ইতিহাসের বাস্তব এবং লেখকের বাস্তব: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ৫

।।শেষপর্ব।।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র সামগ্রিক ঔপন্যাসিক জীবনের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত যে-জীবনদর্শন সেটির নাম আশাবাদ নয়, হতাশাবাদ। তাঁর সাহিত্যপাঠের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে সুপ্রযুক্ত হয়েছে নানাভাবে। প্রথম উপন্যাস লালসালু-তে চলচ্চিত্রিক আঙ্গিকে বাস্তবের খণ্ড খণ্ড অবয়বের সম্মিলনে একটা পরিপূর্ণ ক্যানভাস নির্মিত হয়। প্রসঙ্গত, আমরা মনে রাখি, তিনি একজন চিত্রকরও ছিলেন। নিজের একাধিক গ্রন্থেরও তিনি প্রচ্ছদশিল্পী। দ্বিতীয় উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা-য় প্রচলিত অস্তিত্ববাদের ছোঁয়া ঔপন্যাসিকের স্বতন্ত্র শিল্পকল্পে ভিন্নতাসঞ্চারী। তৃতীয় উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো-তে চেতনাপ্রবাহ রীতির পাশাপাশি যৌথ অবচেতনার ছায়ার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। বিশেষ করে নদীর কান্নার অভিশাপগ্রস্ততা থেকে মুক্তির মানসে উপন্যাসের একেবারে অন্তিমে দর্জি রহমত শেখ যখন একটি বাছুর কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয় তখন কুমুরডাঙ্গার লোকেরাও নিজ-নিজ প্রিয় বস্তুকে নদীতে বিসর্জন দিতে শুরু করে। এ-পর্বটিকে অনেকেই কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর যৌথ অবচেতনার তত্ত্বের নিরিখে বিচার করে দেখিয়েছেন। আসলে এমন যৌথতা আমরা তাঁর প্রথম উপন্যাস থেকেই প্রত্যক্ষ করি যখন গ্রামবাসীদের সকলেই বিনা প্রশ্নে মাটির ঢিবিকে প্রাচীন এক মাজার বলে মেনে নেয় এবং যখন গ্রামের লোকেরা সম্মিলিতভাবে সমস্ত সমস্যার প্রতিষেধে ছুটে যায় মাজার অভিমুখে। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র সাহিত্যজীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাগ্রগণ্য অনুপ্রেরণার উৎসস্থল আজও রয়ে গেছে অবিশ্লেষিত। হতাশাবাদ তাঁর সবক’টি উপন্যাসের মূল সুর এবং তাঁর কোনো চরিত্রই আশাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাঁর উপন্যাসসমূহে হতাশাবাদ সর্বব্যাপী। প্রথম উপন্যাসে মজিদ ও তার স্থির-অবিচল প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় উপন্যাসে অপরাধের সাক্ষী আরেফ আলীর নিরব গ্রাম-ত্যাগ ও হত্যাকারীর শাস্তি না-হওয়া এবং তার মুক্ত-অবাধ গতায়াত এবং তৃতীয় উপন্যাসের নায়ক মুহাম্মদ মুস্তফা’র আত্মহত্যা এবং কুমুরডাঙ্গার ক্ষয়মুখী পরিণতি এইসব পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আশাবাদকে ঔপন্যাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথাও সেটিকে জায়গা করে দিতে পারেন নি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র ঔপন্যাসিক জীবনের ও জীবনদর্শনের মুখ্য অনুপ্রেরণাস্থল ফ্রাঁসোয়া-মারি আরুয়েৎ অর্থাৎ ভলত্যের। আমরা দেখবো, ভলত্যের-এর কাঁদিদ উপন্যাসের প্রত্যক্ষ প্রভাবও পরিলক্ষিত হয় তাঁর উপন্যাসে।

