ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ১১

।।এগার।।

তেরো নম্বরের বাড়িতে টিভি নেই। আশপাশের যে দু’-একটা বাড়িতে টিভি আছে, সবই ব্ল‍্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। অবশ্য টিভি থেকেই বা কী লাভ! বেশির ভাগ সময়ই তো লোডশেডিং থাকে। যাদের বাড়িতে সোলার সিস্টেম আছে, তাদের কথা আলাদা। তা ছাড়া কলকাতার মতো অত চ্যানেল এখানে ধরে না। শুধু ডিডি বাংলা আর দূরদর্শন। ফলে নবীন মাস্টারের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে ওর অনেক কিছুই পালটে গেছে।
যে লোকটা ওখানে রান্নাবান্না করে, প্রতিদিন সকালে ওর মুখের সামনে গরমাগরম চা এগিয়ে দেয়, সেই গোপালদার পাল্লায় পড়ে প্রত্যেক শনিবার-রবিবার রাত দশটা বাজলেই ও টিভির সামনে গিয়ে বসে। সোনি-তে তখন সি আই ডি হয়। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে। প্রদ্যুম্ন অ্যাসিসস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ হলেও, তার চেয়েও দয়াকে অনেক বেশি ওর ভাল লাগে। যেমনি হাইট, তেমনি তার চেহারা। একটা থাপ্পড় মারলে লোকে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ে।
সেখানে ও দেখেছে, কেউ খুন হলে বা কোথাও কোনও বিস্ফোরণে কারও মৃত্যু হলে কিংবা এমনি মৃত্যুকেও ওদের অস্বাভাবিক বলে মনে হলেই, ওরা সঙ্গে সঙ্গে সি আই ডি লেখা ফিতে দিয়ে সেই জায়গাটা ঘিরে ফেলে। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলে। কোথাও কোনও সূত্র পাওয়া যায় কি না, হাতে গ্লাভস পরে তা তন্নতন্ন করে খোঁজে। আর সন্দেহজনক কিছু পেলেই সেটা সযত্নে তুলে নেয়। পলিপ্যাকে ভরে মুখ আটকে অত্যন্ত সাবধানে নিয়ে যায়। দেহ তুলে নিয়ে যাওয়ার পরেও মোছা হয় না ওই দেহ ঘিরে টানা চকের দাগ। আর এখানে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল, গ্রাম বলে অত কিছু না করুক, অন্তত দু’-চারটে ছবি-টবি তো তুলবে! তাও না!
ওরা যখন ইটরাস্তায় গিয়ে উঠল, ততক্ষণে বীজেশের দেহটাকে ওই পুলিশগুলো ভ্যানটার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে সব গ্রামবাসীরা সামনের দিকে ছিল, তাদের বেশ কয়েক জন গন্ধের চোটে পিছনে সরে এলেও, কেউ কেউ মৃতদেহের পিছু ছাড়েনি। তাদেরই দু’জন রাস্তার ধারে বসে হরহর করে বমি করতে লাগল। অন্য সময় হলে কেউ না-কেউ মগে করে জল নিয়ে যেত। মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে দিত। হাত ধরে বাড়ি নয়, একেবারে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসত। কিন্তু হঠাৎ যে কী হল! সে সব কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। এই দু’জনের কাছে কাউকেই যেতে দেখা গেল না। সব ভিড় এই ভ্যানটাকে ঘিরে।
যে দু’-তিন জন পুলিশ পিছন দিকে ছিল, তারা ঝপাঝপ উঠে পড়ল ভ্যানে। আর যারা মৃতদেহটাকে বয়ে নিয়ে এসেছে, যারা ওই দেহের আশপাশে ছিল, তারা কেউই ভ্যানে উঠল না। ভ্যানে ওঠা পুলিশরা বাকি পুলিশদের ‘এই উঠে আয়, জায়গা আছে’ বললেও তাদের কেউই উঠল না। কেউ বলল, আমার সঙ্গে সাইকেল আছে। কেউ বলল, আমি ওর সাইকেলে করে আসছি। আবার কেউ বলল, তোরা এগো, আমি যাচ্ছি।
ভ্যান ঘিরে যে জটলা, তার পিছন দিকে দাঁড়িয়েছিল তেরো নম্বর। ভ্যানের দরজা বন্ধ। যে কোনও সময় ছেড়ে দেবে। শেষ বারের মতো ওকে একটি বার চোখের দেখাও দেখা হল না ওর। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ভাগ্যে না থাকলে তীরে এসেও তরী ডোবে। ওদের সঙ্গে তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতক্ষণ ধরে কথা না-বললে ও নিশ্চয়ই ওকে দেখতে পেত। মনে মনে ও বলল, হে ঈশ্বর, ওকে যদি একটি বার দেখতে পেতাম!
ঠিক তখনই, যে দু’-তিন জন পুলিশ মৃতদেহের সঙ্গে ভ্যানে উঠেছিল, তারা পিছনের দরজার ঢাউস দুটো পাল্লার একটা খুলেই হাত দিয়ে নাক-মুখ চেপে লাফ মেরে নীচে নেমে রাস্তার এক ধারে বসে পড়ল। ওয়াক ওয়াক করতে লাগল।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ ১০

