আপাত বিশৃঙ্খলা, যুক্তিহীন, স্বয়ংক্রিয় আত্মগত কোনো উৎস থেকে উপলব্ধির জাগরণ ঘটানো যদি সম্ভব হয়, তাহলেই ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কাছে আমরা গিয়ে বসতে পারি। জীবনের সংরাগ আর অভিভব মেশানো এক শূন্যতার দরজায় উপলব্ধির নকশাগুলি মেলে দিতে পারি। বিমূর্ত চেতনায় চালিত হতে হতেই এক রূপজ অবয়বের কাছে আমাদের ভাবনা প্রক্রিয়ার নির্মাণ সাধিত হতে থাকে। জার্মানির হামবুর্গে বসবাসকারী ভারতীয় কবি-লেখক সঙ্গীতজ্ঞ ও ধ্যান শিক্ষক অমোঘ স্বামী The Home: A Haiku নামে একটি হাইকুতে লিখেছিলেন
“From void’s womb they bloom,
Cosmic dance of fleeting forms,
Stars return to dusk.”
(Amogh Swamy, On My Way To Infinity: A Seeker’s Poetic Pilgrimage)
অর্থাৎ শূন্যের গর্ভ থেকে তারা প্রস্ফুটিত হয়,
ক্ষণস্থায়ী রূপের মহাজাগতিক নৃত্য,
তারারা সন্ধ্যায় ফিরে আসে।
শূন্যের মহাজাগতিক গর্ভ থেকেই বোধের পর্যাপ্ত উত্থানকে কাব্যের মহিমা দান করেছেন ব্রতী মুখোপাধ্যায়ও। তিনি লিখেছেন:
“শূন্য
সেই ঠাঁই অনন্ত সারাক্ষণ গর্ভ যন্ত্রণায়,
সেইখানে শতখানেক কুঠুরির মন,
একান্ত আরশিও, লক্ষরঙা ভুবন ডাঙার ছায়া ধরে,
ধরে আপ্রাণ প্রাণ পিঞ্জরও নয়দুয়ারির”
এখানেই বাসনাকষ্টগুলি জোনাকি হয়।
স্বয়ংক্রিয় কবির বিক্ষিপ্ত সঞ্চার ঘটে। যাকে কবি বলেছেন: “শূন্যের ঘরে অবাধ্য পাগলামি/ব্যথাঝলমল”। ব্যথাও রঙিন হয়ে উঠলে কবিতা তখন ভেতর ও বাহিরেও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। সৌন্দর্যের এপাশ-ওপাশ আলোয় উদ্ভাসিত করতে থাকে। মঙ্গল আরতির আয়োজনে তার আনুষ্ঠানিক জাগরণ ঘটতে পারে। আর সেই কারণেই কবি ভালোবাসার ঘোষণার সঙ্গে কবিতার ঘোষণাকেও মিলিয়ে দেন:
“বুকের ভিতর নিয়ে আমি কবিতা লিখব
বুকের উপর নিয়ে আমি কবিতা লিখব
আকাশ ধুয়ে রোদ নেমেছে কবিতা লিখব
তোমার মুখে রোদ পড়েছে কবিতা লিখব
শাঁখ বাজাও ধূপ জ্বালাও দুয়ারে নেই খিল
তিলের ঠোঁটে একটি-দুটি শব্দ দানের দিন”
কবিতা এভাবেই এসেছে কবির কাছে। ‘তুমি’ ও ‘তোমার’ সঙ্গে তুমুল প্রকৃতিও এসে বসতি স্থাপন করেছে। ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষণও জুড়ে গেছে। শরীরের সঙ্গে কোথাও অশরীরী। বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্যের মিলনও শব্দের মাপকে দীর্ঘ করেছে। শিসের সঙ্গে নীরবতাও এবং দাহর সঙ্গে ব্যথাও বেজে উঠেছে। তাঁর কবিতায় আমরা প্রেম চিনতে পারি, প্রেমের ভুবন চিনতে পারি, মুক্তকচ্ছ শব্দের কারিগরকেও চিনতে পারি। কাব্যকলার নিয়ম বহির্ভূত চলনে চলার তৌফিকও রপ্ত করতে পারি। গল্প না-গল্পের ঘ্রাণে উজ্জীবিত হতে পারি। চোখ তখন দৃষ্টির প্রলম্বিত আধার হয়ে যায়। সময়ের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। রহস্য চারিপাশেই সাজাতে থাকে ক্রিয়া। কবি তখন লিখতে পারেন:
