আমি কোনো গ্রাম বা কোনো সম্প্রদায় কিংবা আপনাদের জন্যে লিখি না। কল্পনার নিতান্ত আত্মগত চর্চাও আমার কাজ না। আমার লেখালেখির কাজটাকে হতে হবে অবশ্যই রাজনৈতিক। এর অভিমুখ সেইটাই। সমালোচকদের মধ্যে আজকাল এমন একটা বাজে ধারণা চালু আছে, কোন লেখায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেই সেই লেখকের গায়ে কোনো না কোনোভাবে একটা দাগ লেগে গেল। আমার অনুভূতি ঠিক এর উল্টো- সেই ধরনের প্রভাব না থাকাটাই বরং কলঙ্কের। সমস্যাটা দেখা দেয় যখন শিল্পকে বক্তৃতা মনে হয় তখনই। আমার তো মনে হয় শ্রেষ্ঠ শিল্প অবশ্যই রাজনৈতিক- এবং শিল্পটাকে একই সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে রাজনৈতিক এবং স্থির-নিশ্চিতভাবে সুন্দর করে তোলার ক্ষমতা আপনার থাকা চাই। কথাগুলো বলেছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ (এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী) লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টনি মরিসন (ক্লোই আর্ডেলিয়া উয়োফোর্ড, ১৯৩১-২০১৯)। ‘লেখক’ বিশেষণটিকে চাইলে ‘ঔপন্যাসিক’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। কেননা, তিনি মূলত ঔপন্যাসিকই। অষ্টাশি বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রেখে গেছেন এগারোটি উপন্যাস যেগুলোর একটি আরেকটির মত নয়- প্রতিটিই স্বতন্ত্র চারিত্রের। কী বিষয়ে কী ভাবনায়, তাঁর প্রতিটি উপন্যাস মনে দাগ কেটে যাওয়ার মত। আর দুটি নভেলা। ভাবি, কথাসাহিত্যিকেরা যেরকম উপন্যাসের প্রেল্যুড হিসেবে কিংবা উপন্যাসের সমান্তরালেই ছোটগল্প লেখেন টনি সেরকম লেখেন নি। কেন লেখেন নি তার একটা কারণ হয়তো অনুমেয়। শুরু থেকেই তাঁর লিখবার উপাদান আর আয়তন এত বিপুল যে সেগুলোকে উপন্যাস নামক পরিব্যাপ্ত শিল্পরূপে গেঁথে রাখবার প্রাণনাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল অধিক। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক এবং ব্যক্তিগত মাত্রায় এত বিশাল যে টনি মরিসন স্বয়ং একটি উপন্যাস। আরম্ভের কথাগুলো তাঁর রচনাসমগ্রের কেন্দ্রগ অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচ্য। যে-শিরোনামে কথাগুলো বলা হচ্ছে তা থেকে অনুভব করা যাবে, তিনি কোন্ জাতের লেখক: ‘রুটেড্নেস: দ্য এ্যানচেস্টর এ্যাজ ফাউন্ডেশন’। এ্যানচেস্টর বা পূর্বসুরি চরিত্রের সামাজিক-সাহিত্যিক অভাববোধ তাঁকে পীড়িত করে। এই সুরিত্বকে আরেকটু টেনে রাষ্ট্রীয় অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিচার করে দেখলে তাঁর ভাবনার গভীরতা বোঝা যাবে। পৃথিবীর দেশে-দেশে ক্রূর বর্তমান নানা পন্থায় নানা কায়দায় সুরিত্বকে মুছে ফেলে ইতিহাস নামক স্বতঃস্ফূর্ত প্রেক্ষাপটকে স্বেচ্ছাচার গড়ন দেওয়ার যে-ক্রীড়ায় মত্ত সেই বাস্তবতাকে মনে রাখলে টনি মরিসনের কথাগুলো পরিণত হয় দর্শনে, জীবনের দর্শনে। একই সঙ্গে তাঁর উপন্যাসগুলো হয়ে ওঠে ইতিহাস, সমকাল ও ভবিতব্যের ত্রিমাত্রিক প্রেক্ষাগার।
আরও পড়ুন: শেখ ফয়জুল্লা ও নাথ সাহিত্য