ফরাসি লেখক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ভলত্যের (১৬৯৪-১৭৭৮) তাঁর অসাধারণ-অননুকরণীয় কর্ম ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত-অনুপ্রাণিত করেছেন পৃথিবীর বহু মনীষী-দার্শনিক-লেখককে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতেই তিনি যুক্তিকে বৈজ্ঞানিক এষণার মানদণ্ডে বিচার করে দেখিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন সৃজনকর্মের মাধ্যমে। প্রয়োজনে তিনি খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা করতেও ছাড়েন নি, বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চের নানা অসঙ্গতির প্রতি তিনি ছিলেন ব্যঙ্গপ্রবণ। বাক্-স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্ম এবং রাষ্ট্রের পৃথকতা-স্বাতন্ত্র্য এইসব বিষয়ে স্পষ্টবাদী ভলত্যের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সরবতা থেকে সরেন নি। নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ ভলত্যের বরাবর ফরাসি রাজতন্ত্রের রোষকষায়িত দৃষ্টির ঝুঁকিতেও কাজ করে গেছেন নিজের বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা নিয়ে। অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মবিশ্বাসের অযুহাতে ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে বহুকাল আগেই আয়ত দৃষ্টির উৎসারের নমুনা তিনি রেখে যান অনাগত কালের মানবের জন্যে। জার্মান দার্শনিক গটফ্রেড উইলহেম লাইব্নিৎজ্-এর চির আশাবাদের ধারণাটিকে প্রথম প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিলেন ভলত্যের। ১৭১০ সালে ‘থিওডাইসি’ শীর্ষক তত্ত্ব প্রকাশ করেন লাইব্নিৎজ্। তাঁর প্রবল ধর্মবিশ্বাসী এ-তত্ত্ব ঈশ্বরের সর্বব্যাপী উপস্থিতির স্বীকরণ। তিনি দেখান জগতে ঈশ্বরে শুভকামী কিন্তু অশুভ ছাড়া শুভত্ব নিখুঁত হতে পারে না। অশুভর উপস্থিতি ঈশ্বরের বর্তমানতাকেই জোরালো করে বলে লাইব্নিৎজ্-এর ধারণা। জীবনের দুঃখকষ্ট বেদনাভোগ সবই বস্তুত ঐশ্বরিক- সেসবের ভোগান্তি মানুষকে এই বোধে উদ্দীপ্ত করে যে এসব না থাকলে মানুষ ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ হতো না- লাইব্নিৎজ্-এর এমন দর্শনে আস্থাশীল ছিলেন না ভলত্যের। নিজের জীবনের বাস্তব প্রত্যক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে তিনি ঝালাই করতে চান প্রকৃতির যৌক্তিক কার্যকারণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বস্তুত ১৭৫৫ সালের এক মর্মন্তুদ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় প্রবলভাবে নাড়া খায় আশাবাদ সম্পর্কিত ভলত্যেরের প্রচলিত ধারণা এবং তিনি এরপর থেকে আর আশাবাদকে প্রচলিত ধার্মিক অর্থে তো নয়ই, পূর্বসূরী লাইব্নিৎজ্-এর দৃষ্টিকোণ থেকেও মেনে নিতে নারাজ। ১৭৫৫ সালের নভেম্বর মাসে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর লিসবনে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প-সুনামির ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় লাখখানেক লোক মারা যায়। ধ্বংস হয়ে যায় লিসবন শহর। ভলত্যের সে-সময়টাতে ছিলেন জেনেভায়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি