সেদিন তখন বেলা যায় যায়। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য তাপ বিকিরণ করলেও তা বেশ কোমল। আশ্বিনের শেষ বিকেলের রোদ গায়ে মেখে নিজের বাড়ির উঠোনের কোণার আম গাছের নীচে বসে গাঙকূল হাটির রাধানাথ নিমগ্ন হয়ে এঁটেল মাটি দিয়ে কুপি বাতি বানায় আর কুনকুনিয়ে গান গায়। সে তার কুপিবাতি ঘষে পালিশ করে আর কুনকুন করে। এমন সময় আলগা বাড়ির রসরাজ আসে তার খোঁজে। তাকে দেখে মুচকি হেসে রাধানাথ বলে, অধমের খোঁজ নিতে আইছো, উদ্দেশ্য কি গো?
উদ্দেশ্য কিছু না লো। এমনি বেড়াইতে আইলাম।
উম! আমি যেমন জানিনা, তুমি কত এমনি এমনি বেড়াইতে আসার লোক!
‘অয়লো এমনি এমনি আইছি। তোর লগে গপ্পো করতে।’ রাধানাথের বাড়িয়ে দেয়া জলচৌকিতে বসতে বসতে বলে রসরাজ। তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। রাধানাথ তার হাতের কাজ চালিয়ে যায় আর রসরাজ গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ চোখে রাধানাথের বাতি পালিশ করা দেখে। রসরাজ এলে রাধানাথ খুব খুশি হয়। আজও হলো। সচরাচর কেউ তার কাছে গল্প করতে আসে না। সেও খুব একটা যায় না কারো কাছে। যদি যায় তো ওই রসরাজ দাদির বাড়িতেই যায়। আর এই রসরাজও আসে তার কাছে।
রসরাজ নিরবতা ভাঙ্গে। বাতি কেমন বিক্রি হয় লো?
ভালোই তো হয়।
কৃষকের সন্তান রাধানাথ জাত কুমার নয়। ছোটবেলা থেকে এঁটেল মাটি দিয়ে সে নানারকম জিনিস তৈরি করত। সেই নেশা এখন তার দ্বিতীয় পেশা। গরিব কৃষক রাধানাথ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তার সামান্য চাষের জমিতে যেটুকু ধান ফলায় তাতে মা আর তাদের পাঁচ ভাইবোনের বছরের অন্নটুকু জুটলেও অন্নের সাথে যেটুকু বন্ত্র লাগে আর নিত্যদিনের লবণ, মরিচ, কুপি বাতির তেল, আর মাঝে সাঝে কাপড় ধোয়ার সোডা এবং গুরুতর অসুখের সময় নিরুপায় হয়ে একটু ওষুধ কিনতে হলে খোরাকির ধান বেচতে হয়। তাতে প্রায়ই ভাতের চাউলে টান পড়ে। গ্রামে যাদের এমন অবস্থা তারা দৈবাৎ দ্বিতীয় কোনো কাজ খোঁঁজে পেলে বেঁচে যায়, নইলে উপোস দিতে হয়। উপোসের ভয়ে রাধানাথও অন্য কোনো কাজ খুঁজেছিল। পায়নি। তার পিঠে মস্ত কুঁজ। সে তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারেনা। নিজের জমির চাষ সে কষ্টে সৃষ্টে করে নেয় বটে কিন্তু লোকে তাকে কাজ দিতে চায়না। নিরুপায় রাধানাথের শখের কাজটাই একদিন তার দ্বিতীয় পেশায় পরিণত হয়। এতে তার আর্থিক অবস্থার একটু বদল হয়। কিছুটা পয়সা বাঁচিয়ে ছোট দুটো বোনের বিয়ে দেয়। কুপিবাতি বানাতে বানাতে নিজের শখের কাজ কেমন করে তার রোজগারের মাধ্যম হয়ে গেল ভেবে সে প্রায়ই অবাক হয়। ছোটবেলায় কয়েকদিন স্কুলে গিয়েছিল রাধানাথ। পরীক্ষা শেষে মাস্টারসাব একবার সকল ছাত্রছাত্রীকে মাটি দিয়ে যার যার পছন্দমত ফলমুল বা সব্জি বানিয়ে নিতে বলেছিলেন। নিজের জমির আইল থেকে এঁটেল মাটি এনে রাধানাথ বানিয়েছিল আম, আনারস আর পেঁপে। তার হাতের কাজ দেখে মাস্টারসাহেব ধন্য ধন্য করেছিলেন। প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে সে একটু সময় পেলেই নিজের আর পাড়ার ছোট ভাইবোনদেরকে মানুষ ও গরু,ঘোড়ার পুতুল বানিয়ে চমকে দিত। একদিন সন্ধ্যায় রাধানাথের মায়ের হাত থেকে পড়ে কাচের বোতলে তৈরি ঘরের একমাত্র কুপিবাতিটি ভেঙ্গে গেলে সারারাত তাদের অন্ধকারে থাকতে হয়েছিল। একে তো কুপিবাতিটি ভেঙে সবটুকু কেরোসিন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল তার ওপর ঘরে আর একটা কাচের বোতল বা কালির দোয়াতও ছিল না যা দিয়ে আর একটা নতুন কুপিবাতি বানানো যায়। সেই অন্ধকার রাত ভোর হলে, রাধানাথের মা পাশের বাড়ি থেকে একটা খালি কালির দোয়াত চেয়ে এনে তাতে পুরনো কাপড়ের সেজ লাগিয়ে আর একটি নতুন কুপি বানায়। তারপর বিকেলে পশ্চিমপাড়ার আফজল মিয়ার দোকান থেকে ধারে একপোয়া কেরোসিন কিনে এনে সেই কুপিবাতিতে ভরলে সন্ধ্যাায় তাদের ঘরে একটু আলো জ্বলে।
কুপিবাতি ভেঙ্গে ঘর অন্ধকার থাকায় সে রাতে আর খাওয়া হয়নি তাদের। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাইরে যাওয়ার ভয়ে প্রকৃতির ডাকও চেপে রাখতে হয়েছিল সবাইকে আর ছোট ভাইটা ঘরেই প্রস্রাব করে দিলে সে রাতে মনের কষ্টে রাধানাথ অনেক কিছু ভেবেছিল- টাকার অভাবে কতদিনের শখ একটা হারিকেন দূরে থাক, টিনের কুপিবাতি কিনতে পারে না তারা। একটা টিনের কুপিবাতি বাজার থেকে কিনতে গেলে আধসের কেরোসিনের দাম চলে যায়, আর একটা হারিকেন কিনতে হলে লাগে দুতিন সের কেরোসিনের দাম। আবার তার কাচের চিমনিও ভেঙে যায় দুদিন পরপর। তাই কেবল হারিকেন কিনলেই চলে না, যখন তখন চিমনি কেনার পয়সারও জোগাড় রাখতে হয়। হারিকেন কেনার টাকা না থাকায় রাধানাথের মা ওষুধের খালি কাচের বোতল বা কালির দোয়াতের ছিপি ছিদ্র করে, সেই ছিদ্রের ভেতর দিয়ে, নিজের পুরনো কাপড়ে পাকানো সলতে ঢুকিয়ে কুপিবাতি বানায়। সন্ধ্যায় সেই কুপিতে কেরোসিন তেল ঢেলে যখন বাতি জ্বালায় তখন সেই বাতি তাদের যাপিত জীবনের মতো টিমটিম করে জ্বলে।
নির্ঘুম সেই রাতে এতসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে রাধানাথের হঠাৎ মাথায় আসে মাটি দিয়ে কুপিবাতি বানিয়ে ঘর ভরে রাখলে কেমন হয়? যাতে একটা ভাঙলেও আর একটা হাতের কাছে পাওয়া যায়! ভোর হতেই এঁটেল মাটি আনতে সে তার ধানের জমিতে ছুটে যায়। তারপর মাটি নিয়ে বাড়ি ফিরে, সেই মাটি ছেনে ছুনে, কয়েকবারের কসরতে, একটা কুপিবাতির আদল তৈরি করে সে। সেটা রোদে শুকিয়ে, আরও কিছুক্ষণ ঘষে -মেঝে, চেঁছে- ছেনে খুব সুন্দর নকশা করে সে যখন একটা বাতি বানাতে সক্ষম হয়,দেখে সকলেই খুব তারিফ করেছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে পরেরদিন সকাল থেকে বিকাল একটানা অনেকগুলো কুপিবাতি বানায়। বানানো শেষ হলে সেগুলোকে দুদিন ধরে রোদে শুকিয়ে,ঘষে মেজে পালিশ করে দারুণ সব নকশা এঁকে, চুলার আগুনে পুড়তে দেয়। পোড়ে পোড়ে সেগুলো যখন কয়লা রং ধরে তখন সে সবগুলো বাতি চুলা থেকে তুলে, সারি সারি করে তার বারান্দায় সাজিয়ে রেখে দেয়। কুপিবাতি বানানোর কথা শুনে উঠান ভেঙে পাড়াপড়শীরা এসেছিল সেই কুপিবাতি দেখতে। রাধানাথ তাদের সামনেই একটা কুপির মধ্যে কেরোসিন তেল ভরে, পুরনো কাপড়ে তৈরি সেজ ঢুকিয়ে বাতি জ্বালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
মাটির কুপি তাতে আবার আলো! সবাই বলল, ওমা দেখো! দেখো! কী সুন্দর জ্বলতাছেগো ! আর দেখতেও কী সুন্দর নকশাদার! ও ভাই রাধানাথ, আমারারে একটা কইরা দেওনা গো তোমার বাতি? রাধানাথ ওদের কথা শুনে আনন্দিত হয় কিন্তু বাতিগুলো দিতে চায় না। বলে, আমিতো নিজের লাগি বানাইছি।
সে কি কথা ভাই? আমরা তো দাম দিমু। তুমি না হয় নিজের লাগি আরো বানাইও! ’দামের কথা শুনে রাধানাথ ভাবে, মন্দ কী? এতে যদি কেরোসিন তেলের দাম উঠে যায়, তবে তো ভালই হয়। পরে না হয় নিজের জন্য আরো কটা বাতি বানিয়ে নিলেই চলবে। একটা বাতি ঘরের জন্য রেখে বাকীগুলো সে পাড়া পড়শীকে দিয়ে দেয়। আট আনা করে রাখে একটার দাম। বারোটার দাম তিনটাকা পেয়ে সে খুবই খুশি হয়। পরদিন সে আরো বাতি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে চুলায় পুড়িয়ে ঘরের কোনে রেখে দেয়। গ্রামের মহিলারা বাড়ি বয়ে এসে কিনে নিয়ে যায়। ক্রমে এই বাতির কথা আশেপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
সেই থেকে চাষবাসের কাজের পর রাধানাথ সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাতে যখনই সময় পায় কুপিবাতি বানাতে বসে। আস্তে আস্তে তার ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসাথে অনেকগুলো বানানো হলে,সবগুলো বাতি টুকরিতে সাজিয়ে, একটা ভাড়ে করে বয়ে নিয়ে বিক্রি করতে চলে যায় গ্রাম গ্রামান্তরে। যখন জমি চাষবাসের কাজ থাকে না,তখন দুপুরের খাওয়ার পর সে বারান্দায় ছাটাই বিছিয়ে খানিকক্ষণ গড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। পিঠের মস্ত কুঁজের জন্য যদিও গড়াতে সে পারে না, উপুড় হয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করে। বার কয়েক এরকম করতে করতে হয়ত তার মনে পড়ে, সকালে শ’ খানেক বাতি রোদে শুকোতে দিয়েছিল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভালোভাবে শুকিয়ে গেছে। ধড়মড় করে সে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের মাথায় পেয়ারাতলায় গিয়ে বসে। শুকোনো বাতিগুলোকে ঝিনুকের ছুরিতে ঘষে পালিশ করতে করতে ভাবে, রাতেই সবগুলো বাতি আগুনে পোড়ানো শেষ করে কাল সকালে নিয়ে যেতে হবে পাশের গ্রামে। করিমপুরের কয়েকজন বউ সেদিন বায়না দিয়েছিল। শ্রীরামপুর আর মুকুন্দপুরের বউদেরও বেশকিছু বায়না আছে। এখন যেমন এই কাজ আর কাজের ভাবনা নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে তার দিন —
রসরাজ বলে, ‘ব্যবসা যখন ভালা, তাইলে এবার একটা বিয়া করসনা কেনে লো?’