১৯৮৭ সালে ইলেইন শোওয়াল্টার আফ্রো-আমেরিকান ও ফেমিনিস্ট সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক একটি রচনায় আমেরিকার বেশ কয়েকজন নারী লেখকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে এঁদের সাহিত্যকর্মকে নারীরচিত সাহিত্য বলে চিহ্নিত করবার পুরনো দিন শেষ হয়ে গেছে। যে-লেখকগুচ্ছের নাম নেন ইলেইন তাঁরা হলেন এ্যান বিয়েটি, গ্রেস প্যালে, এ্যানি ডিলার্ড, এ্যান রেডমন্ড, সিনথিয়া ওসিক, এ্যান টাইলার, এ্যালিস ওয়াকার, ম্যাক্সিন হং কিংস্টোন, মার্জ পিয়ার্সি, ক্যাথারিন রেনওয়াটার এবং টনি মরিসন। তাঁদের শক্তির মাত্রা সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে ইলেইন দৃষ্টান্তসহ প্রতিতুলনায় দেখান, তাঁদের রচনা পুরুষ লেখক হেনরি জেমস, শারউড এ্যান্ডারসন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ডেভিড থোরু, ফ্ল্যানারি ও’কনর, ইউডোরা ওয়েল্টি কিংবা উইলিয়ম ফকনারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। টনি মরিসনকে তিনি স্থাপন করেন ফকনারের সমকাতারে। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস টার বেবি-তে (১৯৮১) ইলেইন দেখতে পান শ্রেণি, বর্ণ এবং লিঙ্গায়ন-ক্ষমতার এক অসাধারণ প্রতিফলন। বর্তমানকে উপস্থাপন করতে গিয়ে ঔপন্যাসিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেন দক্ষ সমাজবিজ্ঞানীর মতন। উপন্যাসের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র মডেল-কন্যা জাডিন এবং কৃষ্ণাঙ্গ যুবক সন যাদের উৎসভূমি ক্যারিবিয় দ্বীপ। জাডিন ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট এবং মডেল-কন্যা। ওর কাকা-কাকি একটি ধনাঢ্য শ্বেতাঙ্গ পরিবারে গৃহপরিচারকের কাজ করে। সন এক ক্যারিবিয় দ্বীপে শ্রমিকের পেশায় নিয়োজিত। জাডিন এবং সন দু’জনের প্রেম এবং নৈকট্যের মধ্য দিয়ে আমরা দেখি স্বপ্ন নয় স্বপ্ন থেকে ছিটকে গিয়ে মানুষ কি করে দুঃস্বপ্নের গহ্বরে পড়ে। দ্বীপ থেকে তারা পাড়ি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে- আবাস বা আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু গৃহই তাদের অভিবাসী জীবনে জন্ম দেয় দুঃস্বপ্ন ও বেদনার। এটি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠির বেদনা, সংগ্রাম আর আপোষকামিতার পরিস্থিতির দুঃসহ-বাস্তব চিত্রণ। ১৯৯৫ সালে কারিন ব্যাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টনি মরিসন বলছিলেন, শৈশব থেকেই তিনি জানতেন শে^তাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়েদের বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদেরকে ‘টার বেবি’ (আলকাতরা-মেয়ে) নামে সম্বোধন করে। একসময়ে আলকাতরার খনি পবিত্র বা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচ্য ছিল। কেননা, সেটি নির্মাণের কাজে লাগতো। মোজেস-এর ডিঙ্গি নৌকা কিংবা পিরামিডের মতন বিভিন্ন জিনিসকে একত্র-নিবদ্ধ করে রাখতো আলকাতরা। টনি মরিসন আসলে আলকাতরা-শিশু বলতে বুঝিয়েছেন সেই কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে যে কিনা এরকমই একত্র-নিবদ্ধ করে রাখার কাজটাতে সক্ষম। উপন্যাসের একটা বড় সার্থকতা এখানে, কৃষ্ণাঙ্গরা এতে প্রধান চরিত্র হলেও এটি কেবলই তাদের কাহিনি হয়ে থাকে নি। এটি হতে পারে অভিবাসী পূর্ব ইউরোপিয়, দক্ষিণ এশিয় কি লাতিন আমেরিকার জনগোষ্ঠির জীবনেরও প্রতিপাদ্য। বর্তমান মানবাভিবাসনের অষ্টাবক্র জটিল মানচিত্রে উজ্জ্বল আলো ফেলতে সক্ষম চার দশক কাল আগেকার এই উপন্যাস। উপন্যাসটির ধ্রুপদসম্ভব আবর্তনের বৈশিষ্ট্যকে মনে রেখেই হয়তো অনেক সমালোচক এটিকে একটি মহৎ পোস্টমডার্ন উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