রচনা করেন একটি দীর্ঘ কবিতা যেটির শিরোনাম ‘পোয়েম সুঘ্ ল্য দেজাস্ত্রে দ্য লিজবোন্ উ এক্সামেন্ দ্য সেৎ আকসিওম্ ‘তুতে বিয়াঁ’ যেটির অর্থ দাঁড়ায় ‘লিসবনের ভয়ংকর ধ্বংস বিষয়ক কবিতা এবং স্বতঃসিদ্ধ সত্য ‘সবকিছু মঙ্গলময়’ ধারণাটির নিরীক্ষা’। কবিতাটিতে ভলত্যের প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত রীতি এবং ধর্মীয় ধারণার মধ্যকার অসঙ্গতিকে ধরেন এবং কেন ঈশ্বর এমন ভয়ংকর ধ্বংসের মাধ্যমেই তাঁর সত্তার জানান দেন সেটিরও কোন কারণ খুঁজে পান না। অর্থাৎ তিনি একই সঙ্গে সমালোচনা করেন লাইব্নিৎজ্-এর এবং প্রচলিত ধর্মেরও। বিষয়টি তাঁর মানসে এমনই দৃঢ় ছাপ ফেলে যে এটি পরবর্তীকালে ভলত্যেরের জীবনের এক মৌলান্বেষায় পরিণত হয়। লক্ষ করা যাবে, পরবর্তীকালে (১৭৫৯) প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস কাঁদিদ-এ একটি বড় অংশ জুড়ে আছে লিসবনের সেই ভূকম্প-সুনামির ঘটনা এবং উপন্যাসটির উপ-শিরোনাম ‘আশাবাদ’। লাইব্নিৎজ্-এর ‘আশাবাদকে’ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রে তিনি খ্রিস্টধর্মীয় যুক্তিতর্কাতীত দৃষ্টিরও সমালোচক। কাঁদিদ উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে আমরা দেখবো ভূকিম্পের সময়টাতে উপন্যাসের নায়ক কাঁদিদ লিসবন সমুদ্রবন্দরের নিকটে এক জাহাজযাত্রী। জাহাজযাত্রীরা কোনরকমে রক্ষা পায় প্রলয়ংকর দুর্ঘটনা থেকে। উপন্যাসটিতে বাস্তব জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন ভলত্যের যে জীবন এবং কল্পনার সীমারেখা একাকার হয়ে গেছে। আমরা দেখতে পাই দুর্ঘটনায় নিহত হয় সৎ মানুষ আনাব্যাপটিস্ট কিন্তু বেঁচে যায় দুষ্ট-অসৎ নাবিক অর্থাৎ নির্দোষ মরে কিন্তু বেঁচে থাকে পাপী। কিংবা সুরিনামের সেই ‘নিগ্রো’ লোকটির কথা বলা যাবে যার জীবনের মর্মন্তুদ ভোগান্তির কী যুক্তি থাকতে পারে, যে কিনা তার মালিকেরই নৃশংস হত্যার শিকার। কাঁদিদ-এ এমন যুক্তিও লক্ষ করা যাবে যেটির দ্বারা বোঝানো হয়, ধর্ম আসলে সংযোগের সেতু নয় বরং বিভেদের নিয়ামক। অশুভকে অদৃষ্টবাদের দোহাই দিয়ে মানুষ যুক্তি খাড়া করে। উপন্যাসের ২৮-তম অধ্যায়ে দেখবো কাঁদিদ তাঁর গুরু প্যানগ্লসকে জিজ্ঞ্যেস করছে- যখন তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে বৈরী প্রতিপক্ষ, যখন মানুষের ব্যবচ্ছেদ চলে অন্যায়ভাবে, যখন চাবকানো হয় যুক্তির দোহাই দিয়ে, যখন প্রতিকূল স্রোতে সাঁতরে মরে লক্ষ-লক্ষ লোক তখনও কী বলবে, সব ভালো’র জন্যেই হচ্ছে! কাঁদিদ-এ প্যানগ্লস চরিত্রটির চির-আশাবাদ যেন লাইব্নিৎজ্-এর দর্শনের প্রতিনিধিত্ব। প্যানগ্লসের বিশ্বাস, লিসবনের ভূমিকম্প-সুনামি যতই ওলটপালট ঘটাক না কেন এর মর্মার্থ হলো জগতে সবকিছুই নিয়মানুযায়ী চলমান। বস্তুত ভলত্যের তাঁর উপন্যাসে শুভ ও অশুভ’র পারস্পরিক দ্বান্দ্বিকতার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত একথাই বলতে চেয়েছেন, জগতে অশুভ থাকবেই কিন্তু তাকে মোকাবেলা করতে হবে সাহস এবং দৃঢ় চেতনার শক্তিতে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র সব উপন্যাসেই শুভকে ছাপিয়ে