‘কি যে কওগো রসদাদী। রাধানাথ লাজে লাল হয়।’
ওমা লাজের কী আছে লো? মানুষেই তো বিয়া করে।
তাইলে তুমি করলে না কেনে? তুমি বুঝি মানুষ না?
রসরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চমকে ওঠে রাধানাথ। সে হাতের কাজ রেখে রসরাজের মুখের দিকে তাকায়।
রসরাজ মলিন মুখে বলে, ‘কেউ যে দিল না লো!
কেনে দিল না? তোমার বাবড়ি চুল, বড় বড় চউখ। দেখতে কত সুন্দর তুমি! বাড়ি ঘর, জমিজমা এট্টুু নায় কম আছিল, কিন্তু তুমি তো একটা কর্মঠ লোক! সেই তোমারে কেউ মেয়ে দিল না! আমারে কোন বাপে তার মেয়ে দিবগো রস দাদি?
কেনে তুই বা মন্দ কী?
তোমার যে সমস্যা, আমারতো ঐ একই সমস্যা। তার ওপরে আমার পিঠে অত বড়..
হইছে। থাউক। নিজের বদনাম আর নিজের মুখে কওন লাগতো না..
না কইলে কি আর অবস্থা পাল্টাইব গো দাদি? আমরারে লইয়া লোকে হাসে দেখো না!
হাসে হাসুক।
রাধানাথ রসরাজের ব্যাথা বুঝতে পারে। রসরাজের বাবা মা নেই। সেই কবে তারা মারা গেছেন। তার ভাইয়েরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। রসরাজ খুব একা। কিন্তু রসরাজের বাবা-মা কয়েকবার চেষ্টা তো করেছিলেন তার বিয়ে দিতে। কেন যে হলো না!
কেন যে তখন বিয়ে করতে রাজী হয়নি রসরাজ এখন নিজেও তা আর ভেবে পায় না। শুধু মনে পড়ে যখনি লোকজন পাত্র দেখতে আসত, সে বাড়ি থেকে পালাত। লোকজন তাকে পাত্র হিসেবে দেখতে আসছে শুনেই লজ্জায় লাল হয়ে যেত তার শ্যামলা মুখখানা। অনেক পরে কথায় কথায় একজনকে বলে ফেলেছিল সেকথা। শুনে সেজন তাকে হিজড়া বলে গালি দিয়েছিল। কথাটা খুব মনে লেগেছিল তার। আর ঠিক এ পরিস্থিতিতেই পূবের বাড়ির বারীনদা হঠাৎ একদিন তাকে বললেন, ‘পঞ্চাশ বছর খুব বেশি বয়স না রে রসরাজ, চাইলে অখনো তুই বিয়া করতে পারস। যদি রাজী থাকস আমি তোর বিয়া দিমু।’
তারপর রসরাজকে চুপ করে থাকতে দেখে বলেছিলেন- আসলে কি জানস রস, এমন কইরা দিন যায় না। বড় কষ্ট হয় রে। তোর বৌদি নাই দেইখ্যাই না আমি বুঝি- সঙ্গীহীন থাকা কত যন্ত্রণার! শুধু ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চাইয়া আমি আর বিয়া করলাম না। সৎ মা যদি সৎ না হয়, তবে আমার কষ্ট কমলেও যে ছেলেমেয়ের কষ্ট বাড়বো! তাও আমার ত যৌথ সংসার, একলা থাকার যন্ত্রণাও অত বুঝি না,খাওয়া পরা নিয়াও সমস্যা নাই। কিন্তু তোর কথাতো জানি, তোরা অখন ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই হইছস! নিজে রাইন্ধা খাস। খাওন না হয় নিজে রাইন্ধা চলে, মনের কথা কইবার লাগিও তো একজন দরকার নাকি! জানোস, অসুখ বিসুখ হইলে একজন পাশে আছে ভাবলেই আর কষ্ট থাকে না! সেই একজন না থাকলে যে জীবন শুন্য মনে হয়রে! বুকের চরে খালি হাহাকারের ঢেউ বইয়া যায়, তা কি তুই বোঝস না?
হিজড়া গালি শুনে তেতে রয়েছিল রসরাজ। তারপর বারীনদার এমন নরম কথায় সে সকল জড়তা কাটিয়ে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গিয়েছিল। “ঠিক আছে গো বারীনদা, তুমি যখন কইছো আমি রাজী। সত্যি আর একলা থাকন ভালা লাগে না। বুকের মাঝে দুঃখের ঢেউ আমারও উঠে গো বারীনদা! সেই ঢেউরে মাঝে মাঝে থামাইতে পারি না।” রসরাজের কথা শোনে বারীনদা নিজের শশুড়বাড়ির আত্মীয়, খুব গরীব এমন এক পরিবারের মেয়ের জন্য সমন্ধ আনে । গরীব ঘরের কালো মেয়ে শুনে নাকি বছরের পর বছর ধরে সেই মেয়ের সম্বন্ধ এসে ফিরে গেছে। সম্বন্ধের অপেক্ষা করতে করতেই মেয়ের বয়স গেছে বেড়ে। রসরাজ বলেছিল, “তাতে কী? আমারও বয়স হইছে!”
বারীনদা বলেছিল, আমার আত্মীয় বলে না, মেয়েটা সত্যি সত্যি খুব গুণী রে রসরাজ। গিরস্থালি কাজকর্মতো প্রায় সবেই জানে, তাইও জানে কিন্তু গানবাজনা আর নানারকম নকশী কাজেও তাই পাক্কা। দেখিস তোর খুব সুখ হইব কইলাম। সব শুনে, খুব মনে ধরেছিল রসরাজের। আড়াল থেকে সে একদিন বারীনদার আত্মীয়র গ্রামে গিয়ে দূর থেকে দেখেও এসেছিল মেয়েটিকে। কালো হলে কী হবে ,বড় সুশ্রী আর মায়াময় মুখখানা। দেখে রসরাজের মনে যেন রঙ ধরে। শরীরেও অন্যরকম পুলক লাগে।
বারীনদা বিয়ের কথাবার্তা চালায় আর রসরাজ পুকুর পাড়ের বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিজের সীমানায় মেজ ভাইয়ের ঘরের সাথে লাগিয়ে একটা কোটা ঘর আর কোঠাঘরের পেছনে একটা রান্নাঘরও বানায়। রাধানাথ এসে সেখানে চুলা তুলে দেয়। ঘরের মাটির দেয়ালে এঁকে দেয় ফুল পাখীর নকশা। পাটের আঁশে লাল সবুজ রঙ লাগিয়ে রসরাজ শিকা তৈরি করে, কতক রান্নাঘরে আর কতক কোঠাঘরের বেড়ায় টানিয়ে তাতে শিশি বোতল আর মাটির হাঁড়ি দিয়ে সাজায়। কিন্তু হঠাৎ খবর আসে এ বিয়ে হবে না। কারণ কী, তারা শুনেছে রসরাজের হাঁটা, চলন-বলন মেয়েদের মতো,কাজ কর্মও করে সব মেয়েদের। এমনকি তার ভাব ভালোবাসাও নাকি সব মেয়েদের সাথেই। এসব শুনে মেয়ের বাপ মা বলেছে, ‘মেয়ে সারাজীবন আইবুড়ো থাকে থাকুক। তাও বেইট্যা জামাইর কাছে বিয়ে দিতাম না।’ বারীনদা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে বলেছিল, তারা যা শুনেছে, তার সবকথা ঠিক না। কিন্তু সকলেরই ঐ এক কথা – বাইট্টা জামাই তাদের পছন্দ না। আস্তে আস্তে রসরাজের মুখের রং মিইয়ে যায়। সে চুপিচুপি বারীনদাকে বলে, ’এবার ক্ষ্যান্ত দেও বারীনদা। একলা থাকা রসরাজের নিয়তি।’ বারীনদা কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল রসরাজের ঘরের চৌকির এককোণে। রসরাজের ম্রিয়মাণ মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি তার। মাটির দিকে চেয়ে রাগে ক্ষোভে শুধু বলেছিল, ‘হারামজাদারা খালি রসরাজের বেইট্যামি চলা বলা দেখে, কিন্ত রসরাজ যে নিমিষে কুড়ালের কোপে মস্ত একটা গাছ ফালাফালা করত পারে, আর জমিন চাষের কাজও যেমন সুন্দর কইরা পারে তেমন যে পারেনা মরদের মতো চলা বলা ব্যাটারা, তা বুঝি দেখে না?’