টনি মরিসনের লেখালেখিকে অনেকেই তাঁর জাতিগত ও ব্যক্তিগত জীবনবেদনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মুক্তো বলে আখ্যা দিয়েছেন। একসময়ে আফ্রো-আমেরিকান বা আফ্রিকান লেখকদের জন্যে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ও চর্চিত মাধ্যম ছিল আত্মজৈবনিক ধরনের রচনা। এমন অসাধারণ সব রচনার কথা বলা যায় যেগুলো উপন্যাসের চাইতেও স্মরণযোগ্য কিংবা উপন্যাসেরই সমান্তরাল এক ক্ষিপ্র ধারা হয়ে আজও ধরে রেখেছে নবাবিষ্কৃত দ্বীপসম কত-কত জীবনকে। কেনিয় ঔপন্যাসিক এন্গুগিকে পাঠ করতে গেলে তাঁর বন্দি জীবনের আত্মকথা ‘ডিটেন্ড্ : এ রাইটার্স প্রিজন ডায়েরি’র (১৯৮১) কথা আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। এমন অনেক অসাধারণ কথা পাওয়া যাবে তাঁর এ-গ্রন্থে যেসব তাঁর উপন্যাসে নেই কিন্তু তাঁর মানসকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে গেলে কথাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। তিনি লিখেছিলেন, তাঁর বন্দিত্বের বিষয়টি আসলে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নয় এটি কেনিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের নিরিখেই গুরুত্বপূর্ণ। স্পষ্ট ভাষায় তিনি উচ্চারণ করেন, তাঁকে যারা বন্দি করেছে তারা আসলে উপনিবেশবিস্তারী আন্তর্জাতিক পুঁজিশক্তির তাঁবেদার। যুগ-যুগ ধরে তারা কেনিয়ার স্থানীয় স্বার্থান্বেষীদের সঙ্গে মিলে প্রতিবাদী জনতার কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছে। তাঁর আত্মকথনে নিরবতা, বিষন্নতা আর বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সংযোগ হারানো এক অদ্ভুত জগতের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়। টনি মরিসন স্বয়ং এ-জাতীয় রচনার অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। আমাদের কাছে মনে হয়, নিজের অভিজ্ঞতা এবং তাঁর বিশ^ উপন্যাস পাঠের সমন্বয়টাকে তিনি করতে পেরেছেন অনবদ্যভাবে। অল্প বয়স থেকেই বাকপটু এবং ভাষা ব্যবহারে দক্ষ মেধাবী টনি গল্প-উপন্যাস পাঠের মধ্য দিয়ে ইতিহাস সমাজ ও সময়কে পর্যবেক্ষণ করবার এষণা অর্জন করেছিলেন। একদিকে নিজের ও অন্যদের দুঃস্বপ্নতাড়িত বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে ছাত্রজীবন থেকে উপন্যাসপাঠ এবং পরে সাহিত্যের ছাত্র হয়ে উপন্যাস নিয়ে গবেষণাকর্ম করবার প্রস্তুতিপর্ব এই দুই সজোর স্রোত তাঁর প্রকৃত জীবনটাকেই একদিন উপন্যাসময় করে তোলে।
আরও পড়ুন: নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে
