রথযাত্রার সাংস্কৃতিক উৎস

ঋগ্বেদে যেমন রথারোহী ইন্দ্রের কল্পনা পাওয়া যায়, বৌদ্ধদের সামাজিক উৎসব সংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে তেমনি রথে করে বুদ্ধমূর্তিকে নিয়ে পথ-পরিক্রমার কথা দেখা যায়। কিন্তু অতীত থেকেই উড়িষ্যা এবং বাংলায় যেভাবে রথযাত্রা উৎসব বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডলে অনুষ্ঠিত হয়, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে এই উৎসবের মধ্যে অন্যান্য প্রচলিত পার্বণের মত প্রাগিতিহাসের কাল থেকে সূত্রান্বেষণ করা খুব কঠিন বলেই মনে হয়। তবে ব্যাপারটা ঠিক ততটা কঠিনও নয়। লোকসংস্কৃতির ইতিহাস বিষয়ে উৎসাহী অন্বেষকমাত্রই এব্যাপারে খানিকটা সন্ধিৎসা দেখালেই রথ-উৎসবের অন্তর্লীন স্মরণাতীত কাল থেকে বহুমান বহু বিচিত্র বিশ্বাস এবং সেটির সঙ্গে সম্পৃক্ত রীতি, আচার ইত্যাদির হদিস পাওয়া সম্ভব।

রথযাত্রার সাংস্কৃতিক উৎস নিয়ে আলোচনার শুরুতেই এই উৎসবের কেন্দ্রীয় ত্রিমূর্তি— জগন্নাথ, সুভদ্রা এবং বলরামের —প্রসঙ্গ অবশ্য বিচার্য। এঁদের মধ্যে জগন্নাথদেবের উদ্ভব সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায় যে— কৃষ্ণের মৃত্যুর পরে তাঁর দেহের কোন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা হয়নি। তবে দেহাবশেষস্বরূপ তাঁর অস্থিগুলিকে একত্রিত করে কয়েকজন কৃষ্ণভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে দান করে দিয়েছিলেন। এরপরে বিষ্ণুর আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কৃষ্ণের নির্মিয়মান নিমকাঠের মূর্তির মধ্যে সেই অস্থিগুলিকে রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেই মূর্তিটি তৈরি করবার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু রাজার ব্যস্ততার তাড়নায় বিরক্ত হয়ে মুখ-চোখ-হাত-পা-বিহীন অসমাপ্ত মূর্তির মধ্যেই কৃষ্ণের অস্থিগুলি স্থাপন করবার পরে, নিজের কাজ অসমাপ্ত রেখেই বিশ্বকর্মা বিদায় নিয়েছিলেন। তখন ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে রাজা তাঁর আশীর্বাদে সেই অসমাপ্ত মূর্তির মধ্যে চোখ ও দৃষ্টির সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাতে প্রাণের সংস্থানও করেছিলেন।

জগন্নাথদেবকে নিয়ে প্রচলিত থাকা এই একই গল্পের ভিন্নতর একটি অনুষঙ্গে যা পাওয়া যায়, সেটা নিম্নরূপ—
বসুশবর নামের একজন অরণ্যচারীর উপাস্যদেবতা নীলমাধবের কাষ্ঠমূর্তির মধ্যেই বিশ্বকর্মা কৃষ্ণের অস্থিগুলিকে সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। সেই মূর্তির হাত-পা ইত্যাদি কিছুই ছিল না। পরে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথরূপে সেই মূর্তিটিরই পূজা করেছিলেন। এই কারণেই এখনও উড়িষ্যার স্থানীয় আদিবাসীরা, যাঁরা নিজেদের শবরবংশীয় বলে দাবি করে থাকেন, জগন্নাথদেবের পুজোর সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখন তাঁদের নাম হয়— দয়িত।