নামার পর দরজা দেওয়া তো দূরের কথা, দরজাটাকে ঠেলে দেওয়ারও ফুরসত পায়নি ওরা। ফলে ভ্যানের দরজাটা হাট করে খোলা। তাই পুরো ভিড়টাই ওই দরজাটার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
ঈশ্বর তার কথা শুনেছেন, ওই তো দরজা খোলা। যাই, ওকে একবার দু’চোখ ভরে দেখে নিই। কথাটা ভাবামাত্র তেরো নম্বর সেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিন্তু যারা গেটের কাছে যাচ্ছে, তারা কেউই দু’-এক মুহূর্তের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এক ঝলক দেখছে কি দেখছে না, নাক চেপে বেরিয়ে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনের ভিড়টা আগের থেকে অনেক পাতলা হয়ে যেতেই, একটু ঠেলেঠুলে ভ্যানের দরজার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল তেরো নম্বর। দেখল, দু’দিকের টানা সিটের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় বীজেশের দেহ শুইয়ে রাখা আছে। পুরো শরীরটাই পলিশিট দিয়ে মোড়া। মুখ তো দূরের কথা, পায়ের একটা কড়ে আঙুলও দেখা যাচ্ছে না।
আচমকা ভক্ করে একটা পচা গন্ধ ওর নাকে এসে আছড়ে পড়ল। কাল রাতে গ্রামে ঢোকার সময় পোড়ো শিব মন্দির থেকে বেরিয়েছিল ও। প্রচণ্ড ঝড়ে মড়মড় করে ভেঙে পড়া গাছের ডালের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য যখন পাকুড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিল, তখন এই গন্ধটাই বোধহয় ও পেয়েছিল! আজ যেন তার তীব্রতা আরও বেশি। আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।
হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল মৃতদেহের দু’পাশে বেঞ্চির মতো টানা লম্বা সিটে। না, পোশাক-আশাক বা চেহারা দেখে এদের কাউকেই পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না! তা হলে এরা কারা! এরা কি গন্ধ-টন্ধ কিছুই পাচ্ছে না! নাকও তো চেপে ধরেনি। তা হলে!
না, আর পারা যাচ্ছে না। কী বীভৎস গন্ধ! শরীর গুলিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে পেট থেকে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে। মানুষ মরে গেলে এ রকম গন্ধ হয়! ওদের খতম তালিকায় ওর নাম তো তেরো নম্বরে। বীজেশের অনেক আগেই ওর মরার কথা। বীজেশের জায়গায় যদি তাকে এই ভাবে ওরা মেরে ফেলত, তার দেহ থেকেও কি এ রকম দুর্গন্ধই বেরোত!