একটা আতঙ্কগ্রস্ত ‘ট্রমাটাইজ্ড্’ জীবনের সমূহ চাপ কাঁধে নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর পিতা জর্জ উয়োফোর্ড-এর জর্জিয়ার কার্টারস্ভিলের জীবনটা হয়তো ঔপন্যাসিক মরিসনের আদি পশ্চাৎপট। পনেরো বছর বয়েসি জর্জ দেখতে পান তাঁর দুই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবেশি শ্বেতাঙ্গদের হাতে নিহত হচ্ছে। দু’টি মৃতদেহের সাক্ষী এক কিশোরের বাকি জীবনটা সেই আতঙ্কের ছায়ায় কেটে যায়। আবার টনির যখন দুই বছর বয়স তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর দরিদ্র শ্রমিক পিতার বাড়িভাড়া বাকি পড়ে যাওয়ায় শ্বেতাঙ্গ বাড়িঅলার ভয়ংকর অদ্ভুত-অস্বাভাবিক আচরণ ও প্রতিক্রিয়া। বাড়িঅলা স্বয়ং আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে ভাড়াটিয়ার মানে বাড়িঅলার নিজেরই ঘরে। আগুনলাগা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হোহোহাহা অট্টহাসি হাসে বাড়িঅলা হতাশ নয় বরং উৎকট উদযাপনে। এইসব রূঢ় রোদে তেঁতে ওঠা টনির জীবন পাঁপড়ি ছড়িয়ে মেলে যেতে থাকে ক্রমে। কখনও-কখনও বাইরের পৃথিবীর লু-হাওয়া সয়ে যায় ভেতরের সতেজ হাওয়ায়। সেই হাওয়া ছিল তাঁর পিতামাতার উত্তরাধিকারবাহিত। বাবা-মা’র মুখে শোনা আফ্রো-আমেরিকান লোকগল্প ভূতের গল্প কি গান তাঁকে নিয়ে যেতো ভিন্ন এক কল্পলোকে। আফ্রিকার সেই আদি জীবনের নির্যাস কি শেকড়ের টান এভাবেই তাঁর সত্তার গভীরে অব্যবহিত উপাদানের রূপ নেয়। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া থেকে আসা, পোল্যান্ড থেকে আসা, ইউক্রেন কি হাঙ্গেরি থেকে আসা লেখকেরা তাঁদের আদি উৎসকে তাঁদের উপজিব্যতার অন্তর্গত করতে পারলে তিনি কেন তাঁর আফ্রিকীয় উৎসকে অবলম্বন করতে পারবেন না। হয়তো সেই আদি উৎসে হাত দিলেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসবে দাসত্ব আর ঔপনিবেশিকতার অকহতব্য ইতিকথা। কিন্তু সেটিকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। টনি মরিসন কিন্তু তাঁর আফ্রিকীয় উত্তরাধিকারকে তাঁর মনন ও চেতনার সর্বস্ব করবারও পক্ষপাতী ছিলেন না। আমরা স্মরণ করতে পারি কৃষ্ণাঙ্গ লেখক রিচার্ড রাইট কিংবা জেমস বল্ডউইনকে। একসময়ে তাঁদেরকেই আফ্রো-মার্কিন সাহিত্যের সবচাইতে প্রভাবশালী রচয়িতা হিসেবে গণ্য করা হতো। টনি নিজের প্রকাশে রাইট এবং জেমস বল্ডউইনের চাইতে খানিকটা ভিন্ন কায়দা বেছে নেন।
উপন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবনকে দেখে-দেখে সেইসঙ্গে নিজের জীবনকে মেপে পথ হাঁটা মরিসন ছাত্রজীবনেই উপন্যাস-দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ওঠেন। প্রিয় দুই লেখক জেন অস্টিন কিংবা লেভ তোলস্তোয়ের সাহিত্যে নিমগ্ন থাকেন মুগ্ধতা নিয়ে। ছাত্রজীবনে জেন অস্টিনের উপন্যাসে নারীর অবস্থা নিয়ে তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনার উদ্যোগে অবাক হন তাঁর পণ্ডিত শিক্ষকগণ। এম. এ. ক্লাসে গবেষণা অভিসন্দর্ভ রচনা করেন ভার্জিনিয়া উল্ফ্ এবং উইলিয়ম ফকনারের সাহিত্যকর্ম নিয়ে। উপন্যাস যে জীবনের ঠিক পাশ ঘেঁষে যাওয়া একটি স্পষ্ট রেখা সেকথা সর্বদা বিশ্বাস করতেন টনি মরিসন। লেখালেখিসংক্রান্ত নানা গদ্যে তাঁর এসব চিন্তাভাবনার