লোকসংস্কৃতির গবেষকদের মতে, স্পষ্টতঃই, জগন্নাথদেবকে নিয়ে প্রচলিত থাকা এইসব কাহিনীর অন্তরালে কয়েকটি আদিম সংস্কার ও ঐতিহ্যবোধ সক্রিয় রয়েছে বলে দেখা যায়।
প্রথমতঃ, মৃতের অস্থি পুনঃ-সংযোজন করে নতুন কলেবর গড়ে তাতে আবার প্রাণসঞ্চার করা হয়েছিল;
দ্বিতীয়তঃ, মৃর্তির মধ্যে বৃক্ষপ্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল;
তৃতীয়তঃ, আদিতে জগন্নাথ আরণ্যক কোনো জাতির বা শবর জাতির উপাস্য দেবতা ছিলেন। এই কারণেই তাঁর মূর্তিতে আদিম দেবতাসুলভ রূপটি প্রকট হয়ে উঠেছে বলে দেখা যায়। লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে— জগন্নাথের হাত-পা নেই, একখণ্ড কাঠের উপরেই তাঁর মুখ-চোখ আঁকা। এটি হুবহু ‘টোটেম পোল’ জাতীয় বস্তু যা রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ছাড়াও মধ্যভারতের গোন্দ, মুরিয়া প্রভৃতি আদিবাসী জাতির মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গতঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

এছাড়া মনোবিজ্ঞানীরা অনেকেই এই একই ধরণের সূঁচালো একধরণের উপাস্য মৃতিকে ‘ফ্যালিক সিম্বল’ বা পুরুষত্বচিহ্নের প্রতীক বলে নির্দেশ করে থাকেন।

একথা যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হয় যে, একদিক থেকে বিচার করলে, জগন্নাথের মূর্তি আসলে উর্বরতা-তন্ত্র তথা ফার্টিলিটি কাল্টের দ্যোতক।
এই উৎসবের ত্রিমূর্তির দ্বিতীয় পুরুষ— বলরাম প্রসঙ্গে এই একই সূত্র ধরে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। বলরাম বা হলধর— কৃষ্ণের বৈমাত্রেয় ভাই বলে প্রাচীন পুরাণে বর্ণিত হয়েছেন। হলধর শব্দের অর্থ হল— স্বয়ং যে দেবতা লাঙ্গল ধারণ করেন; সুতরাং তিনি নিঃসন্দেহে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভাষা গবেষকদের মতে, কৃষ্ণ নামটির মধ্যেও অবশ্য সেই একই ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। তাছাড়া বলরাম— প্রাচীন পুরাণে অনন্তনাগ বা শেষনাগের অবতার-রূপে গণ্য হয়েছেন বলে দেখা যায়; সাপকে যেহেতু পুরুষত্বের দ্যোতক বলে গণ্য করা হয়, তাই সেদিক থেকে তিনিও এক অর্থে উর্বরতা কাল্টের সঙ্গে যুক্ত বলে বলা যেতে পারে।

এরপরে আসে সুভদ্রার প্রসঙ্গ। পরিশীলিত পৌরাণিক কাহিনী ও মহাভারত মহাকাব্যে সুভদ্রা হলেন অর্জুনের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং কৃষ্ণ-বলরামের ভগিনী; স্বয়ং কৃষ্ণের সাহায্যেই অর্জুন তাঁকে হরণ করে বিবাহ করেছিলেন। এই পৌরাণিক সূত্রকে ধরলে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে একইসঙ্গে তিন ভাইবোনের পূজার্চনা ইত্যাদি করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে অভিনব এবং খুব সম্ভবতঃ তুলনাবিরহিত একটি নিদর্শন। কারণ— সাধারণভাবে লোকজীবনে যেখানেই মূর্তি উপাসনার মাধ্যমে ধর্মাচার পালন করা হয়ে থাকে, সেখানে ভাইবোনের যুগল মূর্তি কল্পনা করে কোনো দেবতার অর্চনার সন্ধান পাওয়া যায় না; অন্ততঃ ভারতীয় কোন দেবতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সচরাচর কোথাও যুগল মূর্তি পূজিত হলে, সেই প্রত্ন-ইতিহাসের কাল থেকেই সেটিকে পুরুষ ও প্রকৃতি বলে কল্পনা করা হয়ে এসেছে বলে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে উদারণস্বরূপ— শিব-শক্তি, লক্ষ্মী-নারায়ণ, রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতা —ইত্যাদি যুগলমূর্তির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এছাড়া অনেক সময়ে বিভিন্ন ধর্মে এইধরণের যুগলমূর্তিকে মা ও পুত্র বলেও কল্পনা করা হয়ে থাকে; যেমন— আইসিস-হোরাস, মেরী-যীশু, পার্বতী-গণেশ, যশোদা-কৃষ্ণ মায় বনবিবি-দুখে, নারায়ণী-বারাঠাকুর ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কখনো দুই ভগিনীকেও যেমন (ওলাবিবি-ঝোলাবিবি), সাত ভগিনীকেও তেমনি (পৌরাণিক সপ্তমাতৃকা কিংবা লৌকিক সাতবৌনি বা সাতসিনি ইত্যাদি স্মরণযোগ্য) একত্রে পূজিত হতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে— জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম —এই ত্রয়ীকে নিঃসন্দেহে দেবভাবনার বিশ্বজনীন চরিত্র বলা যেতে পারে, যেটিকে কোন অন্তর্লীন কাঠামোতে (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) ফেলে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। খৃষ্টানদের হোলি ট্রিনিটি, হিন্দুদের ত্রিদেব এবং বৌদ্ধদের ত্রিশরণ— নিতান্তই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক চিন্তার এবং পরিশীলিত একটি দর্শনচেতনার ফলশ্রুতি। তাই রথযাত্রা উৎসবের মধ্যে বৌদ্ধ রথযাত্রার কোন প্রভাব থাকাটা অসম্ভব কিছু নয় বলেই গবেষকরা মনে করেন।

