আধুনিক চীনের সবচে’ বিয়োগাত্মক প্রেমগাঁথা

সাহিত্যে নোবেল জয়ী লিও শিয়াবো’র (১৯৫৫-২০১৭) কোনও কবর নেই তার প্রিয় মাতৃভূমি চীনে। কারণ চীন সরকার তার মৃত্যুর পরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে তার শরীর দাহ করে ছাই সাগরে ছড়িয়ে দিয়েছে। যতদূর জানা যায় তার ছাইও সংরক্ষণ করা হয়নি কোনও কবরে। যেহেতু তার কবর রাখার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি সে কারণে যে মানুষ তার কবরের কাছে গিয়ে যে শ্রদ্ধা জানাবে তার সুযোগ নেই। ২০১০ সালে নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হবার পর চীন সরকার মূলত সাহিত্যিক লিও শিয়াবোর মৃত্যু কামনা করে আসছিল। কেননা অনেক নোবেল বিজয়ী পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ দেশের ক্ষমতার শীর্ষে আহরণ করেছেন। যেমন: দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, মায়ানমারের অং সান সুচি প্রমুখ। কট্টর সমাজতান্ত্রিক চীনের একদলীয় শাসকব্যবস্থার স্বৈরশাসকেরা চাননি লিও শিয়াবো কোনোভাবে ক্ষমতায় আসুন, প্রেসিডেন্ট হন। সে কারণে তারা তাকে জেলে বন্দী করে রেখেছিল আমৃত্যু।

লিও শিয়াবো আর কোনও চিঠি লিখবেন না তার প্রিয়তমা লিও শিয়াকে। লিও শিয়াবো ও লিও শিয়ার পরিচয় মূলত ১৯৮৯ সালে চীনের বিখ্যাত সেই তিয়ানমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের দাবীতে তুমুল আন্দোলনের সময়ে। ততোদিনে তারা দু’জনেরই প্রথম সঙ্গীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে ও উপযুক্ত নতুন সঙ্গীর খোঁজ করছেন। লিও শিয়া’র প্রথম স্বামীও ছিলেন একজন কবি। লিও শিয়া নিজেও কবি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী। লিও শিয়া তার লেখা ‘২রা জুন ১৯৮৯’ কবিতায় লিও শিয়াবো সম্পর্কে এভাবে চিত্রিত করেছেন: “তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে/ তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই/ এ এক অদ্ভূত অনুভূতি/ আমি তোমাকে একটি শব্দ বলার সময়ও পাই না? / কেননা মিডিয়ার মধ্যমণি তুমি/ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে দেখে/ ক্লান্তি অনুভব করি/ নিজেকে প্রত্যাহার ও আড়াল করি ভিড়ের বাইরে/ ধূমপান করি ও আকাশ দেখি।”

এরপর থেকে তারা একে অপরকে উদ্দেশ্য করে ক্রমাগত কবিতা লিখতে থাকেন। ১৯৯৬ সালে যখন লিও শিয়াবো শ্রমশিবিরে বন্দী তখন তাকে বিয়ে করেন লিও শিয়া। এজন্য পরে লিও শিয়াবো নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকেন, কেননা তিনি মনে করেন যে তিনি লিও শিয়া’কে আরও বিপদের মধ্যে টেনে এনেছিলেন। সে সময় তিনি তিনি বছর (১৯৯৬-১৯৯৯) রি-এডুকেশন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। সেখান থেকেই প্রচুর কবিতা লেখেন লিও শিয়া’কে উৎসর্গ করে। লিও শিয়াও প্রতুত্তর করেন কবিতায়। লিও শিয়াবো একজন বিশিষ্ট কারাবন্দী, সে কারণে তিনি বিশেষ সুবিধা পান জেলখানায়, এ কারণে তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলতেন:”সম্ভ্রান্ত কারাবন্দী”। ১৩ জানুয়ারি ২০০০ সালে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লেখেন:”তোমার কারাজীবনের থেকে আমার তিন বছরের বন্দীজীবন ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো। কিছু কিছু সময় ছিলাম আমি চরম বিরক্ত। দ্বিতীয়বার রাখা হয়েছিল আমাকে বেইজিংয়ের বাইরে ফ্রেগান্ট হিলে একটি কোর্টইয়ার্ডে আট মাস। তখন ভাল ব্যবহার পেয়েছিলাম। শুধু স্বাধীনতা ছাড়া আর সব কিছু ছিল। তৃতীয়বার রাখা হল আমাকে ডালিয়ান শহরের পুনঃশিক্ষাকেন্দ্রে। সেখানেও আমার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। আমার তিনবারের সম্ভ্রান্ত বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা কোনোভাবে তোমার দুর্ভোগের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।”