অশুভ’র অগ্রসরণ। ব্যক্তিক-সামাজিক ক্ষমতার অশুভ নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানের অচলায়তন, অশিক্ষা-কূসংস্কারের সর্ববিস্তার এসবকিছুর মধ্যে কোনোভাবেই যেন জায়গা করে নিতে পারে না জীবনের সৎ চেতনা। পূর্ববঙ্গের ভয়ংকর নেতিবাচক জীবনবাস্তবতাকে শব্দশিল্পের অবাস্তব যাদুর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় অহৈতুকী ইচ্ছের ইতিবাচকতায় রূপ দেওয়ার মত বিলাসী শিল্পনির্মাতা ছিলেন না তিনি। যে-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের সমাজ বিকশিত হয়েছে, ইতিহাস হয়েছে আবর্তিত তাতে যত আঁধারাচ্ছন্নতাই থাকুক না কেন সেটিকে অঙ্গীকারাবদ্ধ শিল্পচেতনায় উপস্থাপন করার দায় প্রথমাবধি সৈয়দ ওযালীউল্লাহ্য় লক্ষণীয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্পাঙ্গিক তাঁর উপন্যাসে যান্ত্রিকতার গড্ডল প্রবাহে রূপ পরিগ্রহ করে নি, সেসব আঙ্গিক প্রাণময়তা পেয়েছে ভিন্নতর উদ্ভাবনীর স্পর্শে। ভলত্যেরের সাহিত্যে প্রতিফলিত অশুভ তৎপরতার ক্রিয়তাকে ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন অপূর্ব সৃজনদক্ষতায়। ইতিহাসের সত্যকে সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে, সমাজের চরিত্রকে ইতিহাসের খাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই তিনি পৌঁছেছেন পরিণামে। ধীরাগ্রসর সমাজজীবনের চংক্রমণে বাড়তি গতির সঞ্চার ঘটাবার উদ্যোগ তাঁর উপন্যাসে লক্ষ করা যায় না। আবার, ১৯০০ থেকে ১৯৬৫/৬৬ সালের কালপরিসর একটা অনড় জায়গাতেও সীমাবদ্ধ থাকে নি। অশুভ শক্তি, ক্ষমতার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষীণ স্রোত আমরা অনিবার্যভাবে অনুভব করি। প্রথম উপন্যাস লালসালু-তে আক্কাস স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি, সেখানে জয়লাভ করেছে ধর্মীয় চেতনা- গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হযেছে মক্তব। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা-য় অর্থাৎ প্রথম উপন্যাসের অর্ধশতাব্দী কাল পরে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যদিও বড়বাড়ির সে-স্কুল পুরুষদের জন্যে। কিন্তু অন্তপুরে যুবক শিক্ষকের গৃহশিক্ষকতার আওতায় ছেলেদের পাশাপাশি থাকে মেয়েরাও। এ-উপন্যাসে অশুভ’র এবং ধর্মীয় ক্ষমতার সামাজিক আধিপত্যের কমতি অবশ্য দেখা যাবে না। প্রথম উপন্যাসে সমস্ত শক্তির একক উৎস ছিল মজিদ, ফলে অন্য কারও বা অন্য কোনো সৎ চেতনাধারী ব্যক্তির নায়ক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না। চাঁদের অমাবস্যা-তেও হত্যাকারী কাদেররাই তথা অশুভ শক্তিই প্রভাববিস্তারী কিন্তু প্রথম উপন্যাসের শিক্ষিত যুবক আক্কাসের চাইতে আরেফ আলীকে অন্তত খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখবো। আক্কাসের প্রবল অক্ষমতাকে খানিকটা হলেও সরিয়ে দিতে পারে আরেফ, থানায় গিয়ে হত্যাকারীর নাম প্রকাশের চেষ্টা চালাতে পারে। তবে, সে-প্রচেষ্টা ব্যর্থতারই নামান্তর। তবু হত্যাকারী কাদের এবং যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর অবস্থান