কি গো রসদাদী চুপ কইরা কী ভাবতাছো?
রাধানাথের কথায় সম্বিত ফিরে রসরাজের। পুরনো স্মৃতিতে ডুবে গিয়েছিল সে। বলে, না লো, কিছু না। এট্টু পুরানা দিনের কথা মনে পড়ছিল আর কী! কিন্ত আবার ভাবনায় পেয়ে বসে রসরাজকে। সেবার সরকার বাড়ির জমিতে সারাবছর মজুরী খেটে পয়ত্রিশ মণ ধান পেয়েছিল রসরাজ। নতুন ঘরের কোণায় একটা ছোট্ট ভাড়ার বানিয়ে তাতে ধানগুলো এনে পরিপাটি করে রাখার সময় স্বপ্ন দেখেছিল, হাতের শাখার সাথে কাঁচের চুড়ি আর লাল শাড়ী পরা একজন ঘোমটা টানা মানুষ আলতা রাঙা পায় তার ঘর জুড়ে হাঁটবে। ভাড়ার থেকে ধান নামিয়ে রোদে শুকোতে দেবে, তারপর ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাউল করবে আর তার কাজের ছন্দে ঝনঝন করে বাজবে কাঁচের চুড়ি। সেসব কিছুই হলো না। তারপর থেকে রসরাজ সেই নতুন কোঠাঘরে একা একাই থাকে। প্রতিদিন ভাঙা মন নিয়ে সে কোটাঘরের বারান্দার গর্তে ধান ঢেলে চেকাইটের পাড় দিয়ে ধান থেকে চাউল করে। সেই চাউল ধুয়ে হাঁড়িতে চাপিয়ে চুলার আগুনে তুষ ছিটায় । সেই আগুনের উসকানিতে হাঁড়ির ভাত টগবগ করে ফুটে। ফেন উতলায়। রসরাজ আনমনা চেয়ে চেয়ে ফেন উতলানো দেখে। দেখতে দেখতে তার ভেতরেও যেন কিছু উতলায়, অনেক রকমের কষ্ট টগবগ করে। তখন তার আর কিছুই ভালো লাগে না। হঠাৎ হঠাৎ নিজের মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে সেই শৈশব কৈশোরের দিনগুলো । যখন সত্যিকারের ভালবাসা আর মায়ামমতায় ভরা একটা সংসার ছিল। মা-বাবাহীন জীবনে তার নিজের আর সংসার হলো না। অথচ তারা কত চেষ্টাই না করেছিলেন ছেলের বিয়ে দিতে! কেন যে বিয়েটা সে করল না তখন! বড় আক্ষেপ হয় সেসব কথা ভেবে। হাঁড়ির ভেতর টগবগ করে ফুটতে থাকা ভাতের দিকে চেয়ে চেয়ে রসরাজ প্রায়ই পুরনো দিনের কথা ভাবে। সেসবদিনের বোকামির জন্য নিজের প্রতি রাগও হয়। এই একা একা বিষাদময় জীবনের ভার বয়ে বয়ে সে মাঝে মাঝে বড় হাঁপিয়ে ওঠে। দেহে মনে ক্লান্তি ভর করে। একদিন যে রান্নাবাটি করত মহানন্দে সেই রান্না করতেও আর ভালো লাগেনা রসরাজের। রান্নার ঝামেলা এড়াতে ও পেটের ক্ষুধা মেটাতে, সে সরকার বাড়ির ছয়মাসী মজুরের কাজ শেষ হওয়ার পর আবার বাকী ছমাসের জন্য মজুর খাটতে চুক্তিবদ্ধ হয়, যাতে নিজের খাওয়ার জন্য আর ভাবতে না হয়। যদিও এই সময় সরকার বাড়িতে কাজের শেষ নেই। গরু-বাছুরের দেখাশোনা, নৌকায় করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া, বাড়ির পুরুষ যারা ব্যবসা কাজের জন্য সকাল দুপুর বাজারে থাকে তাদের এবং দোকান কর্মচারীদের তিনবেলার খাবার নিয়ে যাওয়া আসা দিনভর চলতেই থাকে। তাও রসরাজ মনে করে এ কাজেই যেন বরং কিছুটা আনন্দ আছে। একের পর এক কাজের নেশায় তবু বিষন্নতা কেটে যায়। অবসর সময়টুকুতে সরকার বাড়ির বউঝিদের খুনসূটি আর গল্পও বেশ লাগে। বিশেষ করে সরকার বাড়ির বড় বউত রসকাকা বলতে অজ্ঞান। তার সব কাজের জন্য রসকাকাকেই চাই। আর বড় যত্ন করে সে রসকাকাকে তিনবেলা খেতে দেয়। এই যত্নটুকুর জন্য সেও তাই বড় বউএর সব কাজ করতে পারে।
বারো মাস মহাজন বাড়িতেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় রসরাজের বাড়িতে এখন আর চুলা জ্বলে না। এখন রসরাজের বারো মাসের মজুরির ধান সরকার বাড়ির ভাড়ারেই জমতে থাকে। বছর শেষে সব ধান বিক্রি করে সেই টাকাও সে রাখে বড় বউ এর কাছে। বড় বউ তাকে নিয়ে হাস্যরস করে- ‘অ কাকা! তোমার অত টাকা কী হইব গো? টাকায় যে গাছ হইব! এর চে ভাতিজা ভাতিজীরে দেও না কিছু!’ এমন কথায় রেগে যায় রসরাজ। বলে, ‘না গো সোনা এমন কথা কইও না।’ তারপর চোখ কুঁচকে মুখ বাাঁকিয়ে বলে, ‘কম খাওয়াইছি না গো! খাওয়াইয়া কী হইলো কও? হাসিও উঠে, দুঃখও লাগে – জানোনি বেটি, আমার খাওনই আমারে দিতে কি না তারা হিসাব নিকাস করে! আমার রোজগার দিয়া তারা নিজেরা তিনবেলা ভালা খাওন খায় আর আমারে দেয় চাছা পোঁচা খাওন।’ পুরনো অপমান অবহেলার কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে রসরাজের। চোখ টলটলে হয়। দুএকফোঁটা পানিও জমে চোখের কোণে। গামছার খুঁটে সেই পানি মুছে বলে, ‘টাকা পয়সা জমাইতাছি গো সোনা ভবিষ্যতের লাগি। যখন তনু তনাই আর চলত না,তখন কে আমারে খাওয়াইব,কে আমারে দেখবো কও? ঠিক করছি- তখন ছোট বোনের ঠাঁই যাইমু। বোন আমারে বড় আদর করেগো। সবসময় খোঁজ খবর নেয়। ভাগিনার বউটাও বড় ভালা। যা জমাইছি সব লইয়া গেলে, মনে হয় আমারে ফালাইত না তারা।’
বড় বউ পরিহাস রেখে রসরাজের কথায় সায় দেয়। ‘ঠিক সিদ্ধান্ত নিসো গো কাকা। একদিন তো সেই কারোর না কারোর কাছে যাওয়া লাগবোই।’ এসময় বাড়ির অন্য বউরা এসেও আলাপ জুড়ে। রসরাজ রান্নাঘরের দরজায় পিঁড়ি পেতে দুহাঁটু জোড় করে বসে গালে হাত দিয়ে তাদের কথা শোনে। খুব ভালো লাগে তার এদের সঙ্গ। মাঝে মাঝে সে নিজেও গল্প করে। বোনের বাড়ির গল্প। ভাই বউদের নিষ্ঠুরতা, সরকার বাড়ির কোন কামলা কাজে ফাঁকি দেয়, দোকানের কোন কর্মচারী চুরি করে এইসব। বাড়ির বউরা তার গালে হাত দিয়ে বলা কথা খুব উপভোগ করে। যেজন্য রসরাজও এদের সাথে কথা বলতে ভারী পছন্দ করে। কিন্তু মাঠের কাজে যখন সহকর্মীরা তার সাথে কথা বলে, সে খেঁকিয়ে ওঠে- ‘কাজের সময় তোরা অত কথা কিয়ের লো? মন দিয়া কাজ কর!’ দোকানে গিয়েও সে কোনো কর্মচারীদের সাথে অকারণ কথা বলে না। কোনো একজন কর্মচারীর হাতে টিফিন ক্যরিয়ার গছিয়ে দিয়েই চলে আসে।
সেদিনও দোকানের কর্মচারী একজনের হাতে টিফিন বাটি দিয়ে ফিরে আসছিল। কিন্তু ম্যানেজার বলল, যেও না,বসো। বুড়া সরকার কর্তা বাড়ি ফিরবেন। অনেকক্ষণ দোকানে বসে থাকতে হয়েছিল তাকে । আর ঠিক সেই সময় প্রথম আলীম উদ্দিনের সাথে তার দেখা। এর আগে লোকটিকে সে কখনও দেখেনি। আলীমউদ্দিনও কিছু সওদাপাতি কিনে চলে যাবে এই সময়ে সে রসরাজকে দেখে। রসরাজও দেখে। দেখে তার মনে হয় আলীম উদ্দিনের চোখ দুটো যেন চোখ নয়; দুটো টলটলে দীঘি। আর পান খাওয়া টুকটুকে লাল ঠোঁটে এমনকি সারা মুখেই লাজের আভা ছড়ানো। তাদের দুজনের চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। এরপর দুজন দুজনকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে। তারা একসাথে নিজেদের ঘরবাড়ি আর নাম ধামের কথা বলে। বলতে বলতে তাদের ভাব হয়ে যায়। তারপর থেকে সম্পর্কটা পৌছালো এমন যে, মাঝে মাঝে সময় পেলে তারা একজন আরেকজনের বাড়ি যায়। আর এই আসা যাওয়া বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। কখনো রসরাজের জন্য জীয়ল মাছ নিয়ে আসে আলীম উদ্দিন আর রসরাজ তার গাছের আম কাঁঠাল নিয়ে যায় আলীম উদ্দিনের বাড়ি।
অনেকদিন পর্যন্ত আলীম উদ্দিনও বিয়ে করতে চায়নি বা পারেনি। তবে মরার আগে তার মা তাকে বিয়েটা করিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বিয়ে করে আলীম উদ্দিন এর খুশি আর ধরে না! বাড়ি বয়ে এসে রসরাজকে সে তার খুশির গল্প শোনায়। তার খুব সখ, বন্ধু রসরাজকে ডেকে নিয়ে একদিন নিজের বউকে দেখায়। কিন্তু রসরাজের সময় হয় না। বিয়ের বছরের মাথায় আলীম উদ্দিনের একটি মেয়েও হয়। বন্ধুকে সেই খবর দিতে তিনমাইল পথ পাড়ি দিয়ে সে রসরাজের বাড়ি আসে। খবর শোনে রসরাজ খুব খুশি হয়। বলে, মেয়ের নাম রাখছো নি?