টুকরো-টাকরা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেছেন উপন্যাস একসময়ে ছিল শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির বিষয় যেখানে বৃহত্তর জনজীবনের কোনো উপস্থিতি ছিল না। অথচ বাইরের বৃহত্তর জীবনটা অনেক বেশি জীবন্ত আর বর্ণিল। সেখানে নাচ-গান-উৎসব উপলক্ষ আর গল্প-গাঁথার অবিরত প্রবাহ চলমান। অভিজাত শ্রেণি চেয়েছে তাদের শিল্পাঙ্গিক দিয়ে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা রচনা করে রাখতে। কালক্রমে উপন্যাসই বদলে গিয়ে অবহেলিত সেই বৃহত্তর শ্রেণিটাকে আত্মস্থ করে নিল। সেটা হয়তো দুম্ করে একদিনেই ঘটে নি। টনি স্যামুয়েল রিচার্ডসনের পামেলা কিংবা জেন অস্টিনের উপন্যাসের দৃষ্টান্ত দেন যেসব উপন্যাস নিজস্ব শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অভ্যেস-প্রথা প্রভৃতি প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলে যায়। পরবর্তীতে উপন্যাস মানুষকে এমন সব কথা বলতে আরম্ভ করে যেসব কথা এতকাল তাদের কাছে ছিল অজানা। হয়তো সেসব তাদেরই কথা, কিন্তু সেসব কথা থেকে তাদের অবস্থান ছিল বহু দূরে। টনি মরিসন দেখলেন তাঁর নিজস্ব উত্তরাধিকার তাঁর পূর্বপুরষদের স্থান-কাল ইতিহাসের অমোচনীয় একটা ছাপ কোথাও না কোথাও থেকেই যাচ্ছে। যে-গান গল্প-গাঁথার সন্ধান তিনি পান তাঁর পিতা-পিতামহদের কাছে তারই একটা উদ্গম তিনি টের পান তাঁর সাহিত্যিক সত্তার অভ্যন্তরে। তিনি দেখলেন নাচ-গান-নাটকীয়তায় ভরা জীবনটা উপন্যাসে আসে নি মানে ইউরোপিয় দৃষ্টিতে সেসব ছিল অচিন্তনীয়। তিনি চাইলেন উপন্যাসটাকে জনসংযোগের একটা হাতিয়ারে পরিণত করতে। কেমন সে অবলম্বন- ধরা যাক কোনো এক কৃষ্ণাঙ্গ-চার্চে ফাদার সার্মন করছেন জনতার মধ্যে জনতার উদ্দেশ্যে। ঈশ^রের সত্তা এবং জনসমষ্টির মাঝখানে উভয় পরিম-লীর একটা সেতুবন্ধন তিনি। কখনও-কখনও এমন হয়, সার্মন চলাকালীন দুঃখ-পরিতাপে দগ্ধ ফাদার কান্নার প্রশান্তি নিয়ে আসেন। তখন চার্চের শ্রোতৃম-লীরও কান্না পায়। ঔপন্যাসিকের জায়গাটা সেরকম একটা অবলম্বনের বোধ এনে দেবে পাঠককে। এমনকি প্রচলিত প্রকৃতিবর্ণনকেও টনি মরিসন বদলে দিতে চান। ব্লুয়েস্ট আই, সুলা, টার বেবি কিংবা সং অব সলোমন উপন্যাসে প্রকৃতি পূর্বেকার মত মানুষের সত্তার সমান্তরালে থাকে না, প্রকৃতি মানুষের সংবেদনা এবং অনুভূতির উপাদানে পরিণত হয়। বৃক্ষরাজি, মাছ, মেঘ অথবা মৌমাছি প্রকৃতির এসব উপাদান তাদের সজীবতা দিয়ে (যেহেতু তারা নির্জীব নয়।) তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়ে প্রকাশ করে তাদেরই পাশাপাশি অনুভূতি নামক এক বিচিত্র জিনিসের অধিকর্তা মানবের বেঁচে থাকা ও সংগ্রাম করাটাকে। গাছেদের কম্পন, মাছেদের ভয়ার্ত প্রতিক্রিয়া, মেঘের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি কি মৌমাছির নৃত্যের তৎপরতা যেন এক অনিবার্য ভাষিকতা যার পাঠোদ্ধার কখনও সম্ভব হয়, কখনওবা সেসব দুর্জ্ঞেয় প্রতীকতার মুদ্রা। টনি আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ চিত্রকলার (লোকায়ত এবং নাগরিক দুই-ই) ঐতিহ্য থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের জন্যে।
চলবে…