প্রায় সমান্তরাল। তৃতীয় উপন্যাসে স্কুলশিক্ষয়িত্রী সাকিনাকে পাই যে-নারী প্রথম নদীর কান্নাটি শোনে। রোজ সকালে সে প্রবল পুরুষ-দৃষ্টির মধ্য দিয়ে সরু পথ ধরে হেঁটে যায় কর্মস্থলে তবু নারীশিক্ষার ক্ষীণ আলোক বয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায় সাকিনাকে। মজিদ এবং কাদেরের মত দৃর্বৃত্তদের নায়ক হওয়ার মত পরিস্থিতি অপস্রিয়মাণ এটা স্পষ্ট। কিন্তু একটা প্রবল সংশয়িত অমীমাংসিত অবস্থার মধ্যে ব্যক্তি ও সমষ্টির অবস্থিতি। অশুভ এবং দৃর্বৃত্তাচারের কবল থেকে যেন সহজেই রেহাই নেই। মুস্তফা’র আত্মহত্যা সেই বাস্তবতারই প্রতিচিত্রণ। আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে এক মর্মন্তুদ অসহ্য বর্তমানের হাত থেকে নিষ্ক্রান্তি চেয়েছে মুস্তফা। ভলত্যের তাঁর কাঁদিদ-এ বাস্তবতার ভয়ংকর চেহারাটাকে দেখান। বিশ্বের নানা দেশে পর্যটনের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি হয় কাঁদিদ। লাইব্নিৎজ্-এর আশাবাদকে বলতে গেলে ধূলোয় মিশিয়ে দেন ভলত্যের। কিন্তু এতকিছুর পরেও উপন্যাসটির উপ-শিরোনাম ‘আশাবাদ’, এতকিছুর পরেও উপন্যাসটির সর্বশেষ বাক্য – “আমাদেরকে আমাদের বাগানগুলি চাষ করতে হবে।” সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র ভলত্যের অনুসৃতি যান্ত্রিক নয়, সৃজনস্পর্শে ভিন্ন চেতনাবাহী। প্রথম উপন্যাস লালসালু-তে ম্রিয়মাণ হলেও আশাবাদ ছিল, যেজন্যে আমরা বলেছিলাম, মাজারের গায়ে জমিলা নয় লেগে ছিল ঔপন্যাসিকের পা। দ্বিতীয় উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা-য় পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। হত্যাকারী মানে অশুভ শক্তির ভয়ংকর উৎস মুক্ত-স্বাধীন, শুভ সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচছে প্রাণে। তৃতীয় উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো-তে অশুভ’র সর্বব্যাপী বিস্তারের চাপে আত্মহত্যার মত জীবনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হয় শুভকে। ভলত্যেরের জগতের মতই অবরুদ্ধ-অশুভাশ্রিত জগতের মানুষ অন্যায় পরিণামের শিকার। কাঁদিদ-এ দেখতে পাই, নিরীহ-অপাপবিদ্ধ লোকেরা বৈষম্য অনাচার এমনকি প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় মারা পড়ে, শিকার হয় দুর্ভোগের। ওয়ালীউল্লাহ্’র কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে সেরকম লোকেদের দেখা পাই আমরা। বলা হয় তারা ‘হরতনপুর নামক একটি অখ্যাত গ্রামের’ লোক কিন্তু তারা যে আসলে পূর্ববঙ্গেরই জনসমষ্টির প্রতিনিধি সেটি বোঝা যাবে ঔপন্যাসিকের বিবরণ থেকে-
“লোকটি হতভাগ্য- এমনই হতভাগ্য যে এক বছর যদি বিনা বৃষ্টির দরুন তার ফসল ধ্বংস হয় অন্যবছর ভস্মীভূত হয় নিদারুণ অগ্নিকাণ্ডে, যার প্রিয়জন একে একে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, যার বিষয়-সম্পত্তি হাতছাড়া হয় দুর্বৃত্ত লোকের কারসাজিতে, কাঠ কাটতে গিয়ে কাঠে না পড়ে যার পায়েই কুঠার নেবে আসে নির্মমভাবে, অবশেষে মেঘশূন্য আকাশে বজ্রাঘাতের মত অকারণেই যেন ভাগ্য-পরাক্রান্ত লোকটি পঙ্গু হয়ে পড়ে।”

