।।বারো।।
ফোন পেয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন নবীন মাস্টার। আজকাল আবার এ রকম হয় নাকি! আগে এ সব হত। শুধু এ দেশেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। এক সময় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এবং ব্রাজিলে উন্নয়নের নামে এই ভাবেই কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ওই দেশগুলোও ছিল আমাদের এই দেশের মতোই কৃষিপ্রধান দেশ। ফলে পনেরো বছরও লাগেনি, ওই দেশগুলো পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশে পরিণত হয়েছিল। এই রাজ্যের নেতারা নাকি বামপন্থী! সংস্কৃতিবান! পড়াশোনা করা লোক! তা, তাঁরা কেউই কি ওই সব ইতিহাস পড়েননি!
এক্ষুনি আইন জারি করা উচিত, শুধু এম পি, এম এল এ বা কাউন্সিলর নয়, সামান্যতম নেতা হতে গেলেও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে তাঁর। শিক্ষা মানে নামের পাশে বি এ, এম এ, এল এল বি, পি এইচ ডি ডিগ্রি নয়, শিক্ষা থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা।
আর স্থির থাকতে পারেননি নবীন মাস্টার। সুভাষগ্রাম থেকে সোজা চলে এসেছিলেন আঁধারগ্রামে। গ্রামে তখন টহল দিচ্ছিল বেশ কিছু পুলিশ আর পুলিশের পোশাক পরা সি পি এমের কয়েক জন ক্যাডার।
ভাগ্যিস তাঁর চেহারায় একটা গ্রাম্য ছাপ আছে। তাই তাঁকে গ্রামে ঢুকতে দেখেও কেউ সন্দেহ করেনি। যেহেতু ওরা এই গ্রামের কেউ নয়, তাই ওরা জানেও না উনি এই গ্রামের কি না। হয়তো ভেবেছিল, উনি এই গ্রামেরই কেউ, অথবা এই গ্রামেরই কারও আত্মীয়। তাই তাঁকে জেরা করা তো দূরের কথা, একবারের জন্যও কেউ জিজ্ঞেস করেনি, আপনি কোথায় যাবেন?
অবশ্য জানতে চাইলে, ওঁর উত্তর রেডি করাই ছিল। আর এত দিন ধরে নাটকের সঙ্গে যুক্ত তিনি, সত্যির মতো করে কি এটুকু মিথ্যে বলতে পারতেন না! নিশ্চয়ই পারতেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলতেন, আমি আমার মাসির ছেলের কাছে যাচ্ছি। কিন্তু সে সবের আর কোনও দরকার হয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে গ্রামে ঢোকার সময় হঠাৎ ক’হাত পিছন থেকে একজন শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী কত্তা, কই যাইবেন?
উনি বলেছিলেন, তেরো নম্বরের বাড়ি।
লোকটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে হয়?
উনি উত্তর দেওয়ার আগেই লোকটা ফের প্রশ্ন করেছিলেন, কোত্থেকে আইতাছেন?
সেটারও উত্তর না শুনে লোকটা আবার জানতে চাইলেন, কী করেন?
দু’-চার কথার পরেই মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ভিতরে ঢোকার সময় তাঁর কাছেই নবীন মাস্টার জানতে চেয়েছিলেন, শুনলাম এখানকার চাষের জমি নাকি টাটারা কেড়ে নিচ্ছে?
– কাড়বে কেন? টাকা দিয়া নিতাছে।
কথাটা শুনে একটু খটকা লাগল তাঁর। উনি তেরো নম্বরের মুখে যা শুনেছিলেন, তার সঙ্গে তো এর কথা মিলছে না! তবু বললেন, না, শুনলাম…
কথা শেষ করতে দেননি নবীন মাস্টারকে। লোকটা বলেছিলেন, অনেকে অনেক কথা কইতাছে। আসলে কী জানেন, হিংসা। বড়লোক গো দেইখা লোকের হিংসা হয়। ওরা ব্যবসা করব। আরও টাকা করব। করতে দিমু না। বেশি টাকা দিলেও জমি দিমু না। আমার ও সব নাই। আমি তো আমার জমি দিয়া দিতাছি।
মাথার উপর সূর্য গনগন করছে। চার দিকে গাছপালা। ফুরফুর করে হাওয়া বইছে। তাই বাঁচোয়া। না হলে এই রোদের মধ্যে এই বয়সে এতটা পথ হাঁটতে পারতেন না। ঘেমে-নেয়ে একশা হতেন। কাহিল হয়ে বসে পড়তেন কোনও গাছের তলায়। হয়তো কথা বলার মতো অবস্থাতেও থাকতেন না। কিন্তু তা হয়নি। গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে তাঁর ভালই লাগছে। আরও ভাল লাগছে, হঠাৎ করে একজন সঙ্গী পেয়ে যাওয়ায়। কথা বলতে বলতে হাঁটলে বোঝাই যায় না, কতটা পথ এলাম! তাই কথাটা চালু রাখার জন্যই নবীন মাস্টার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কত বিঘে ছিল?
