দিনটা ছিল আজ থেকে ৮২ বছর আগে, মানে ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট।
স্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। কিছুক্ষণ আগেই শেষবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখে গিয়েছেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় আর ডাক্তার ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টাই বিফল হল। বেলা ১২টা ১০মিনিটে পরলোকে পাড়ি দিলেন কবিগুরু।
বেলা সাড়ে বারোটায় কবির প্রয়াণ সংবাদ ঘোষণা করল আকাশবাণী। সারা দেশ শোকস্তব্ধ। ঠাকুরবাড়ির বাইরে শোকার্ত মানুষের ভিড় শুরু হল। কবিগুরুকে শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য অধৈর্যপনা। সেই ভিড় ক্রমশ জনসমুদ্রে পরিণত হল। চলল অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা।
এ দিকে গুরুদেবের দেহ স্নান করিয়ে, সাদা বেনারসী জোড়, গরদের পাঞ্জাবি পরিয়ে পাটকরা চাদর দিয়ে শোয়ানো হয়েছে বিছানায়। পরিয়ে দেওয়া হয়েছে কপালে চন্দন, গলায় গোড়ের মালা। পায়ের কাছে রাশি রাশি শ্বেতকমল, রজনীগন্ধা।
শেষযাত্রার পালঙ্কের নকশা এঁকে মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করিয়ে ফেললেন নন্দলাল। বেলা সাড়ে ৩টে পর্যন্ত জনতার শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন। এরই মধ্যে হঠাৎ করে বাইরে থেকে একদল লোক হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সেই ঘরে।
ভিড়ের চাপে দোতলার সিঁড়ির রেলিং ভেঙে পড়ল। সিঁড়ির ছাদও ভাঙার উপক্রম। ততক্ষণে জোর জবরদস্তি ভেতরে ঢোকার জনস্রোতের চাপে লোহার গেট ভেঙে গেছে। যারা জোর করে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁরাই রবি ঠাকুরের মৃতদেহ তুলে নিয়ে হইহই করে বেরিয়ে পড়লেন। বাইরে তখন উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জয়’, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।
জোড়াসাঁকোর ভিতরে থাকা লোকজন বলতে শুরু করল, এরা কারা?কোনও শিষ্টাচার নেই। এতটুকু সম্মান করল না বিশ্বকবিকে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! জনপ্লাবনের কালো মাথায় নৌকোর মতো ভাসতে ভাসতে শবদেহ চলল রাজপথে। আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের শবযাত্রার বিবরণ, আবৃত্তি, নজরুলের স্বরচিত কবিতা-গান— ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে… এন্ডরুজের রেকর্ড করা ভাষণ, প্রধান ধর্মযাজকের শোক জ্ঞাপন। সমকালীন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখে ফেললেন— ‘মরণের হাতে লীলাকমল তুমি,/ চলেছ আজ, জনস্রোতের তরঙ্গে তরঙ্গে,/ সদ্য ছেঁড়া সহস্রদল পদ্মের মতোই ভেসে/ শোকের বার দরিয়ায়।’
অবশেষে ক্ষিতীশপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক্তার নলিনাক্ষ সান্যাল, প্রবোধকুমার সান্যালদের মতো বিশিষ্টজনদের কাঁধে করে কলুটোলা স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট হয়ে কবির শবযাত্রা গিয়ে পৌঁছল নিমতলা শ্মশানঘাটে। ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট।