প্রচলিত একটি কিংবদন্তী অনুসারে— বুদ্ধের একটি দাঁত নাকি জগন্নাথের মূর্তির অভ্যন্তরে লুকোনো রয়েছে, এবং বারো বছর অন্তর সেই মূর্তিটি যখন বদল করা হয়, তখন জগন্নাথের প্রধান সেবায়েত নাকি নবকলেবরের মধ্যে সঙ্গোপনে সেটিকে চোখবাঁধা অবস্থায় সুরক্ষিত করে রাখেন।

গবেষকদের মতে এটা নিঃসন্দেহে একটা গল্পই, কিন্তু এই গল্পের মধ্যে যে একটা বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে— সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অতীতের কোন একসময়ে চীনে বুদ্ধমূর্তিকে রথে চড়িয়ে ঘোরানোর রেওয়াজ চালু ছিল, মায়ানমারের বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলি নিজেদের চেহারায় জগন্নাথের রথেরই সমধর্মী। রথের রশি ধরে টানবার অধিকার সকলেরই রয়েছে— জাতি, বর্ণ, ধর্ম, কুলীন, অচ্ছুৎ বলে সেখানে কোন প্রভেদ নেই। যদিও ব্রাহ্মণ্য সংস্কারবিধি অনুযায়ী সবাই মন্দিরে প্রবেশ করবার অধিকারী নন; তবে এখানে শবরদের কথাও মনে রাখতে হবে; তাঁদের অবতংসরা কিন্তু এই অধিকার পান, এমনকি পূজার ক্ষেত্রেও। এসব মিলিয়েই হল রথযাত্রা উৎসব; এবং জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম ও রথযাত্রার মধ্যে যে কিছুটা হলেও বৌদ্ধ অনুষঙ্গ রয়েছে— সেবিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। একইসাথে এখানে একথাও স্মরণীয় যে— হিন্দুদের দশ অবতারের তালিকাতে নবম নামটি কখনো বুদ্ধের তো কখনো আবার জগন্নাথের।