লোকটা বললেন, তিন বিঘা।
– চাষ করতেন না?
– কে করবো? ছেলেরা সব চাকরি করে। ভাগচাষিকে দিয়া চাষ করাইতাম। কোনও লাভ নাই। তাই…
তেরো নম্বর আর তার সঙ্গী-সাথীদের কথা শুনে উনি যতটা তেতে উঠেছিলেন, এখন যেন এই লোকটা তার মধ্যে ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন। উনি বুঝতে পারলেন, এখানে দু’ধরনের লোকই আছে। কেউ জমি দেওয়ার পক্ষে। কেউ বিপক্ষে। এই লোকটা নিশ্চয়ই পক্ষে। ওদের কথা তো অনেক শুনেছি। এ বার এঁর কথা একটু শোনা যাক। তাই তাঁর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের বাস্তব এবং লেখকের বাস্তব: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (দ্বিতীয় পর্ব)
আঁধারগ্রামে ঢুকে নবীন মাস্টার বুঝেছিলেন, দু’হাজার ছয় সালের মে মাসের নির্বাচনে এই বামফ্রন্ট সরকার, বিশেষ করে এই সরকারের বৃহত্তম শরিক দল সি পি এম রাজ্যের মানুষের উন্নয়ন এবং প্রচুর কলকারখানা তৈরি করে বেকার সমস্যা সমাধানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ভোটে জিতেও যদি তার সামান্যতমও কিছু না করে, অন্তত লোক দেখানোর জন্য, তা হলে পরের নির্বাচনেই যে তাদের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী, এটা বুঝতে পেরে তারা উঠেপড়ে লেগেছে।
আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বড় বড় শিল্পপতিরা। ২০০৬ সালের ১৮ মে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রথম দর্শনপ্রার্থী হলেন টাটা কোম্পানির কর্ণধার রতন টাটা। তাঁদের মধ্যে কী শলা-পরামর্শ হল, কেউ জানতে পারল না। তার পর দিনই ১৯ মে রতন টাটা এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক লাখ টাকা দামের গাড়ি তৈরির প্রস্তাবিত প্রকল্পের কথা যৌথ ভাবে ঘোষণা করলেন।
বোঝা গেল, মুখ্যমন্ত্রী হয়েই তিনি যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন, এ রাজ্যে এত বড় একটা বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন, রাজ্যবাসীর কাছে বড় মুখ করে বলার জন্যই রতন টাটার টোপটা যে গত কাল বুদ্ধদেব গিলেছেন এবং তার জন্য যে, যে-কোনও মূল্যে রতন টাটাকে তাঁর পছন্দ মতো যে কোনও জায়গা দেওয়ার আগাম প্রতিশ্রুতিও দিয়ে দিয়েছেন, এটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
রতন টাটা বললেন, রাজ্যের উন্নয়নে আমরা শরিক হতে চাই।
আমরা চাই, শুধু ঘরে ঘরে নয়, জনে-জনে গাড়ি পৌঁছে দিতে। রাজ্য সরকার যে দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে এই প্রকল্প চূড়ান্ত করেছে, তাতে আমি মুগ্ধ।
জানা গেল, প্রথমে ১০১৩ একর জমির কথা হলেও পরে ৯৯৭.১১ একর জমিতেই রফা হয় দু’পক্ষের মধ্যে। ঠিক হয়, গাড়ি তৈরির মূল কারখানা হবে ৬৪৫.৬৭ একরে। বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ১৪.৩৩ একরে। পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমকে দেওয়া হবে ৪৭.১১ একর। সহযোগী শিল্পকে ২৯০ একর। টাটার প্রস্তাবিত ৬৬টি ইউনিটের মধ্যে ৫৯টি ইউনিটের জন্য বরাদ্দ করা হবে ২৭১ একর এবং বাকি ৭টি ইউনিটের জন্য ১৩ একর। বৃষ্টির জল ধরে রাখার জলাধারের জন্য ২ একর আর এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট-এর জন্য ৪ একর।
কিন্তু এক লপ্তে এত বড় জমি পাওয়া যাবে কোথায়!
সারা রাজ্য ঘুরে রতন টাটার নির্বাচিত কয়েক জন উচ্চপদস্থ অফিসার শেষ পর্যন্ত যে জমিটা পছন্দ করলেন, সেটা পছন্দ হওয়ার প্রধান কারণ, এর পাশ দিয়েই তিন-তিনটি হাইওয়ে চলে গেছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। এমন রাস্তার পাশে এতটা ফাঁকা জমি পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। চূড়ান্ত করার আগে এই জমিটা সত্যিই কতটা উপযুক্ত, তা দেখার জন্য ২০০৬ সালের ২২ মে আঁধারগ্রামে এসে পৌঁছল একটা বিশাল কনভয়। তাতে যেমন ছিলেন টাটা গোষ্ঠীর মনোনীত লোকেরা, তেমনি ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের শীর্ষ অফিসারেরা। ছিলেন বেশ কয়েক জন নেতা-নেত্রীও।
চলবে…