এর মাত্র কয়েক দিন আগে, অপারেশনের জন্যই ৯ শ্রাবণ শুক্রবার, ইংরেজির ২৫ জুলাই শেষবারের মতো তাঁর বহু যত্নে গড়া শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি রওনা হয়েছিলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। বিশেষ সেলুনগাড়ি সকাল আটটায় জুড়ে দেওয়া হয়েছিল পাকুড় প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে। সেই গাড়ি হাওড়া স্টেশনের ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছয় বেলা ২-৪০ মিনিটে। সেখান থেকে গাড়িতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, মানে তাঁর জন্মভিটায় ৩-১৫ মিনিটে।
অপারেশনের বিপক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে, ডাক্তার নীলরতন সরকার এবং কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ। আর অপারেশনের পক্ষে ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, ডাক্তার ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডাক্তার ইন্দুভূষণ বসু। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সুপ্রা পিউবিক সিস্টোস্টমি অপারেশন হবে। চিকিৎসকেরা অনেক আলাপ-আলোচনা করে ৩০ জুলাই অপারেশনের দিন ঠিক করেন।
এই অপারেশনের দিনই, মানে ৩০ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে সক্কালবেলায় মহাআশঙ্কার মধ্যে শুয়ে থেকেও মুখে মুখেই তিনি রচনা করে ফেললেন তাঁর জীবনের সর্বশেষ কবিতা, যেটা লিখে নিয়েছিলেন রানী চন্দ— ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী’।
এ দিনই বেলা ১১টায় বারান্দায় প্রস্তুত করা হল অপারেশন টেবিল। ২৫ মিনিট ধরে চলল অপারেশন। তার পর বিকেলের দিকে মাঝে মাঝেই কবির জ্বালা করতে শুরু করল। শুরু হল ব্যথা।
৩১ জুলাইও ওই ভাবেই কাটল। ১ আগস্ট কবির গলা থেকে বেরোতে লাগল যন্ত্রণাসূচক শব্দ আর হিক্কা। ২রা কবি চলে গেলেন আচ্ছন্নতায়। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে কাশি। ৩রা আগস্ট অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। কবি ওষুধ খেতে চাইছিলেন না। দুপুর থেকে আবার আচ্ছন্নতা। এবার ধরা পড়ল কিডনি অকেজো। জেঁকে বসেছে ইউরোমিয়া। অপারেশনের সেলাই খুলে দিলেন ললিতবাবু। বিধানচন্দ্র আর ললিত দু’জনেই হতাশ।
৭ আগস্ট, ২২শে শ্রাবণ সকাল ৭টায় রামানন্দবাবুর উপাসনা, বিধুশেখরের মন্ত্রপাঠ, কবির মুখে শেষবারের মতো জল দিলেন অমিতা ঠাকুর। বারবার নাড়ি দেখছিলেন ডা. জ্যোতিষ রায়। মালা জপ করছিলেন তান য়ুন শান। শুরু হল কবিকে সুস্থ করার জন্য বিধানচন্দ্র আর ললিতের অসম লড়াই।পুনঃপর্যবেক্ষণ। অবশেষে হাল ছাড়লেন তাঁরা। বেলা ৯টায় খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। স্তব্ধ হয়ে গেল কবির হৃদস্পন্দন। ঘড়িতে তখন বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট।
সে দিন রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার জনপ্লাবন ছিল কল্পনাতীত। সে দিন তাঁর মরদেহের উপরে যে বিভিন্ন রকমের অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়েছিল, সেটাও ছিল কল্পনাতীত। সে দিন গোটা শবযাত্রা জুড়ে ছিল প্রচণ্ড চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি। শবযাত্রায় যাঁরা পা মিলিয়েছিলেন, তাঁরা পরখ করেছিলেন একদল উৎশৃংখল লোকের বর্বরোচিত দৃশ্য। পরখ করেছিলেন, কবির মরদেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য। মনে হয়েছিল, লোকজন বুঝি পাগল হয়ে গেছে। বহু লোক শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ফুলের স্তবক নিয়ে গেলেও সেই ফুল তাঁদের হাতেই থেকে গিয়েছিল।