ভলত্যেরের সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র আরও চমকপ্রদ সাদৃশ্যের উল্লেখ করা যায়। লিসবনে ভূকম্প-সুনামির পরে সেটির ভয়াবহতায় ধ্বংস হয় গোটা শহর, মৃত্যুবরণ করে ৩০,০০০ (কারও মতে ১ লক্ষ) লোক। এরপরেই ঘটে ‘অতো-দ্যু-ফে’-র ঘটনা। শব্দটি মূলত পর্তুগিজ (অতো-দা-ফে) মানে স্পেন-পর্তুগালেই এটির উদ্ভব। পঞ্চদশ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত স্পেন, পর্তুগাল, মেক্সিকোতে এর প্রচলন ছিল। প্রকাশ্যে পুড়িয়ে হত্যা করে অপরাধীকে শাস্তিপ্রদানের ভয়াবহ প্রথাটির প্রসঙ্গে এমন সংস্কারও জড়িয়ে ছিল যে পাপীকে পুড়িয়ে মারলে আসন্ন কোনো বিধ্বংসী-ভয়াবহ বিপদ বা প্রলয়কাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বহু নিরীহ মানুষকে এমন বিধানের বলি হতে হয়েছে দেশে-দেশে। ভয়ংকর ভূকম্প-সুনামির পরপরই লিসবনের ক্ষমতাধিপতিরা আয়োজন করে ‘অতো-দ্যু-ফে’ উপলক্ষ্যের। কিন্তু ভলত্যের তাঁর কাঁদিদ উপন্যাসে এটাই দেখাতে চেয়েছেন, মানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করে পুড়িয়ে মেরে ফেললেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা জীবনবিধ্বংসী দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। ভলত্যেরের যুক্তিপ্রবণ-বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা উপন্যাসটির মূল প্রতিপাদ্য। তাছাড়া কাঁদিদ-এর উপ-শিরোনাম ‘আশাবাদ’-এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ বা ব্যাজস্তুতিরই আভাস। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে সাকিনার শোনা নদীর কান্নাস্বর যখন প্রায় সমস্ত কুমুরডাঙ্গাবাসীর শ্রুতির অনিবার্য উপাদানে পরিণত হয় এবং তারই সমান্তরালে বিপন্ন জনপদটি বিপন্নতর হতে থাকে ‘মধ্যযুগ’মুখী অভিসরণে তখন সেখানকার সমাজবিধায়ক-কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে আয়োজিত হয় আসন্ন অমঙ্গল বা বিপদ বা জীবনাধোগতি থেকে মুক্তির আনুষ্ঠানিকতা। ঔপন্যাসিকের ব্যঙ্গ ও কৌতুকপ্রবণ ভাষ্যে রূপায়িত পর্বটির খানিকটা অংশ লক্ষ্য করা যাক-
“কিছু সভা-মজলিস আলাপ-আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে কান্নাটি শয়তানের কারসাজি হবে: শয়তান বহুরূপী। তারা স্থির করে কিছু একটা করতেই হবে যাতে কান্নাটির হাত থেকে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা মুক্তি পায়। তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে ক্ষীণতম দ্বিধাও দূর হয় তাদের মন থেকে যখন তোবারক আলী মুন্সীর ঘোর পর্দানশীন স্ত্রী জয়নাব খাতুনের বিস্ময়কর আচরণের খবর শুনতে পায়। যে-জয়নাব খাতুন জীবনে কখনো বাইরের দরজার চৌকাঠ অতিক্রম করেনি সে-ই নাকি মধ্যরাতে বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের মত নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলো। মোল্লা-মৌলবীরা এবার রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়ে, আর বিলম্ব করে না। তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে আজানের ব্যবস্থা করে যাতে তার আওয়াজ শহরের সর্বত্র পৌঁছায়, প্রত্যেক শহরবাসীর কর্ণগোচর হয়। সঙ্গে-সঙ্গে মিলাদ পড়ানো বা ছদকা-শিরনি দেয়ার ব্যবস্থা করে। একদিন রাতে মসজিদে অনেক রাত পর্যন্ত বিশেষ নামাজেরও আয়োজন করে। তাতে শরিক হলে বিচিত্র কান্নার আওয়াজ বন্ধ হবে- এই বিশ্বাসে অসংখ্য লোক জড়ো হয় মসজিদে, অনেক রাত পর্যন্ত নামাজীদের সমবেত বলিষ্ঠ কণ্ঠধ্বনিতে রাতের আকাশ খণ্ডবিখণ্ড হয়। তবে এ-সবের কোন ফল হয় নি।”