‘মধুজোছনায় অশ্রু যেই মিলিয়ে দিলাম কাজল’
‘নাভিতলের অফুরান যন্ত্রণারা প্রজাপতিরং’
‘মাখনঠোঁটের কামড়’ থেকে ‘রজনীর গন্ধ ঠোঁট ছুঁয়ে নীল রঙের আগুন’ এবং ‘তার ভেতর একটুখানি ছাতিমফুলের আর পারি না’ নঞর্থক শিস। অথবা ‘তার ভেতর একটুখানি ঝালরদোলানো ব্যথা’ এভাবেই শিকড় ছড়ানো অনুভূতির মন্থন আর বিমূর্ত চিত্রকল্পের গভীর অন্বয় । কানাডিয়ান-আমেরিকান জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞানী, মনোভাষাবিদ, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক এবং জনবুদ্ধিজীবী…
স্টিভেন আর্থার পিঙ্কার তাঁর গ্রন্থে বলেছেন:
“If we dig even deeper to the roots of words, we unearth physical metaphors for still more abstract concepts.”
(Steven Pinker, The Stuff of Thought: Language as a Window into Human Nature)
অর্থাৎ যদি আমরা শব্দের শিকড়ের আরও গভীরে খনন করি, তাহলে আমরা আরও বিমূর্ত ধারণার জন্য শারীরিক রূপক খুঁজে পাই। ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় এই physical metaphors-এরই ছড়াছড়ি বেশি।
তিনটি কাব্য:
১) লং লিভ মনখারাপ! লং লিভ!(জানুয়ারি ২০২০)
২) মাটির নিচে জলের বেহালা বাজছে (২০১৮)
৩) দেয়ালদিনের কবিতা (এপ্রিল ২০১৭)
সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলেও, সময়ের উচ্চারণকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেও আত্মস্থিত এক উপলব্ধির প্রজ্ঞায় শারীরিক রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন শব্দে শব্দে প্রায় প্রতিটি কবিতাটিতেই। তাই মাঠ, বাড়িঘর, সন্ধ্যেবেলা, রোদ, মেঘ-বজ্র, হলুদঠোঁট পাখি, ব্যথা, রাষ্ট্র, আগুন, আমলাশোল, চাঁদ, ভারতবর্ষ তাঁর কবিতায় বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিমূর্ত শূন্যতায় মূর্ত হয়েছে উপলব্ধির ক্ষরণ। কোনো কবিতার আলাদা নামকরণ প্রয়োজন হয়নি। প্রবহমান এক চক্র নির্বিকল্পবোধের সীমানায় অসীম হয়ে উঠেছে। কোন্ কাব্যের কোন্ কবিতা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। নিজস্ব ঘরানাতেই কবিকে চেনা যাবে।পড়তে পড়তে সেই স্রোতেই অবগাহন করি বারবার:
“নিজের কোনো আলো নেই আমার,অন্ধকার নেই
না-ফুরনো শীত বুকের ভেতর
পথে পথে দীপবাহক, থামে না,ফেরি করে সূর্যের আলো,
আনন্দের গুঁড়ো ভাসে
আকাশে
প্রাচীন মঞ্চ জানে, আকাশের নিরিকল্প মাঠ সব জানে
আসতে না আসতেই সরে যায় প্লাবনের বেনজির নদী, মৌন ও একা,