কিন্তু এসব থেকে এমন সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয় যে— অতীতের কোন একসময়ে ত্রিমূর্তির সঙ্গে ত্রিশরণ, অর্থাৎ— বুদ্ধ-ধর্ম-সঙ্ঘ —অভিন্ন ছিল। পক্ষান্তরে, প্রাচীন বিবরণ অনুসারে— অতীতে রথ চলবার সময়ে জগন্নাথ ও সুভদ্রার মধ্যে অবৈধ একটি সম্পর্কের অভিযোগ এনে তাঁদের টিটকিরি দেওয়াটা এই উৎসবের অনিবার্য একটি অঙ্গ বলেই গণ্য করা হত। গবেষক জন ডসন তাঁর হিন্দু ধ্রুবপদী অভিধানেও এপ্রসঙ্গ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। অন্যান্য গবেষকদের মতে— এই রীতির সূত্র ধরেই রথযাত্রা উৎসবের উৎস এবং বিকাশের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। জগন্নাথ-সুভদ্রার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে অভব্য টিটকিরি দেওয়ার রেওয়াজ থেকে বিশ্বাস করা যায় যে, অতীতের কোন একসময়ে এটিও একধরণের মদনোৎসব ছিল। জগন্নাথের সঙ্গে শবর অনুষঙ্গকে স্মরণে রেখে হোলি নামক শাবরোৎসব ইত্যাদির সঙ্গে এটিকে তুলনা করা চলে। প্রাচীন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এইধরণের উৎসব প্রচলিত ছিল বলে ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়; প্রসঙ্গতঃ প্রাচীন রোমের ব্যাকানালিয়া এবং স্যাটার্নালিয়া, প্রাচীন ইংল্যাণ্ডের মে-পোল ফেস্টিভ্যাল, মধ্যযুগের ফ্রান্সের ফ্লাওয়ার ডে ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গবেষকদের মতে— স্নাভ, টিউটন, কেলটিক, গল— প্রভৃতি ইউরোপীয় জাতির মধ্যে; ওজিবওয়া, চেরোকী, স্যালিস, টুপী-মুণ্ডুরুকু, ইয়াঘান, ঈর-ঈওরোন্ট প্রভৃতি রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর মধ্যে; ফান্টি-আশান্টি, বুশম্যান, কাফির প্রভৃতি আফ্রিকার আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে; প্রাচীন চীনে, জাপানে, মিশরে, গ্রীসে এবং অবশ্যই ভারতে— অতীতে এইধরণের উৎসব প্রচলিত ছিল, এবং আজও অনেকটা মৃদুভাবে প্রচলিত রয়েছে। ভারতে— সাঁওতাল, মুরিয়া, দাফলা, বোড়ো, টিপরা, হাজং, রিয়াং, চোলা-নাইক্কার —প্রভৃতি আদিবাসী জাতিদের মধ্যে এই একই ছাঁদের উৎসব এখনো চালু রয়েছে। লোকসংস্কৃতির গবেষকরা মনে করেন যে, বিবাহের সময়ে গান এবং নাপিতের ছড়ার মধ্যে যে অশালীন শব্দ ও বর্ণনার রেওয়াজ রয়েছে, —সেটাও মিলনোৎসবের ঐ আদিম ঐতিহ্যেরই অনুষঙ্গবাহী। গবেষক জেমস ফ্রেজার তাঁর ‘গোল্ডেন বাউ’ গ্রন্থে এবং এডোয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক তাঁর ‘হিস্ট্রি অব হিউম্যান ম্যারেজ’ গ্রন্থে এইধরণের সুপ্রচুর ঐতিহাসিক নমুনা সংকলিত করেছিলেন বলে দেখা যায়। সুতরাং জগন্নাথদেব— যাঁকে তাঁর বিশেষ আকৃতির জন্য স্যাঙ্গর ব্রাউন তাঁর ‘সেক্স ওয়রশিপ অ্যান্ড সিম্বলিজম অ্যামং দ্য প্রিমিটিভ রেসেজ’ গ্রন্থে— যৌন প্রতীকের বিবর্তিত রূপ বলে উল্লেখ করেছিলেন— তিনি এবং সুভদ্রার মাধ্যমে আদিম বা প্রাচীনকালীন একটি মদনোৎসবই রথযাত্রায় বিবর্তিত হয়েছে মনে করা যেতে পারে। অন্যদিকে বলরাম যেমন লাঙ্গলধারী বটে, তেমনি আবার মদ্যপান তথা নেশার ও হুল্লোড়ের দেবতাও বটে; এদিক থেকে তিনি প্রাচীন রোমান দেবতা ব্যাকাসের সাথে তুলনীয়। তাঁর সম্পর্কে পৌরাণিক বৃত্তান্ত রয়েছে যে— মত্ত অবস্থায় জলকেলি করতে ঝোঁক হওয়ার জন্য তিনি অনিচ্ছুক যমুনা নদীকে লাঙ্গল দিয়ে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁব সেই লাঙ্গলের পীড়ন সহ্য করতে না পেরে যমুনা নদী শেষপর্যন্ত নারীর রূপ ধরে জলকেলি করে বলরামের সাধ মিটিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের দিক থেকে এই পৌরাণিক কাহিনীটি তাৎপর্যপূর্ণ। আবার সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিতদের মতে— লাঙ্গল একই সঙ্গে কৃষির ও পুরুষাঙ্গের প্রতীক; অন্তত এভাবেই প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে এই বস্তুটি ঐতিহ্যাগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। অতএব বলরামকে মদনোৎসবের একজন প্রধান চরিত্ররূপে পাওয়া গেলে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে না।