কাঁদিদ-এর সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসটির শিরোনামের ধ্বনিগত সাম্যের বিষয়টিকে সমাপতন বললেও ‘অতো-দ্যু-ফে’ এবং কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের বিবিধ আনুষ্ঠানিকতার পর্বের সাদৃশ্য অনিবার্য। যদিও কাঁদিদ-এ লিসবনের অপরাধীদের নির্মম অগ্নিদাহর মত উপলক্ষ্যের শিকার হতে হয় না কুমুরডাঙ্গাবাসীদের। ঘটনার সময় লিসবনে উপস্থিত কাঁদিদ এবং তার গুরু প্যানগ্লসকেও নির্যাতন সইতে হয়। কিন্তু এতকিছুর পরেও, ভলত্যের বলছেন, ঐ দিনই ফের ঘটে ভূমিকম্পের ঘটনা। এইসব দেখে অসহায় কাঁদিদ নিজেকেই প্রশ্ন করে- “এই যদি হয় সম্ভাব্য পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে শ্রেয় তাহলে অন্যগুলোর অবস্থা কেমন হতে পারে?” অসহায় প্রশ্ন উচ্চারিত হয় কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসেও- “যিনি বিশ্বচরাচর চাঁদ সূর্য তারা পাহাড়-পর্বত সাগর-সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন, তিনিই যদি কাঁদতে শুরু করেন তবে মানুষের কি হবে, কোথায়-বা সে শক্তি পাবে?”

বিশ্বসাহিত্যস্নাত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বিত দৃষ্টিতে নির্মাণ করেছেন তাঁর উপন্যাসের বাস্তব। সাহিত্যের ভাব-আঙ্গিক-কুশলতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বহুস্বর অনুপ্রেরণা তাঁর মধ্যে বর্তমান কিন্তু নিজের লেখালেখিতে তাঁর মৌলিকতা অবিস্মরণীয়। ভলত্যেরের অনুপ্রেরণা তাঁর সমগ্র সাহিত্যজীবনে সর্বাধিক হলেও আশাবাদের প্রশ্নে তিনি অতিক্রম করে গেছেন তাঁকেও। কেননা, ওয়ালীউল্লাহ্’র সাহিত্যে হতাশাবাদই একমাত্র আশা যেটি দিয়ে তিনি একটি নির্দিষ্ট কালপরিসরের পূর্ববঙ্গের জীবন ও সমাজকে শিল্পায়িত করেছেন। এক প্রবল ফ্যান্টাসি-কল্পনায় তাঁর তিনটি উপন্যাসকে একটি অনুপম ট্রিলজিরূপে চিহ্নিত করা যায় যদি চাঁদের অমাবস্যা’র দাদাসাহেব এবং কাদেরকে ধরা যায় লালসালু’র মজিদেরই দুই পুত্র হিসেবে এবং যদি মুহাম্মদ মুস্তফা’কে (কাঁদো নদী কাঁদো) বিবেচনা করা হয় দাদাসাহেব আলফাজ উদ্দিন চৌধুরীর পুত্র রূপে তাহলে তিনটি উপন্যাসেই গ্রামের নাম মহব্বতনগর এবং সেই ট্রিলজি’র শিরোনাম হবে আশাহীন বাগান। তবে, যদি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৭১-এর অক্টোবরে মৃত্যুবরণ না করে প্রত্যক্ষ করতেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা তাহলে জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান কেমন হতো সে-প্রশ্ন করা যায়, যদিও সে-প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই, উত্তর হয় না।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!