শুকনো পাপড়ি পুরাতন অশ্রুরেখার কথা তুলতে চায়
নিজের কোনো আলো নেই আমার, অন্ধকার নেই”
পড়তে পড়তেই শুনতে পাই মাটির নিচে কেমন করে জলের বেহালা বাজছে।সময়ের পতাকা উড়ছে, বুকের ক্ষতগুলি বড় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অন্ধকার মানবিক চৈতন্যের চিতা সাজাচ্ছে। সভ্যতার সিঁড়িগুলি ভেঙে ফেলছে রাষ্ট্র শাসনের নামে। কান্না ও রক্ত একসঙ্গে বয়ে চলেছে আমাদের মানবিক পাহাড়ে। ভালোবাসার ফুল কখন ফুটবে তবে? এক অস্থিরতা যাপনের মধ্যে আমাদের রাস্তাগুলি ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছে। অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে আমাদের স্পন্দন থেমে আছে।
‘দেয়াল দিনের কবিতা’ বিপন্নতার বহুমাত্রিক প্রজ্ঞায় উঠে আসা মুহূর্ত গুচ্ছ আলাদা আলাদা নামকরণে খণ্ডিত হলেও উৎসমূলের সামঞ্জস্যে একীভূত চেতনার পরিচয়ে উদ্দীপ্ত। মানবিক অন্বেষণ জারি রেখেই কবির পথে নামা।প্রেমই তাঁর ব্যবসার মূলধন। শব্দই তাঁর ভাষা। উপলব্ধিই তাঁর প্রজ্ঞার নির্মিতি। অন্ধকার অনিশ্চয়তায় ভরা যাত্রাপথ:
“নক্ষত্রের ভরসায় প্রদীপ জ্বলছে না
আগুন পিঠে, বিছানা পুড়বে
অশরীরী উৎসবের রাত”
এই রাত প্রতিকূলতায় ভরা। রক্তের ছিটে লাগে গাছের পাতায় পাতায়। কে কোথায় খুন হয় কেউ জানে না। তবু কবি পাপে অথবা পুণ্যে থাকেন না। ভালোবাসায় থাকেন। এখনো ‘তুমি’ বলে ডাকেন। মাটির নিচেও জল থাকে না। চোখেও জল থাকে না। তখন নিজের রক্ত নিজেই পান করে অসময়ের দেশে ‘জান কাহিল রাত্রির চরে’ এসে দাঁড়ান। নিজের ছাল নিজেই ছাড়ান। নুন ছিটিয়ে কেমন কষ্ট! কষ্ট বোঝেন। ছিন্ন সময়, ভাঙা স্বপ্ন, বৃষ্টির রাত সবই শত্রু-শত্রু। কাতর করেছে অকাতরে। অন্ধ চোখে তবুও ‘সূর্যপ্রচোদিত’ ‘জাদুদীপন’। বিদীর্ণ সত্তা সঞ্চয় করে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ। কবিতাযাপন সময়যাপনের সমান্তরালে এক বিষাদদ্রাঘিমা টেনে দেয়। আমরা তখন খুঁজে পাই দেয়ালদিন। পাঠকের কাছে বাংলা কবিতার এক নতুন উচ্চারণ, এক নতুন অভিজ্ঞতার পথপরিক্রমায় ব্রতী মুখোপাধ্যায় নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।♦
১) লং লিভ মনখারাপ! লং লিভ!: ব্রতী মুখোপাধ্যায়, সৃষ্টিসুখ,৩০-এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯, প্রচ্ছদ : রোহণ কুদ্দুস, মূল্য ৯৯ টাকা।
২) মাটির নিচে জলের বেহালা বাজছে: ব্রতী মুখোপাধ্যায়, 24by7 Publishing, ১৩ নিউ রোড, কলকাতা:৭০০০৫১, প্রচ্ছদ:চন্দ্রা মণ্ডল, মূল্য ১৫০ টাকা
৩) দেয়ালদিনের কবিতা : ব্রতী মুখোপাধ্যায়, কথা ও কাহিনি, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩,প্রচ্ছদ: অঙ্কন মাইতি। মূল্য-৭৫ টাকা।