নোবেল বিজয়ের পর লিও শিয়াবো বুঝতে পারেন যে চীনা সরকার তাকে আর জীবিত জেল থেকে বের হতে দেবে না। তখন থেকে তিনি মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালের ‘একজন কি বহন করতে পারে কবিতায়’ লিও শিয়াবো লেখেন:”তুমি বলেছিলে সবকিছু বহন করতে পার/ যতক্ষণ না সূর্যের মুখোমুখি হওয়া তোমার চোখ অন্ধত্বের আগুনের বলে পরিণত হয়/ এবং আগুনের শিখা সমুদ্রকে লবণে পরিণত করে,/ প্রিয়—/ আমি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে জিজ্ঞাসা করি/ তুমি কবরে ফিরে যাবার আগে/ আমাকে চিঠি লিখো তোমার ছাই দিয়ে/ পাতালে তোমার ঠিকানা আমাকে দিয়ে যেও।”

লিয়া শিয়া

লিও শিয়া ২০১০ সালে একটি কবিতা লেখেন, সে বছর শিয়াবো নোবেল লাভ করেন, শিয়াবো নোবেল পাওয়ার পরপর লিও শিয়া’কে গৃহবন্দী করা হয়। যদিও জানি না লিও শিয়াবো’র এ কবিতাটি পড়ার সুযোগ হয়ে উঠেছিল কিনা। কবিতাটির নাম ‘অন্ধকারের দিকে রাস্তা’। কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি এ রকম:”আজ অথবা কাল ছেড়ে যাবে আমাকে, একদিন/ আর রাস্তা থাকবে অন্ধকার, একা।/ আমি প্রার্থনা করছি/ আমি অপেক্ষাকৃত ভাল দেখতে পাচ্ছি এখন/ যেন সব স্মৃতি থেকে।/ আমি অবাক হই আমার শরীরে তোমার জন্য পূর্ণ আলো নিয়ে প্রস্ফুটিত।” এ কবিতাটি লিও শিয়া যখন লিখেছিলেন তখন তিনি জানতেন না লিও শিয়াবো’র পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় কয়েক বছরের মধ্যেই আসবে এবং লিও শিয়াবো’র জন্য তার নিজের শরীরের আলো জ্বেলে আলোকিত করতে পারবেন না কেননা তাকেও রাষ্ট্র শিয়াবোর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত গৃহবন্দী করে রাখবে।

লিও শিয়াবো’র শেষকৃত্য হয়েছে নানারকম নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে। উল্টো পরিবারের লোককে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হয়েছে যে শিয়াবো’র মৃত্যুর পর সরকার যে ব্যবস্থাপনা করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয় এবং তার জন্য তারা কৃতজ্ঞ! একজন নোবেল বিজয়ী মানবতাবাদী বিশ্বপরিচিত লেখককে যতোরকমভাবে অপমান করা সম্ভব তা করেছে চীনের গণতন্ত্রবিরোধী সরকার। এমনকি ২০১৭ সালে লিও শিয়াবোর মৃত্যুকালীন সময়ে লিও শিয়াবো ও লিয়া শিয়া’কে এক মুহূর্তের জন্যও একাকী নিভৃত সময় কাটাতে দেয়নি রাষ্ট্রনেতারা, আধূনিক চীনের সবচে’ বিয়োগাত্মক প্রেমগাঁথার জন্ম দিয়েছে তারা। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে শেষ চিঠিটি তিনি লেখেন লিও শিয়াকে, সেখানে তিনি সাহিত্য, জীবন, উপহার প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে উল্লেখ করেন: “ভালোবাসা বরফের মতো তীক্ষ্ণ, আঁধারের মতো দূরবর্তী।” তার মৃত্যুর আরও এক বছর পরে লিও শিয়া’কে মুক্তি দিতে সম্মত হলে তিনি চীন ত্যাগ করে জার্মানী চলে যান।♦

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!