আলীম উদ্দিন লাজুক মুখে বলে. ‘অখনো রাখা হইছে না। তুমি সুন্দর একটা নাম দেও না বন্ধু ? রসরাজ বলে. ‘তোমরারর মুসলমানি নাম আমি কি জানি?’ আলীম উদ্দিন বলে, ‘নামের অত হিন্দু মুসলমান অখন আর নাই। আমার ভাতিজার নাম বকুল ভাগ্নির নাম মায়া। আমি চাই তুমি আমার মেয়ের নামটা রাখো। তোমার মনে যা চায় তাই দেও।’ হঠাৎ একটা নাম রসরাজের মনে আসে। আগের দিন বাজারে গিয়ে দোকানে কয়েকজনের মুখে শুনেছিল। শেখ মুজিবুরের মেয়ে দেশে আইছে। তার নাম হাসিনা। রসরাজ এর পছন্দ হয়েছিল নামটি। আলীম উদ্দিন দ্বিতীয়বার মেয়ের নাম চাইলে সে বলে, ‘তোমার মেয়ের নাম হাসিনা রাখো। খুব সুন্দর নাম না?’ আলীম উদ্দিনেরও খুব পছন্দ হয় সে নাম। তারপর থেকে যখনই তাদের দেখা হয় আলীম উদ্দিনের মুখে হাসিনা ও হাসিনার মা ছাড়া আর কোনো কথা নাই। শুনে রসরাজ হাসে। আলীম উদ্দিনের খুশি দেখে তার খুব ভালো লাগে আবার নিজেকে খুব দীন দরিদ্র ভেবে নিজের জন্য খুব দুঃখও হয়। কিন্তু কারো কাছে প্রকাশ করে না। রাধানাথের জন্যও তার মায়া হয়। তাই সে চায় রাধার জীবনটা যেন তার মত একাকী আর নিসঙ্গ না হয়। এই যে রাধানাথ এত কিছু করছে, এখন সদানন্দরা ভাই এর জন্য যত মায়াই দেখাক যখন নিজের সংসার সন্তান হবে আর পুঁছবে না। কিন্তু রাধানাথকে এখন সে কথা বললে তো রাগ করবে। মনের কথা সে তাই মনে রেখে দিয়ে চাইছে বোকা ছেলেটা সংসারী হোক।
রাধনাথ বলে, ‘যত সহজে কইলায় হাসে হাসুক, আসলে বিয়া করা কি অত সোজা গো রসদাদি?’
রাধানাথের কথা শুনে রসরাজ বাস্তবে ফিরে। বলে, ‘না, অত সোজা না। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না লো রাধা! আমি তোর বিয়ার সমন্ধ আনমু দেখিস।’
‘তাইলে তুমি এর লাগিই আইছ কও? বেড়াইতে আওন একটা বাহানা? রাধানাথ হাসে। কিন্তু তোমার কোন সমুন্ধির বোন আমারে বিয়া করবো কও শুনি?’
রসরাজ হেসে বলে, ‘আমার সমুন্ধি আছে নি যে, তার বোন তোরে বিয়া করবো! তোর সমুন্ধির বোনেই তোরে বিয়া করবোনে কইলাম দেখিস।’ রসরাজের বলার ঢঙে রাধানাথও হাসে। তারপর দুজনে অনেকক্ষণ ধরে হা হা করে হাসতেই থাকে। হাসি শেষ হলে রসরাজ বলে, ‘কি লো, বেড়াইতে আইলাম, বিয়ার সমন্ধ আনমু কইলাম; তাও তামুক খাওয়াইতে না?’
‘আরে বাবা সবুর করো। তামুক আইতাছে।’
‘আইতাছে? ’ রসরাজ অবাক হয়ে দেখে, রাধানাথের ভাই সদানন্দ তার সামনে নারকেলের হুক্কা হাতে দাাঁড়িয়ে আছে। সে খুশি হয়। হাত বাড়িয়ে হুক্কা নিয়ে নারকেলের ছিদ্রে মুখ লাগিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে আয়েশ করে ধোয়া ছেড়ে বলে, ‘তোর ভাই বোনেরা খুব ভালা রে! কেমন কথার আগে কাম করে।’
ভ্ইাবোনের প্রশংসায় গর্ববোধ করে রাধানাথ। নিজেকে সার্থক মনে হয়। বাবাহীন সংসারে সে যেমন তাদের আগলে রেখেছে ওরাও তার জন্য নিজেদের উজাড় করে দেয়।
‘অয়গো দাদা কথা ঠিক কইছো। তবে সামনাসামনি অত প্রশংসাও কইরো না। মাথা বিগড়াই যাইবো। আমারে তারা খুব মায়া করে। এই যে কুপিবাতি তৈরির কাজ করি. লোকের কাছে সোজা মনে হইতো পারে কিন্তু ঝামেলা কম না গো! তবে যত ঝামেলা হউক অখন আমার কামটারে এরাই সোজা কইরা দিসে। জানো রসদাদী, সদানন্দ অখন জমিতে গিয়া মাটি আনার কাম করে। বোন দুইটা মাটি ছেনে মন্ড তৈরি করে। অবশ্য বাকী সব কাজ আমার। তা আমার কথা অখন বাদ। তোমার কথা কও দাদা।’
রসরাজ আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হুক্কায় আর একটা লম্বা টান দেয়। একগাল ধোয়া ছেড়ে বলে, ‘আমার আর কী কথা লো? কাজকাম করি, খাই আর ঘুমাই। অখন তোর সাথে দেখা করতে আইলাম।’
‘নিজের জমি চাষ করবায়? আশ্বিন মাসতো শেষ প্রায়!’
‘করন তো লাগবোই। কিন্তু আমার আর কতটুক জমি? এইটুক জমি করতে আর কী লাগে? না সময়, না পরিশ্রম! বাকী সময় কাটবো কেমনে? আর অখন রোজ রোজ রান্ধন বাড়নও ভালা লাগে না লো। তাও একলার খাওনের লাগিও রান্ধনত লাগেই। তার লাগি মহাজন বাড়িতেই সারাবছরের লাগি অখন কামে থাকি। রান্ধাবাড়ার আর কোনো ঝামেলা নাই লো। তারা যা দিবো খাইমু।’ বলতে বলতে শেষবারের মতো একটা সুখটান দিয়ে হুক্কাটা নামিয়ে রাখে রসরাজ।
ভালা করছো দাদা। ই বয়সে আর কত হাত পুড়াইবায়?
কিন্তু আর একটা ভালা কাম আমার করন লাগে যে লো রাধা!
কী ভালা কাম গো?
