আজ বিজয় দিবস। অথচ স্বাধীনতার এই গৌরবোজ্জ্বল দিনে ইতিহাস সংরক্ষণের প্রশ্নে আমরা এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। এই দিনটি বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রাম, সীমাহীন ত্যাগ ও আত্মদানের চূড়ান্ত পরিণতির প্রতীক। বিজয় দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রচেতনা, জাতীয় পরিচয় এবং ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার দিকনির্দেশনা।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংকটকে আরও ঘনীভূত করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালানো হয়। একই রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৫ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দেয়।
পরবর্তী দীর্ঘ নয় মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে এবং ৩ থেকে ৪ লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। এই সময়ে কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী প্রতিরোধ, মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের ফলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা।
বিজয় দিবস আমাদের অতীত স্মরণের পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিও দায়বদ্ধ করে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের পর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর পরবর্তী সময়ে ৫ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো— এই ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ, সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ কিংবা দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও ভাস্কর্যও ভাঙচুরের শিকার হয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও তা রক্ষায় রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা কোনো ব্যক্তি বা দলের বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। এই দায়িত্বে ব্যর্থতা স্বাধীনতার চেতনাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে। ইতিহাস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নীরবতা অনেকের কাছে দায়িত্বহীনতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যারা এসব ভাঙচুরে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ায় অপকর্মের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতি উৎসাহিত হয়েছে বলেও সমালোচনা উঠেছে।
একই সঙ্গে, যে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই দেশ থেকে শিল্পী এনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসের সঙ্গে সংবেদনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানের স্পষ্টতা এখানে অনিবার্য ছিল।
রাষ্ট্রীয় রেওয়াজের প্রশ্নেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিজয় দিবসে সামরিক কুচকাওয়াজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। অথচ গত বছর ও চলতি বছর এই কুচকাওয়াজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতীক ও আনুষ্ঠানিকতা ক্ষুণ্ন হলে আন্তর্জাতিক পরিসরেও একটি রাষ্ট্রের অবস্থান ও আত্মপরিচয় প্রশ্নের মুখে পড়ে— এ বিষয়টি অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।
বিজয় দিবস কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর নয়; এটি সমগ্র জাতির অর্জন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তেমনি বিজয় দিবস উদযাপনও হওয়া উচিত সর্বজনীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা রাষ্ট্র এবং নাগরিক উভয়ের দায়িত্ব। ইতিহাস বিকৃতি, অবহেলা কিংবা নীরবতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়বিচ্ছিন্ন করে তোলে। তাই প্রয়োজন সত্য ইতিহাস চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
বিজয় দিবস আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। এই দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালন করা মানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা না করতে পারলে বিজয় শুধু ক্যালেন্ডারের একটি তারিখে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।