রথযাত্রা উৎসবের ‘যাত্রা’ শব্দটির তাৎপর্যও এপ্রসঙ্গে বিচার্য। ‘যাত্রা’ শব্দটির অর্থ হল— গমন। তবে কোথাও যাওয়া ছাড়াও এই শব্দের বিশেষ একটি ভিন্নতর ব্যঞ্জনা রয়েছে— রমণ —যা আসলে মদনোৎসব জাতীয় উপলক্ষ্যের সঙ্গেই সাযুজ্যসম্পন্ন। রথযাত্রার ক’দিন আগের স্নানযাত্রার অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেকগুলি লোকউৎসব বা লোকপার্বণ যাত্রা শব্দটির সঙ্গে সংযুক্ত; যথা— দোল, রাস, ঝুলন, চন্দন ইত্যাদি। এগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গেই নরনারীর অবাধ মেলামেশার রেওয়াজটা ঐতিহ্যাগত বলেই দেখা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে রথযাত্রা শব্দের অন্তর্লীন ব্যঞ্জনাটা খতিয়ে বিচার করলে সেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। গবেষকদের মতে, জগন্নাথের স্নানযাত্রার তাৎপর্যও ভিন্ন কিছু নয়; বিশেষতঃ প্রতীকী ধারাস্নানও উর্বরতা তন্ত্রের একটা দ্যোতক। বসুধারার তাৎপর্যও এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য।

কিংবদন্তী অনুসারে গুণ্ডিচা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী ছিলেন। রথযাত্রা করে জগন্নাথ গুণ্ডিচার মন্দিরে যান এবং আটদিন পরে উল্টোরথে সেখান থেকে ফিরে আসেন। স্থানীয় ঐতিহ্যানুসারে এই ব্যাপারটি হল জগন্নাথের মৌসী ওরফে মাসীর বাড়ি যাওয়া। কিন্তু মাসীর বাড়ি শব্দটি সমগ্র পূর্ব ভারতে সব সময়ে খুব একটা সরলার্থবাহী নয়! বিশেষতঃ, এই বিশেষ ক্ষেত্রে রথ সেখানে গিয়ে পৌঁছানোর পরে হিন্দুদের নবমাবতারকে যাঁরা প্রত্যুদ্গমনের মাধ্যমে সমাদরে বরণ করে নেন, তাঁরা সবাই পুরুষ হলেও তখন তাঁদের উপাধি হয় গোপিনী! সুতরাং— মাসীর বাড়িতে গোপিনী-পরিবৃতা হয়ে জগন্নাথ যে রাসলীলারই অনুরূপ কিছুতে নিমগ্ন হবেন, অতীতে এটাই সম্ভবতঃ এই রেওয়াজের মধ্যে থাকা অন্তর্লীন সংস্কার ছিল। একই প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখ্য যে, জগন্নাথের এই গুণ্ডিচাবাড়ি যাওয়াকে অনেক সময়েই জগন্নাথের শ্বশুরবাড়ি যাওয়াও বলা হয়ে থাকে।