ঐ যে তোর বিয়ার কথা কইলাম না? ধইরা নে একরকম ঠিক হই গেছে। খালি তোর মার সাথে কথা কওন লাগবো। তার আগে ক তুই রাজী কিনা?’ রাধানাথের মুখ লাল হয়। মনে মনে সেও তাই চায়। অখন একজন মনের মানুষ সত্যি দরকার। কিন্তু দুশ্চিন্তা হয় তার কুঁজ নিয়ে। কুঁজো লোকের কাছে কে তার মেয়েকে বিয়ে দেবে? তারপর রসরাজের কথা শুনে আর একটা সংশয়ও তার মনে উঁকি মারে – লোকেতো তাকেও বেইট্যা ব্যাটা বলে। সে মায়ের কষ্ট কমাতে ঘরবাড়ির বারান্দা লেপে মুছে দেয়। ধান ভানতে ঢেঁকিতে পাড় দেয়, রান্নাবাড়া জানে বলে মায়ের জ্বরজারি হলে মা আর ভাইবোনকে রেধে বেড়ে খাওয়ায়, বাসন কোসন মাজে, সেজন্য নারী পুরুষ সকলেই হাসাহাসি করে। কেউ আড়ালে,কেউ সামনে। রাধানাথ ভেবে পায় না, কাজের কেন আবার নারী পুরুষ থাকবে! এই যে সে সকল কাজ করতে পারে, সেজন্যইতো মায়ের অসুখ বিসুখ হলে আর অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হয় না। ছোট বোনগুলোকে আছড়ি পিছড়ি খেয়ে হাত পুড়িয়ে রান্না যে করতে হয় না। তারজন্যত মানুষ তাকে প্রশংসা করতে পারত! সে ভাবে, যদি নারীর কাজ আর পুরুষের কাজ বলে কিছু না থাকত তবে কত সুবিধা হতো! যেমন তার ছোটবেলায় যখন বাবা মারা গেল তখন চাষ করার লোকের অভাবে তাদের জমিটুকু পতিত পড়ে রইল। অথচ তার মা তখন অনেক জোয়ান ছিল, চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই হাল চাষ করতে পারত মা। করে নি নিয়ম নেই বলে। সমাজের লোক ছি ছি করত বলে। যেমন তাদের গ্রামের ময়নার মার বর নেই। ছেলেটা ছোট। পরিবারে রোজগেরে পুরুষ নাই বলে বাজার থেকে এক টিন কেরোসিন কিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে । সংসারের বাজার সদাই করে। আবার কামলার পয়সা দিতে পারেনা বলে ঘরের বেড়া বান্ধা, ছন কেটে চালের ছাউনি দেওয়ার কাজ নিজেই করে নেয় দেখে সবাই হাসাহাসি করে! একজন মহিলা মানুষ পুরুষের মত কাজকর্ম করে এজন্য সমাজ তাকে পছন্দ করে না। অথচ ময়নার মা না খেয়ে থাকলে কেউ খেতে দেবে না। তার ঘর বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেলে কেউ আশ্রয়ও দেবে না। তাহলে নিন্দা করবে কেন? সে যদি চুরি করত,বদমাইশি করত তবে না হয় নিন্দা করত ! কিন্তু সে নিজের কাজ নিজে করে বেঁচে আছে, তাতে অন্যের এত সমস্যা কেন ? রাধানাথ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না।
রাধানাথ যখন কারো সাথে কথা বলে, পিঁড়ি পেতে দুই পা মুড়ে বসে, গালে হাত দিয়ে থুথনি নাড়িয়ে কথা বলে। আর অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলতে গেলে লাজে রাঙা হয়ে যায় তার মুখ। তাই দেখে নারী পুরুষ সকলেই যে তাকে নিয়ে হাসে এসব কথা সে বিলক্ষণ জানে। তার ভাবনা হয় বিয়ের আলাপ এলে পিঠের কুঁজের সাথে বেইট্যামি নিয়েও যদি মানুষ প্রশ্ন তোলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে ? প্রত্যাখানের কষ্ট কেমন হয় তার জানা ছিল না। রসদাদীর কথা শুনে কিছুটা অনুভব করছে এখন সে। তবে বিপরীতে আশাবাদের গল্পও তো সামনে আছে। আলীম ভাই এর ত এখন সুখের সংসার। আলীম ভাইকে রাধানাথ চিনত না। রসদাদীই একদিন নিয়ে এসেছিল তাকে রাধানাথের বাড়িতে। রসদাদীর মুখে আব্দুল আলীমের গল্প শুনতে শুনতে তার খুব ইচ্ছে জেগেছিল আলীম উদ্দিনকে দেখতে। রসরাজ তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আলীমের বাড়ি। কিন্তু রাধানাথের অত সময় কোথায়? সে কাজের মানুষ। সারা সময় কাজ আর কাজ। এতদূরে গেলে তার কাজের সময় নষ্ট হয় ভেবে রসরাজ একদিন আলীমকেই নিয়ে আসে তার বাড়ি। সেই আলীম ভাইও কথা বলতে গেলে লাজে রাঙা হয়। তার নাদুস নুদুস শরীর তাও চলার সময় কোমর না দুলিয়ে হাঁটতে পারে না। রসদাদী আর তার মতো আব্দুল আলীমও গালে হাত দিয়ে কথা বলে। পুরুষ মানুষদের চেয়ে যেকোনো বয়সী নারীদের সাথে তারা কথা বলতে সাচ্ছন্দবোধ করে। কিন্তু তাতে সমস্যাটা কোথায় হয়? রাধানাথ ভেবে পায় না। সে ভাবে সংসারে নারী ছাড়া কোনো পুরুষ কী চলতে পারে? তবে কোনো পুরুষের ভাবভঙ্গি যদি নারীর মত হয়ই অন্যদের সমস্যাটা কী? এদিকে তার মা বাপ আবার তার নাম রেখেছে রাধানাথ। লোকে নাম জিজ্ঞেস করলে চিরকাল সে তার পুরো নাম রাধানাথ দাস বলে। কিন্তু তাও সবাই তাকে রাধা রাধা বলেই ডাকে। সেটা নিয়েও কেউ কেউ মশকরা করে। বলে বাহ্, তুমি ত ভাই নামেও নারী, কামেও নারী! আর দক্ষিণ ঘরের রসিকা বৌদিত দেখলেই বলবে ও রাধারানী তোমার কৃষ্ণ বুঝি আইলো না গো?
রাধানাথ বিয়ে করতে চায়। ধানখেতের পরিমাণ বেড়েছে বলে এখন তার ঘরে আর ভাত কাপড়ের অভাব নেই। কুপিবাতির ব্যবসা তাকে একপ্রকার স্বচ্ছলতা দিয়েছে। এখন নিশ্চিন্ত মনে সে একটা বিয়ে করতেই পারে। এই নিশ্চয়তার কারণেই রসরাজ বলে গেছে, সে রাধানাথের জন্য কন্যা দেখবে। সেদিন এ বিষয়েই আলাপ করার সময় আলীম উদ্দিন বলে, ‘লও এক জাগাত যাই!’ বাঁশের আলনা থেকে ফতুয়া নিয়ে গায়ে দিতে গেলে হাসিনার মা বলে, ‘দাদা মাত্র আইছইন,একখান পানও না, একসিলিম তামুকও না খাওয়াইয়া কই লইয়া যাও?’
আলীম উদ্দিন বলে, তুমি পান তামুক সাজাইয়া রাখো। আইয়া পান খাওন যাইব নে। রসরাজ আলীম উদ্দিনকে অনুসরন করে হাঁটতে থাকে। আলীম উদ্দিন নিজের বাড়ি ছাড়িয়ে আরো কয়েকটি বাড়ি ছাড়িয়ে একটা শুকনো খালের ওপরের সাঁকো পেরিয়ে গ্রামের উত্তর পাড়ার একটি বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের দরজা বরাবর মুখ করে সে ডাকে, ও বৌদি! বাড়িত আছোনি গো?
ডাক শুনে একজন বিধবা বুড়ি বেরিয়ে আসে । আলীম উদ্দিনকে দেখে সে হাসে। অ! আলীম ভাই? আইও। বও। বলে সে ঘর থেকে দুটো জলচৌকি এনে বারান্দায় পেতে দেয়। আবার বসার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলে, সাথে যারে আনছো, তারে তো চিনলামনাগো আলীম ভাই–
অ! তাইনা? তাইন আমার বন্ধু রসরাজ দাদা। বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে হাসিতে মুখ প্রসারিত হয় আলীম উদ্দিনের। বলে, মৌটুপি গ্রামে তারার বাড়ি। তোমার বাড়ি নিয়া আইলাম পরিচয় করাইবার লাইগ্যা।
খুব ভালো করছ ভাই।
আলীম উদ্দিন বলে, আমার ভাতিজি কই বউদি?
ঘরোই আছে ভাই। তাইর কাছে কি কোনও দরকার আছে?
না, না বৌদি। এমনেই। অনেকদিন দেখিনা তো। ভাবলাম মামার বাড়ি গেল কি না-
‘আর মামার বাড়ি!’ বুড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ‘গরীব হইলে কেউ জিগায়নাগো আলীম ভাই। আইচ্ছা পান খাইবায় তো? বুড়ি তার মেয়েকে ডেকে একটু পান সুপারি দিতে বলে। বলে, ‘আমার ঘরে তো তামুকের ব্যবস্থা নাই রে ভাই! বন্ধুরে সাথে নিয়া আইছো, একটু পানই খাও।’ মায়ের কথায় মেয়েটি একটা পানথালিতে করে পানসুপারি এনে দেয়। আলীম উদ্দিনকে দেখে সেও খুশি হয়। সে হাসিনা ও হাসিনার মায়ের খোঁজ খবর নেয়। আলীম উদ্দিন তার জবাব দিতে গিয়ে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করে যাতে রসরাজ মেয়েটিকে যাচাই করতে পারে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে আলীম উদ্দিন বলে রসদাদী তোমার রাধাকান্ত ভাইয়ের লাইগ্যা কি ই কন্যা চলব মনে করো?