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: পঞ্চব্রীহি 

পিছনে যে কয়েক জন উঁকিঝুঁকি মেরে তখনও বীজেশের দেহ দেখার জন্য হাঁকপাক করছিল, ও গুঁতোগুতি করে তাদের প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। প্রথমেই বুক ভরে বেশ কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিল। তার পর একটু ধাতস্থ হতেই ও দেখল, যারা বীজেশকে দেখে বেরিয়ে এসেছে, তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে সেখানে জটলা করছে। তেমনই একটা জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে রতন, শিবু, কার্তিক ছাড়াও আরও কয়েক জন।
ও গুটিগুটি পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে রতন বলল, কী রে, দেখলি?
ও বলল, দেখব কী করে? ঢাকা তো…
– দেখার মতো অবস্থায় নেই বলেই হয়তো ওই ভাবে ঢেকে রেখেছে।
– যা গন্ধ বেরোচ্ছে। নাক বন্ধ করেও ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। একেবারে পচে গেছে।
– একটু সেন্ট-টেন্ট ছড়িয়ে দিতে পারলে হত। কার্তিক বলল।
– আরে, সেন্ট দিয়ে কি ওই গন্ধ ঢাকা যায়? শিবু বলতেই রতন বলল, ওকে যে দিন কিডন্যাপ করেছিল, আমার মনে হয়, সে দিনই ওকে খুন করেছে। প্রথমে হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। পরে বুঝতে পেরেছিল, এ ভাবে লুকিয়ে রাখা যাবে না। গন্ধ বেরোতে শুরু করলেই জানাজানি হয়ে যাবে। এ দিকে, কে কখন দেখে ফেলে, এই ভয়ে, দিনের বেলাতেও বার করতে পারছিল না। তার পর কাল রাতে যখন দেখেছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, হাতে একেবারে স্বর্গ পেয়ে গেছে। জানে, সন্ধ্যা হলে এমনিতেই এ দিকে কেউ আসে না, তার উপরে আবার ও রকম দুর্যোগ, তাই সুযোগ বুঝে ওরা ওকে চ্যাংদোলা করে এনে এখানে ফেলে গেছে। না-হলে এক-দু’দিনে কি এ রকম গন্ধ হয় নাকি!
শিবু বলল, শুধু গন্ধ নয় রে, আমি তো সামনে গিয়ে দেখেছি। একদম গলে-গলে পড়ছে। ছাল-চামড়া কিছু নেই। আগুনে পুড়লে যেমন হয়, খানিকটা সে রকম।
– তা হলে কি ওকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে?
– হতে পারে।
– আগুনে পুড়লে কি পোকা ধরে?
– পোকা?
– হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম। কুঁচো ক্রিমির মতো এক ধরনের ছোট ছোট সাদা পোকা ওর সারা শরীরে কিলবিল কিলবিল করছে। তবে পোকাগুলো একটু মোটা মোটা। দুটো চোখের একটাও নেই। ইঁদুর-টিদুর বা পোকামাকড় হয়তো খুবলে খেয়েছে।
– এই চুপ কর তো… বলেই, দু’হাতে কান চেপে ধরল কার্তিক।
সবাই যখন বীজেশকে নিয়ে কথা বলছে, ঠিক তখনই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল তেরো নম্বর– ভ্যানে কয়েক জনকে বসা দেখলাম, ওরা কারা রে?
রতন বলল, ওদের চিনবি না। ওরা এই গ্রামের কেউ না।
ভ্রু কুঁচকে তেরো নম্বর বলল, পুলিশের লোক বলেও তো মনে হল না। তা হলে ওরা ভ্যানে বসে আছে কেন?
– সাধ করে বসে নেই। ওদের ধরেছে।
– ধরেছে মানে?
– ধরেছে মানে ধরেছে। অ্যারেস্ট করেছে।
– ওরা কারা?
– ওদের আমরাও ভাল করে চিনি না।
– তা হলে?
– তবে এটা বুঝতে পেরেছি, ওরা আমাদের ভাল চায়।
– ভাল চায়!
তেরো নম্বরকে অবাক হয়ে যেতে দেখে কার্তিক বলল, ওরা কী ভাবে খবর পেয়েছে, তাও জানি না। আমাদের উপরে সি পি এমের গুন্ডা বাহিনী আর পুলিশি- জুলুমের কথা শুনে ওরা নিজে থেকেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের গ্রামের ভিতরেই গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে। যখনই রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি এসে কোনও বাড়িতে আগুন ধরাবার জন্য সি পি এমের লোকেরা হাজির হয়, তখনই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের রক্ষা করে। রাত-বিরেতে সি পি এমের লোকেরা যাতে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করতে না-পারে, সে জন্য সারা রাত আড়ালে-আবডালে থেকে গোটা গ্রামটাকে ওরা পাহাড়া দেয়। পুলিশ তো ওদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের খোঁজে শুধু বাড়ি বাড়ি নয়, প্রত্যেক বাড়ির ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশি করছে। গোয়ালঘর, রান্নাঘর, এমনকী ভাড়ারঘরও বাদ দিচ্ছে না।
– কেন?
– কারণ, এরা যে সি পি এমের ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে।
– তাই নাকি? তেরো নম্বর একেবারে থ’ হয়ে গেল। সে কী করে হয়! সিপি এমের লোকদের কাছে তো শুনেছিলাম রিভলভার-টিভলভার আছে।
– এদের কাছেও আছে।
– তাই?
– তা হলে আর বলছি কি? সেই জন্যই তো পুলিশ ওদের ধরার জন্য পাগলা কুকুর হয়ে গেছে। ওরা থাকলে যে সি পি এমের অসুবিধে। তাই যে ক’জনকে পেয়েছে, ধরেছে।
– যে ক’জনকে মানে? আরও আছে নাকি?
– প্রচুর প্রচুর। কত জন আছে আমরাও জানি না। তবে এরা খুব শিক্ষিত।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!