এবারে প্রশ্ন হল যে, রথযাত্রা উৎসবটি আষাঢ়মাসেই কেন অনুষ্ঠিত হয়? গবেষকদের মতে এই উৎসবটি যেহেতু উর্বরতাতন্ত্রের সঙ্গেই সম্পৃক্ত, সেহেতু ভরা বর্ষাকাল হল কৃষির মরশুম এবং কৃষির পরিবৃদ্ধির জন্য মদনোৎসব পালন করাটা মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশ প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে, কৃষির অনুষঙ্গে কৃষ্ণ এবং বলরাম এই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েছেন। বাস্তবে শবরদের প্রাচীন দেবতা নীলমাধব কৃষ্ণাবতার জগন্নাথে নিজের পরিণতি লাভ করেছেন, যে দেবতা আবার পুরুষাঙ্গ-প্রতীক, অর্থাৎ— ঐ উর্বরতাতন্ত্রের ভিন্নতর ঐতিহ্যের সূত্রধারী। বলরাম ও সুভদ্রা— জগন্নাথের সঙ্গে শবরদেরই সাওরা নামের শাখাগোষ্ঠীর একটি লোক পুরাণবৃত্তের বিবরণের জের ধরে আবির্ভূত হয়েছেন। অতীতে গবেষক ভেরিয়ের এলুইন তাঁর ‘দ্য রিলিজ্যন অফ অ্যান ইণ্ডিয়ান ট্রাইব: সাওরা’ গ্রন্থে এই বিবরণটি সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। সেই বিবরণ অনুসারে— আদ্যিকালে নাকি তিনটি প্রধান সত্তা, ওরফে— কিত্তুঙ্গ, আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা দু’ভাই ও একবোন ছিলেন; যথা— রস্মাকিত্তুঙ্গ, বিস্মাকিত্তুঙ্গ এবং সীতাবৈকিত্তুঙ্গ। তাঁদের সন্তানেরাই নাকি সাওরা জাতির প্রাচীন প্রপিতামহবর্গ ছিলেন। রস্মা-বিস্মা— এই দু’ভাই হলেন সাওরা জাতির মুখ্য দেবতা, এবং সীতাবৈ হলেন মুখ্য দেবী। এই নামগুলো দেখে কোন সন্দেহ থাকে না যে— রাম-সীতা-ভীম নামগুলি উচ্চতর অর্থনৈতিক সংস্কৃতি থেকে গিয়ে অতীতে এই পুরাণবৃত্তান্তের মধ্যে থাকা মূল নামগুলিকে সরিয়ে দিয়েছিল। অতীতের কোন একসময়ে সাওরারা দু’ভাইয়ের মাঝে তাঁদের স্ত্রী তথা ভগিনীর মূর্তিটি রেখে পুজো করতেন। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে— রথযাত্রার সঙ্গে বৌদ্ধ ঐতিহ্য কিছুটা হলেও বিজড়িত রয়েছে, এবং সেই ঐতিহ্যে— বৌদ্ধের দশরথ জাতক অনুসারে— রাম ও সীতা ভাইবোন হয়েও দম্পতি। গবেষকদের মতে, সুদূর অতীতের কোন একটা সময়ে এটিই সম্ভবতঃ রূপান্তরিত হয়ে রথযাত্রার ত্রিমূর্তিতে পরিণত পেয়েছিল। অন্যান্য সবজায়গায় মত এখানেও ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্য মূল আদিবাসী ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। এরপরে বৌদ্ধ প্রভাব এর মধ্যে আরও কিছু উপাদান সংযোগ করেছিল। এবং অবশেষে বৈষ্ণবীয় প্রেমধর্ম ও সাম্যভাবনা এই উৎসবকে বর্তমান রূপ দিয়েছিল। কিন্তু এই উৎসবের মূলে সেই সাম্যকেন্দ্রিক উর্বরতাভাবনাও রয়েছে— মদনোৎসব যেটির অনুষঙ্গ মাত্র।

সময়ের সাথে উড়িষ্যা হয়ে বৈষ্ণবীয় ভাবধারার পথ ধরে রথের উৎসব বাংলায় এসে উপস্থিত হলেও বাঙালির সংস্কৃতিতে রথযাত্রার রীতিটিই শুধু প্রাধান্য পেয়েছিল; কিন্তু অন্যান্য যেসব সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যগুলি এই উৎসবের মধ্যে মিশে রয়েছে; যথা— শবর-সম্পর্ক বা সুভদ্রা-জগন্নাথের সম্পর্ক নিয়ে টিটকিরি— এগুলো কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিতে প্রাধান্য পায়নি। একথার অর্থ হল যে— উড়িষ্যা থেকে রথযাত্রা বাংলায় এসে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হলেও সেটা বেশ খানিকটা পরিশীলিত হয়েই প্রচলিত হয়েছে। আনন্দ এবং হৈ-চৈই বাংলার রথযাত্রার মুখ্য ব্যাপার; বাংলায় আসবার পরে রথযাত্রা থেকে ধর্ম এবং সংস্কারটা পরোক্ষে চলে গিয়েছে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!