কেউ কেউ তাঁর চুল দাড়ি-ছিঁড়ে নিয়েছিল। কেউ কেউ প্রণামের অছিলায় তুলে নিয়েছিল তাঁর পায়ের নখ। কেউ খামচে তুলে নিয়েছিল শরীরের মাংস। আর কত মানুষ যে চলমান খাটের পাশে হাঁটতে হাঁটতে লাফিয়ে উঠে তাঁর হাত-পা ধরে টানাটানি করেছিলেন তার হিসেব নেই। পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গিয়েছিল, শবের পাশে বসে নন্দলাল বসু নাকি পাখার বাঁট দিয়ে সেই ‘স্মারক’-লুব্ধ ভক্তদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।
পরে রবীন্দ্র স্নেহধন্য পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষাল রিপোর্টে জানিয়েছিলেন যে, ঘটনাটি রটনামাত্র। আসলে মাত্র একজন যুবকই ওইরকম বিভ্রান্তমূলক রটনার নায়ক। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ওই ছোকরার বাড়ি তল্লাশি করে ওগুলো সংগ্রহ করেছি। আসল না নকল বুঝতে পারিনি। ইংরাজ ডেপুটি সাহেবের নির্দেশে তা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, না হলে ওগুলি আরও জাল হতো এবং ভবিষ্যতে কবির যা দাড়ি পাওয়া যেত, তার ওজন হতো কয়েক টন হত। কবিগুরুর ওই আসল অথবা নকল দাড়ি ও চুল সংগ্রহকারী যুবকের শেষ পর্যন্ত কোনও শাস্তি হয়েছিল কি না তা অবশ্য আর জানা যায়নি।
সে দিন ওই সব লোকজন ছাড়াও শহর-শহরতলি এবং দূর-দূরান্ত থেকে এত রবীন্দ্র-গুণমুগ্ধ সেই শোকযাত্রায় পা মিলিয়েছিলেন যে, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ সেই ভিড় ঠেলে এগোতেই পারেননি। এমনকী শেষকৃত্য, মুখাগ্নিটুকুও করতে পারেননি।
সেদিন শেষ পর্যন্ত নিমতলা শ্মশান ঘাটে রথীন্দ্রনাথ পৌঁছলেও, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলে রথীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার মরদেহর কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করলেও, পৌঁছনো তো দূরের কথা, মরদেহের কাছাকাছিও যেতে পারেননি।
তিনি নিমতলার কাছাকাছি পৌঁছনো মাত্রই লোকের মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের ছেলে এসেছে। সেটা শুনে তাঁকে দেখার জন্য হাজারও উৎসুক মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল তাঁর চারপাশে। তাঁকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিল বহু মানুষ। আর সেই লোকের ভিড়ের চাপে প্রায় দম বন্ধ হয়ে তিনি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যান।
শ্মশান ঘাটের কাজ শেষ হয়েছিল রাত আটটায়। ছেলে পৌঁছতে না পারায় মুখাগ্নি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ।
কবি নিজে ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য চেয়ে এসেছিলেন বরাবর। কিন্তু জনপ্লাবন এত উশৃঙ্খল ছিল যে, সে ইচ্ছার মর্যাদা রাখা যায়নি। উল্টে চিতা নেভানোর সময় অর্ধদগ্ধ অস্থি নেওয়ার জন্য বেশ কিছু জনতা পাগল হয়ে উঠেছিল। তাই ওই দিনটি ইতিহাসের পাতায় আজও একটি কলঙ্কিত দিন হয়ে রয়ে গিয়েছে।
নিমতলা শ্মশান ঘাটে যেখানে রবীন্দ্রনাথকে দাহ করা হয়েছিল, সেখানে আজও তাঁর নামে একটি স্মৃতিফলক আছে। তাতে লেখা রয়েছে— ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার’।
বিশ্বকবির ইচ্ছে ছিল তাঁর মৃত্যুর পরে এই গান গাওয়া হোক। তাই আজও স্মৃতির ফলকে তাঁর এই গানের লাইন ক’টা লেখা রয়েছে।
তথ্যসূত্র
১। বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ
২। শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮
৩। গুরুদেব- রানী চন্দ