনী কুণ্ডলী পাকাইয়া নিঃশঙ্ক বিশ্রামসুখে লীন হইয়া আছে; সম্মুখের ঝিল্লিমুখরিত প্রান্তরদেশ দিয়া গ্রাম্য পথিকজন যখন কদাচিং দূর তীর্থ উদ্দেশে যাত্রা করে, একবার এই জীর্ণ দেবালয়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া চতুর্দিকে চাহিয়া দেখে এবং বিলম্ব না করিয়া আসন্ন সূর্যাস্তের পূর্বেই দ্রুতপদে আবার পথ চলিতে থাকে।— কর্ণারক এখন শুধু স্বপ্নের মত, মায়ার মত; যেন কোন প্রাচীন উপকথার বিস্তৃতপ্রায় উপসংহার শৈবালশয্যায় এখানে নিঃশব্দে অবসিত হইতেছে— এবং অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিরেখায় ক্ষীণপাণ্ডু মৃত্যুর মুখে রক্তিম আভা পড়িয়া সমস্তটা একটা চিতাদৃশ্যের মত বোধ হয়।”
আর অবশেষে কণারকের অধঃপতনে দুঃখিত বলেন্দ্রনাথ— ‘স্বপ্নো শু, মায়া নু, মতিভ্রমো নু’— বলে মৃদুকণ্ঠে যে বিলাপ করেছিলেন, তাঁর সেই বিলাপ গদ্যরাজ্য উত্তীর্ণ হয়ে গীতিকাব্যের রাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছিল। আর সমালোচকদের মতে, এখানেই বলেন্দ্রনাথের স্টাইলের চরম প্রকাশ ঘটেছিল।
তাই এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা চলে যে, বলেন্দ্রনাথ শুধু একজন গদ্যলেখক ছিলেন না, বরং তিনি একজন গদ্যশিল্পীও ছিলেন। আর এই শিল্প ক্ষমতা তিনি নিজেই অর্জন করেছিলেন; শুধু তাই নয়, ভাষার সচেতন অনুশীলনে গদ্যের জাদুমন্ত্রটি তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। বাস্তবে বাংলা সাধু গদ্য একজন নিপুণ শিল্পীর হাতে পড়লে যে কতটা গভীর ও অর্থবহ, স্বচ্ছন্দ ও প্রশান্ত, এবং কোমল ও উজ্জ্বল হতে পারে, একথার যথার্থ প্রমাণ বলেন্দ্রনাথের গদ্য থেকেই পাওয়া যায়। আর তাই বলেন্দ্রনাথকে শুধু একজন নিপুণ ভাষাশিল্পী বলা চলে না, তিনি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের একজন নিষ্ঠাবান শিল্পী ছিলেন; আর এটাই তাঁর বিশিষ্টতা ছিল।#