খুব চলব।
এরপর একদিন সুযোগ বুঝে আলীম উদ্দিন বুড়ির মেয়ের সাথে রাধানাথের বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করে। রাধানাথের আয় রোজগার ও পরিবারের বিবরণ দিতে গিয়ে এমনকি তার পিঠে কুঁজ, পুরুষালি কাজের পাশাপাশি মেয়েলি কাজও যে করতে পারে সেসবের কোনও কিছু গোপন করে না সে।
প্রস্তাব পেয়ে বুড়ি একদিন আলীম উদ্দিনের সাথে রাধানাথের বাড়ি যায়। সবকিছু দেখে শোনে, হিসাব নিকাশ করে বুড়ি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী হয়। রাধানাথের বেইট্যা স্বভাব, পিঠের কুঁজ কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই তার। রাধানাথের বা তার মায়েরও আপত্তি নেই গরীব আর বিধবা বুড়ির কালো মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করতে। শেষপর্যন্ত একটা ভাল দিন ক্ষণ দেখে আলীম উদ্দিনের গ্রামের বুড়ির মেয়েটার সাথে রাধানাথের বিয়েটা হয়েই গেল। কিন্তু পাড়া পড়শীরা রাধানাথের বউকে দেখে আড়ালে আবডালে হাসে। বউটা সুন্দরী তো নয়ই দেখতেও ঠিক ভালো নয়। তার গায়ের রং কালো, উঁচু দাঁত, বোঁচা নাক। কিন্তু রাধানাথের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে যখন তার বউ এর হাসিমুখের দিকে তাকায় তখন তার মনে হয় দুনিয়ার সকল সুন্দর ঐ হাসিতেই লেগে আছে। ঐ হাসিতে তার আশেপাশের সব কদর্যতা সব গ্লানি যেন মুছে যায়। সে মনে মনে বলে, বউয়ের মুখের এই হাসি ধরে রাখার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। তবে তার বউ তেমন কিছুই চায় না। বিয়ের চারদিনের দিন যে চতুর্থ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হয় তার অনেক নিয়ম কানুনের একটি হলো যাকে বলে পাশা খেলা। এই পাশা খেলায় বর বউ এর বন্ধু স্থানীয়রা বর কনেকে দিয়ে খেলাটা খেলায়। সে খেলায় বর হেরে গেলে বউকে তার চাহিদা মত উপহার দিতে হয়। রাধানাথ হেরে গিয়েছিল সে খেলায়। বউ এর সঙ্গীনীরা চেপে ধরেছিল বউকে কিছু চাইতে আর বরকে সেটা দিতে। শেষ পর্যন্ত বউ প্রতিমা একটা নাকের সোনার এস চেয়েছিল। মেয়েদের নাকে পরার জন্য ইংরেজি এস অক্ষরের আকৃতির ছোট্ট একটি সোনার অলংকার হলো এই নাকের এস। দুতিন রতি সোনা হলেই ভালো এস তৈরি হয়। তখন খুব চলছিল নাকের এস। প্রায় সব মেয়েরাই সখ থাকে একটা সোনার নাকের এসের জন্য। প্রতিমারও ছিল। কিন্তু তার অভাবী বুড়ি মায়ের পক্ষে সেই সখ পুরণ করা সম্ভব ছিল না। তাই সে কখনো সেই সখের কথা উচ্চারণও করেনি। পাশা খেলায় জিতে কিছু চাওয়ার সুযোগ পেলে নাকের এসের কথাই তার মুখে আসে। রাধানাথ রাজী হয়েছিল সানন্দে। পরদিন বাজারে গিয়ে রতন পোদ্দারের দোকানে নাকের এসের অর্ডার দিয়ে জায়গায় বসে সেটা গড়িয়ে নিয়ে তবে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিল রাধানাথ। প্রতিমার হাতে সেটা তুলে দিয়ে তার খুব ভালো লাগে। তবে সন্ধ্যায় প্রতিমার মুখের উজ্ঝ¦ল হাসিটুকু সে দেখতে পায়নি। রাতে নাকের এস কেমন হয়েছে দেখার ছলে নিজের হাতে গড়া কুপিবাতির আলোয় অনেকক্ষণ ধরে প্রাণ ভরে সে প্রতিমার হাসিমুখ দেখেছিল। তারপর বছর না ঘুরতে কুপিবাতির ব্যবসা এমন রমরমা হলো যে, সে বাতি বানিয়ে কুলাতে পারেনা। সেই বাতি বিক্রির টাকায় দুই কিয়ার ধানের জমি কিনে রাধানাথ। বছরের মাথায় একটা ছেলেও জন্ম নিল তার ঘরে। তখন পাড়াপড়শী সবাই ঈর্ষায় জ¦লে পুড়ে চাপা স্বরে বলে, দেখছোনি গো কুঁজা রাধার কী কপাল! সবই তার ঐ বোঁচা নাকী বউ এর পয় গো! এমন পরিস্থিতিতে আনন্দে উদ্বেল রাধানাথ বউ এর জন্য সোনার কানপাশা গড়ানোর কথা বলে। প্রতিমাও খুশিতে আটখানা হয়। কিন্তু সে বলে যে, তার কোনো সোনার গয়নার দরকার নাই বরং ঐ টাকা দিয়ে জমি বন্ধক রাখলে সোনার ধানে ঘর ভরে যাবে। রাধার বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলে, এখন সোনার গয়না নয় জমি বাড়ানো দরকার। জমি হলে পরে সোনার গয়না কেনা যাবে। এমন কথা শোনে নিজের বউ এর সাথে সাথে রসরাজ ও আলীম উদ্দিনের প্রতিও সর্বদা কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকে তার মন। একদিন সে নিজের বাড়িতে রসরাজ আর আলীম উদ্দিনকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। নানারকম ভাজা বড়া,ডাল, পাঁঠার মাংস, রুই মাছ, দই আর মিস্টান্ন খেয়ে আলীম উদ্দিন খুব খুশি হয়। কিন্তু রসরাজ খাবার খেয়ে প্রশংসা করলেও তার মনের ভেতর কেমন যেন করে। হঠাৎ তার মনে হয়, যদি বারীনদার শ্যালিকার সাথে তার বিয়েটা হতো তবে তারও এমন একটা সংসার থাকত। হয়ত তারও একটা ছেলেপুলে হতো এতদিনে। সে মেয়ে বা ছেলে যে ই হোক তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকত তারা। যেমন থাকে আলীম উদ্দিনের মেয়ে হাছিনা। যেমন আর কদিন পর অপেক্ষা করবে রাধানাথের ছেলে রাজন। আর ছেলেপুলে না হলেও সেই মেয়েটাত অপেক্ষা করে থাকত! শ্যামলা রঙ আর সুশ্রী মুখের মেয়েটির পান খেয়ে ঠোঁট লাল করার জন্য বাজার থেকে সে এনে দিত বাংলা পান, ঠাটি সুপারি আর জর্দা। বাজারে গেলে মেয়েটি তাকে বলে দিত – পান জর্দা কুনু লাগব। সে আরও ভাবে এই রাধানাথের মত সেও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর ছলে তার সুখের সংসার দেখাত। এখন রাধানাথের সংসারের সুখ দেখে তার একদিকে যেমন ভালো লাগছে, আবার কেমন যেন কিছুটা ঈর্ষাও হচ্ছে। ঈর্ষার কথা মনে আসতেই সে জিভ কাটে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। বলে তুমিইত রাধানাথের জীবনের এই সুখ চেয়েছিলে রসরাজ! আজ তবে হিংসা করছো কেন? তোমার জন্য, আলীম উদ্দিনের জন্যই আজ রাধানাথের এই সুখের সংসার। তোমার তো গর্ব করা উচিত। তোমার কপাল মন্দ, নাহলে তো বারীনদাও তোমার জন্য কম চেষ্টা করেনি। তা কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?
তবে এত ধমকিয়েও মনকে বশে আনতে পারেনি রসরাজ। সে আলীমউদ্দিনকে রাধানাথের বাড়িতে রেখেই কাউকে কিছু না বলে চলে আসে। বড় আনমনা আর বিষন্নমনে নিজের বাড়ির পথ ধরে সে হাঁটতে থাকে। কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি যে, নিজের বাড়িতেই তার জন্য একটা মস্তÍ বড় চমক অপেক্ষা করে আছে। বাড়িতে ঢুকে সে দেখে কি, তার বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে যেন কেউ একজন বসে আছে। তার পরনে একটা নীল শাড়ী। পেছন থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না বলে বুঝতে পারছে না কে ওখানে বসে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে তার বারান্দায় উঠে মাথা নিচু করে মুখখানা দেখে। নারীটি অবিবাহিত। কারণ তার সাজসজ্জায় বিবাহের কোনো চিহ্ণ নেই। সে তরুণী নয় আবার মধ্যবয়সীও নয়। তার মনে হলো এই নারী তার চেনা নয়। তবে কোনোকালে দেখেছিল কিনা মনে করতে চেষ্টা করে। তাতে যার কথা মনে আসে সেটা তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে অবাক হয়ে আগন্তক নারীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এই অপলক দৃষ্টির বিহ্বলতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে চোখ মুখ নত করে সেই নারী।
রসরাজের বিহ্বলতা কাটে না। সে ভাবে, এই নারী সত্যি কি সেই নারী? আর যদি সেই নারী হয় তবে কেনই বা সে এভাবে তার বারান্দায় এসে বসে আছে? ভেবে পায় না রসরাজ। তবে সহসাই তাকে উদ্ধার করতে সেখানে এসে দাঁড়ায় উত্তর পাড়ার ময়নার মা। ময়নার মা এতক্ষণ রসরাজের বাড়ির মানুষের কৌতুহল দমন করতে মেয়েটিকে তার নিজের বাপের বাড়ীর পড়শী বলে পরিচয় দিয়েছে। বলেছে তাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার আছে তবে তার আগে রসরাজের কাছে একটা দরকার, তাই অপেক্ষা করছে। ময়নার মা বলে, ই বেটি আমার এক মাসী গো রসকাকা। আমার লগে আইছে। অনেক কথা আছে। কিন্তু আগে তোমার ঘরের দুয়ারটা খোলো,ঘরে ঢুকতে কইবায় না?
একটাও কথা না বলে রসরাজ কোমর থেকে চাবি বের করে দরজার তালা খোলে ময়নার মাকে ঘরে ঢুকতে ইশারা করে। ময়নার মা আগন্তক নারীকে নিয়ে রসরাজের পেতে দেয়া পিঁড়িতে বসে। রসরাজ তার চৌকির বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চেয়ে দেখে আর ভাবে একদিন এই ঘর তার জন্য অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সে আসেনি। অথচ আজ সেইতো অনাহুত হয়ে আসতে হলো ! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রসরাজের বুকের গভীর থেকে। সে ভেবে পায় না কেন ময়নার মা তাকে নিয়ে এখানে এসেছে।
ময়নার মা ইতস্তুত করতে করতে একটু ভূমিকা করে। বলে রসকাকাগো একটা কথা কই,কিচ্ছু মনে কইরো না। আসলে ভাগ্য কারে যে কই লইয়া যায় কেউ কইতে পারে নাগো। তুমি মনে কয় আমার এই মাসীটারে চিনতে পারছ না, না? শোনো রসকাকা, একদিন আমার এই মাসীটারই তোমার ঘরের বউ হইবার কথা আছিলগো! কিন্তু তার বাপ ভাই তখন খুব চাপা মারছিল- যে সারা জীবন মেয়েটারে আইবুড়া কইরা রাখবো, ঘরে বওয়াইয়া খাওয়াইবো! কিন্তু জানো অখন না সব জারী জুরি শেষ! একবছর আগে চাপাবাজ বাপটা মারা গেছে। কিন্তু এরই মাঝে বাপের সংসার থাকি আমার মাসীর রিজিক উঠি গেছেগো কাকা! ভাই, ভাইবউ তারে সারাদিন খাটাইয়া মারে কিন্তু সবদিন একচিমটি পানিভাতও জুটে না। তাও ধুর ধুর করে। রসকাকা এই মাসীটা সত্যি আমার মাসী লাগে। আমার মায়ের দুরসম্পর্কের লতায় পাতায় বোন হইলেও সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট আছিল। কয়দিন আগে আমার বাপের বাড়ি গেছলাম। পাড়াপড়শীর কাছে বেটির সব দূর্দশার কথা শুনলাম। আরোও শুনলাম কয়েকবছর আগে তোমার লগে তার বিয়া ঠিক হইয়াও ভাইঙা গেছিল। মনে পড়ল তুমিত অখনও একলাই আছো। মাসীর কষ্ট সহ্য করতে না পাইরা তারে আমার লগে লইয়া আইছি তোমার লগে মিলাইয়া দেওয়ার লাগি। যদি অখন তুমি আমার মাসীরে নিজের কইরা নেওগো রসকাকা,আমি সারাজীবন তোমার কাছে বান্ধা থাকমু। ময়নার মা যেন মিনতি করে।
ময়নার মায়ের কথা শুনে রসরাজ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। তার মনে হয় এখন বারীনদা থাকলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আজ সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেওত আর বারীনদাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হঠাৎ রসরাজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সে বলে, ‘ময়নার মা গো তোমারে কেমন করে কথাটা কই বুঝতে পারতাছি না।’
ময়নার মার সাথে সেই আগন্তক নারীও উৎকর্ণ হয়ে থাকে রসরাজ কী বলে সেটা শোনার জন্য।
কওনা গো রসকাকা। কী কইবায় কও।
কোনো কিছু না ভেবেই রসরাজ বলে, ‘ময়নার মাগো, তোমার মাসীর দুঃখের কথায় আমারও অনেক কষ্ট লাগতাছে। কিন্তু তুমি যা কইতাছ তা আর সম্ভব না গো মা! জানোইত আমার দিন শেষ। তা অতটা দিন যেমন কইরা পার হই গেল বাকী দিনও এমনেই যাইব। এরলাগি অখন আর নতুন কইরা কিচ্ছু ভাবার সাহস ও নাই ধৈর্য্যও আমার নাই গো মা। তোমরা মনে কিছু
রসরাজের কথা শুনে ময়নার মা মর্মাহত হয়। কিন্তু রসরাজ থামে না। মুখচোরা রসরাজকে যেন আজ কথায় পেয়েছে। বলে, ‘আর একটা কথা কই গো ময়নার মা, জানোনি সবকিছুর মুলে থাকে মানুষের মন! একদিন যে আশা লইয়া আমার মাটির ঘরের সাথে সাথে আমার মনের ঘরটারেও সাজাইছিলাম সেই মন কি আর আমার মনের মাঝে আছে গো? নাই। অনেকদিন আগে সেই মন আমার হারাই গেছে গো ময়নার মা। তারে আর পাওয়া যাইত না । তে মনই যদি না থাকে সবকিছুইত মিছা। কি কও?’
ময়নার মা বলে, ‘বড় আশা নিয়া আমার মাসীরে লইয়া তোমার কাছে আইছিলাম গো কাকা। নিষ্ঠুরের মত ফিরাইয়া দিলায়? কাকাগো, কবে থাইকা তুমি অত নিষ্ঠুর হইলায়?’
রসরাজ কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু সে মনে মনে অনেককিছু ভাবে। সত্যি কি তার বলা কথাগুলো নিষ্ঠুরের মতো হলো? কিন্তু ময়নার মায়ের প্রস্তাব কি সত্যি আর গ্রহণ করা যায়? সংসার ও সংগীর আকাঙ্খা করে সে যথেষ্ট অপমানিত ও আহত হয়েছে। সেই যন্ত্রণার ঘা তার আজও শুকায়নি। এইতো কিছুক্ষণ আগেও সে তার সেই বিয়ে ভাঙার কষ্টে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল আর এখন কিনা সেই মেয়ে তার সামনে এসে বলছে, তার কোনো সহায় নাই! সব শুনে রসরাজের সত্যি খুব কষ্ট লেগেছে, তাই বলে কি এখন তারে ঘরেও জায়গা দিতে হবে? সে কিছু বুঝতে পারে না। নিজের কাছে নিজেকে বেশ নিষ্ঠুরই লাগে। কারন কোনো অসহায় মানুষ কারো কাছে আশ্রয় চাইলে আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও সেটা না দিলে অবশ্যই নিষ্ঠুরতা হয়। কিন্তু একদিন সেওত একজনের মনের ঘরে আশ্রয় নিতেই চেয়েছিল! কিন্তু সে তা পায়নি বা তাকে পেতে দেয়া হয়নি। তবে রসরাজ নিজের বিপক্ষে গিয়ে বলে, হয়তো তার জন্য আজকের এই আশ্রয়প্রার্থী নারী দায়ী নয়। তার বাপ ভাই দায়ী ছিল। তবু কষ্ট ত পেয়েছিল সে নিজেই। আর কিছু ভাবতে পারে না রসরাজ। তার মনে আর কোনোই আগ্রহ উদ্দীপনা কাজ করে না। সে মনে করে, ময়নার মাকে সে যে কথা বলেছে, এটাই তার মনের কথা। এরপরে আর কোনো কথা থাকতে নেই। সে চৌকি থেকে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে পানের ডিব্বা এনে বলে, ‘ময়নার মা, পান খাও।’ ময়নার মা ডিব্বা থেকে বের করে একখিলি পান মুখে দেয়। তার মাসী পান খায় না। পানের রস গিলতে গিলতে ময়নার মা বলে, ‘রসকাকা বিষয়টা আরেকবার বিবেচনা কইরা দেইখোগো। আজকে উঠলাম, চলগো মাসী, আমরা অখন যাই বলে সে উঠে দাঁড়ায়।
পরদিন সকালে রাধানাথ আসে রসরাজের বাড়ি। বলে রসদাদী, ‘কামটা তুমি ঠিক করলায় না। মানছি একদিন তারা তোমারে অপমান করছে কিন্তু তার জন্য কি কমলা রানীর কোনো দোষ আছিল? আমরার দেশের মেয়েরা কী নিজের বিয়ার কথা নিজের মুখে কোনোদিন কইছে কও? কমলা রানী খুব অসহায় গো। নাইলে কি কোনো মেয়েমানুষ একটা বিয়ার লাগি এইভাবে একজন পুরুষ মানুষের ঘরে আইয়া উপস্থিত হয়?
রসরাজ রাধানাথের কথা শুনে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। বলে দেখ লো রাধা, আমারে তরা আর অনুরোধ করিস না। আমার বয়স ষাইট বছর হইছে। অখন আর রঙ ঢঙ করার সময় নাই। আমারে নিয়া অনেক লোকহাসানি হইছে। আর না। কিন্তু তরে আমার কাছে কে পাঠাইছে?
রাধানাথ হাসে। বলে, ‘কে পাঠাইছে তুমি জানো। ময়নার মা ছাড়া আর কে পাঠাইব? কিন্তু কে পাঠাইছে বড় কথা না। বড় কথা তোমার রাজী হওয়া।’
রসরাজ রাধানাথের কাঁধে হাত রাখে। বলে সত্যিরে রাধা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার মনের জোর এট্টুও নাই। তোরা আমারে আর জোর করিস না ভাই।
রাধানাথ বলে,‘ঠিক আছে তুমি না রাজী না হইলে কী করা যাইব? কিন্তু অত কষ্ট কইরা তোমার বিয়ার কথার লাগি আইলাম এট্টু পান খাওয়াও।’ পানের ডিব্বা বিছানাতেই ছিল। রসরাজ রাধানাথকে ডিব্বাটা বাড়িয়ে দেয়। পান খেয়ে রাধানাথ সরকার বাড়ির দিকে যায়। সে জানে সরকার বাড়ির বড় বৌদির কথা রসরাজ অমান্য করবে না। সে বড়বৌদির কাছে সব কিছু জানায় । বলে একমাত্র তোমার কথা রাখতে পারে রসদাদা।
সন্ধ্যার পরে রসরাজ যখন রাতের খাবার খেতে সরকার বাড়ি আসে,বড়বউ বলে, তুমি আর না কইরোনা গো রসকাকা। সাধা লক্ষী পায়ে ঠেলা ঠিক না। দেখো নিয়তিরে খন্ডাইবার সাধ্য কারোর নাই। সেই দেখো অতবছর পর ঠিক তোমার দুয়ারেইত বেটির আইতে হইল ! তুমি না করবার কে? শোনো, তুমি খালি কও যে তুমি রাজি , দেইখ্যো আর তোমার কিচ্ছু করণ লাগত না। সব দায়িত্ব আমরা নিলাম।
রসরাজ তাও গাইগুই করে। বড়বউ বলে, দেখো রসকাকা অখন কিন্তু সবাই মনে করবো তুমি সত্যি সত্যি হিজড়া। বলতে বলতে হেসে ওঠে বড়বউ। রসরাজ বলে, সে তারা যা মনে করে করুক। হিজড়া কইলে হিজড়াই সই। অসুবিধা কি? হিজড়া ত মানুষই নাকি? নারী পুরুষ যেমন মানুষ হিজড়াও তেমন।
বড় বউ বলে,তোমার সবকথা ঠিক। তবু তুমি আমরার মুখ চাইয়া বিয়াটা করো!
বড় বউ এমন মায়াবী স্বরে কথাগুলো বলে যে তার কথার পরে আর কোনো কথা বলতে পারে না রসরাজ। শেষপর্যন্ত রাজী তাকে হতেই হয়। খুশিতে আটখানা হয়ে রাধানাথ আলীম উদ্দিনকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বিলের একটা বড় রুই মাছ আর নিজের ঘরের একজোড়া হাঁস নিয়ে আসে আলীম উদ্দিন। সেদিন সন্ধ্যায়ই বড়বাড়ির বউদের মূহুর্মুহূ উলুধ্বনি ও গ্রামের পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণের ভেতর রসরাজের সাথে কমলা রানীর বিয়েটা হয়ে গেল।
কমলা রানীর জন্য দশ বছর আগে যে ঘরটি অপেক্ষায় ছিল আজ রাতে রসরাজ তাকে সে ঘরটিতেই এনে তুলে। ঘরের একপাশে তার অনেক সাধের তেঁতুল কাঠের চৌকিতে একটা ভারী কাঁথার ওপর নকশি কাঁথা পেতে রাখা। তার ওপর চৌকির এক মাথায় সাদা কাপড়ে ফুল তোলা ওয়াড় পরানো দুটো বালিশ। ঘরের এককোণায় একটা বাঁশের গাছায় রাধানাথের হাতে বানানো কুপি বাতি জ¦লছে। তার আলোয় লেপা মোছা মাটির ঘরের ঝকঝকে থকথকে মেঝে আর বেড়াগুলো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘরে কোথাও কোনো বাহুল্য জিনিস নেই। ভেতরে প্রবেশ করেই কমলার মন একটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। কি করবে বুঝতে না পেরে সে ঘরের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রইল। রসরাজও দাঁড়িয়ে ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। সে ভেবে পাচ্ছিল না কি বলবে। তবে তার মনে হচ্ছিল- কিছু একটা বলা দরকার। বলল, ‘এই চৌকিটাতে বও। ঘরের সবকিছুই অখন তোমার।’
প্রথমেই এমন কথা শুনে কমলা ঘোমটার ভেতর থেকে রসরাজের দিকে তাকায়। কৃতজ্ঞতায় তার চোখ টলটল করে। রসরাজের চোখও টলটল করে। সে ভাবে, সেইতো কমলা তার ঘরে এল,কেন আরোও দশবছর আগে এল না ? তাহলে এত যে দুঃখ- কষ্ট,যন্ত্রণা গত দশ বছর সে পেয়েছে তা আর পেতে হত না বরং তার জীবনটা হয়তো ফুলে ফসলেও ভরে উঠতে পারত। হঠাৎ কেন যেন তার মনটা একটু কঠোর হয়ে ওঠে। কোনো ভূমিকা না করে কমলাকে উদ্দেশ্য করে সে বলে,‘তুমি চৌকিটার মাঝে বওত দেখি! তোমার লগে আমার কয়টা কথা আছে।’ কমলা থতমত খায়। তটস্থ হয়ে একটু জড়সড় হয়ে সে চৌকিটিতে বসে। একটু দূরত্ব রেখে রসরাজও সেই চৌকিটিতে পা তুলে বসে। কিন্তু কিছু বলার কথা বললেও সহসা সে কিছু বলতে পারে না। তাই যে কথাগুলো বলার, সেকথাগুলো মনে মনে কিছুক্ষণ গুছিয়ে নেয় সে। তারপর বলে, ‘দেখেগোা কমলা, তোমার বা আমার কারোরই অখন কিন্তু বিয়া করার বয়স নাই। অখন আর বিয়া করার কথাও আছিলনা। তবু করলাম। কওতো দেখি তাও কেনে তোমারে বিয়া করলাম ?
কমলা কিছু বলে না। রসরাজ বলে, আমিই তবে কই। কমলা রসরাজের দিকে ক্ষণিকের দৃষ্টি দিয়ে আবার মাথা নত করে। রসরাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে আর পান খায়। তারপর মিনিট কয়েক পরে বলে, শোনো কমলা, অখন আর তোমারে দেওয়ার মত আমার কিচ্ছু নাইগো। সোনাদানা,সুখশান্তি কিচ্ছু না। তবে ময়নার মার মুখো তোমার কষ্টের কথা জানার পর তোমার লাগি আমার খুব মায়া লাগছিলো। কেনে মায়া লাগছে কই?
কমলা শুধু মাথা কাত করে।
রসরাজ বলে আসলে দুনিয়ায় যারার কেউ নাই,যারারে মানুষ খালি তুচ্চ তাচ্ছিল্য করে তারার মনের কষ্ট কেউত বুঝে না, কেবল তারা বোঝে যারা নিজেরাও তুচ্চ তাচ্ছিল্যের পাত্র! আমি আমার সারা জীবনে দেখছি নারীলোকের যখন কেউ থাকেনা, তখন তার মত অসহায় আর কেউ নাই। তার মত অবহেলারও কিছু নাই। কইতে পারো আমি পুরুষলোক হইয়া কেমনে অত বুঝলাম?
কমলা আবার মাথা নাড়ে। রসরাজ বলে, তুমিত জানোই যে, আমি পুরুষ হইলেও মানুষ আমারে পুরুষ মনে করে না। কারণ আমি বেইট্যা বেটা। লোকে আমারে বেটি মাইনষের মতই মনে করে। তাই মনে হইল আমি একজন পুরুষ মানুষ সত্বেও খালি বেটি মানুষের মত কথা কই, বেটি মানুষের মত কাম কাজ করতে পারি এর লাগি যুদি তারা আমারে এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, তবে একজন নারীরে এই সমাজ কতই না তুচ্চ ভাবে! আর তাতেই বুঝলাম একজন নারীলোকের অবস্থা কত খারাপ হইতে পারে।
তাও তোমার লাগি খারাপ লাগলেও ময়নার মার অনুরোধ আমি তখন রাখতাম পারলাম না। কিন্তু পরে আমি বুঝলাম যুদিও আমি একজন পুরুষ মানুষ তাও নারীলোকের মত হওয়ার কারণে এই সমাজে তোমার আর আমার অবস্থা এক সমান। বুঝলাম আমরা বড় অসহায়। এই দুনিয়াত আমরার কেউ নাই। দেখলাম তোমার অবস্থা আমার থাকিও খারাপ! কারণ তোমার ঘরবাড়ি নাই। থাকা খাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নাই। খুব মায়া লাগল গো তোমার লাগি। এর লাগি কই,খালি ঐ মায়াটুকুই আমার দেওয়ার আছে। আর কিছু না গো।
কমলা হঠাৎ রসরাজের হাতটা টেনে নেয়। এবার রসরাজ থতমথ খায়। জীবনে প্রথম একজন অপরিচিত নারীর স্পর্শে তার অদ্ভূত একটা অনুভূতি হয়। তবে সে তার হাতটা টেনে নেয় না। ঐ স্পর্শ তার খুব ভালো লাগে। কিন্তু কমলার চোখে জল। এতক্ষণ পর সে মুখ খুলে। বলে, ‘আমরা যতদিন বাঁচমু শুধু আপনার আমার ঐ মায়াটুকইু যেন থাকে। বাকীতো আর কয়টা দিন! আমার তাতেই চলব।’
কমলার মুখের কথা শুনে রসরাজ বিমূঢ় বসে থাকে। কতক্ষণ তার ঠিক নেই। যেন অনন্তকাল পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ তার হাত তখনো কমলার হাতে ধরা। সে কমলার মুখের দিকে চেয়ে থাকে অনিমেষ। তাতেই কমলার চোখের জল আর বাঁধ মানে না। গাল বেয়ে দুফোটা জল ঝরে পড়ে রসরাজের হাতে। কী যেন হয় রসরাজের! কমলার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সে কমলার চোখের জল মুছে দেয়।#