লাভা

সেদিনের সকালটা ছিল আর পাঁচটা সকালের তুলনায় আলাদা। অসাধারণ তুলতুলে এক আবহাওয়া। মনটা কি যে ভাল লাগছিল। আসলে ঘুরতে যাওয়ার নাম শুনলেই মনটা কেমন হয়ে যায়। মনের সব দুঃখ, কষ্ট ,জ্বালা -যন্ত্রণা এক নিমেষেই উধাও। মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে যাকে ঠিক ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। বেরিয়ে এলাম আরো একবার ভালোলাগার সেই জায়গাগুলো।

খুব সকাল বেলা আমরা রওনা দিলাম শিলিগুড়ি থেকে লাভার উদ্দেশ্যে। লাভাতে অনেকবার ঘুরেছি এর আগেও। শিলিগুড়িতে থাকার কারণে অনেক সময়ই তাই শনিবার গিয়ে রবিবারেই চলে এসেছি। কখনো আবার সকালে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেও ফিরে এসেছি। তবে এবারের বেড়ানোটা ছিল একদম আলাদা। বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে ছিল আমাদের ভ্রমণ।

শিলিগুড়ি থেকে সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ডামডিম -গরুবাথান হয়ে আমরা লাভার উদ্দেশ্যে চলতে থাকি। যারা এই পথে নতুন আসবেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি; পথে চলতে চলতে সেবক ব্রিজে এসে কিছুক্ষণ অবশ্যই দাঁড়াবেন। এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য একবার দেখলে বারবার এখানেই এসে দাঁড়াতে ইচ্ছে হবে, এতোটাই সুন্দর। তিনদিক থেকে প্রেমিক পাহাড় যেন আগলে রেখেছে তার একান্ত আপন প্রেমিকা লাস্যময়ী তিস্তাকে যে চলেছে আপন মনে, আপন ছন্দে। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পথ লাভার উদ্দেশ্যে।

 

এবারে লাভা সম্পর্কে ছোট্ট করে দু একটা কথা আগে বলে নিলে ভাল হয়। লাভা একটি ছোট্ট জনপদ যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কালিম্পং জেলার আলগড়া হয়ে কালিম্পং শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। লাভা ৭,২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকটি জায়গায় তুষারপাত হয় তার মধ্যে লাভা অন্যতম। লাভা যাওয়ার সারাটি রাস্তা মনকে অন্য জগতে নিয়ে যায়, সামনের দিকে যত এগিয়ে যাওয়া যায় দুপাশে ততই নানান রকম গাছ চোখ ও মনকে আকৃষ্ট করে। এখানে পাইনের সমারোহ সবচেয়ে বেশি। সবুজ শ্যামল বনগুলি পিকনিক, ট্রেকিং এবং পাখি-পরিদর্শনের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। লাভা ধীরে ধীরে একটি প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে হ্রাস পায় এবং গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এটি প্রাচীন ভারতের সিল্ক রুটে অবস্থিত-তিব্বত বাণিজ্য রীতি। জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার থেকে গোরুবথান হয়ে লাভা পৌঁছানো যায়। গোরুবথান থেকে দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। রাস্তাটি প্রশস্ত, মসৃন এবং প্রতিটি মোড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পরিপূর্ণরূপে খেলা করে। নতুন রাস্তাটি ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সীমান্ত সড়ক সংস্থা দ্বারা নির্মিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: দার্জিলিঙের রায় ভিলা 

এবারে ফিরে আসি আগের কথায়। যেভাবে আমরা লাভার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম। উত্তর -পূর্ব দিকে গরুবাথান হয়েই পৌঁছতে হবে লাভা। গরুবাথান সংরক্ষিত বন। বড় বড় শাল -সেগুন, ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে। মাঝে মাঝে রয়েছে সমতলের সবুজ চা বাগান। পাহাড়ের ঢালে অসাধারণ সুন্দর সেই সব বিশাল চা বাগান। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল, মাঝে নাগড়াকাটার ভয়ানক জঙ্গল। লাভার রাস্তা খুব দুর্গম আর সেই সাথে গভীর খাদ। লাভা যাওয়ার পথে অনেকগুলো মাইলস্টোন আমাদের পার হতে হবে। সাপের মতো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনায়াসেই খেয়াল করা যায় গভীর খাদ। নীচে বয়ে যাওয়া একই নদী নানারকম নাম নিয়ে বয়ে চলেছে। অনেক ওপর থেকে নীচের বাড়িগুলোকে একেবারে বিন্দুর মতো লাগছে।

চলার পথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ এবং মনকে অসাধারণ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রাখছিল। চা বাগানের মাঝে মাঝে ছবির মতো গাছ, দূরে সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নির্জন, নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম। চারপাশে শুধুই মেঘে ঢাকা পাহাড়, ঘন ঝাউয়ের জঙ্গল, বয়ে চলা ঝরনা, আর নানান রং-এর ফুল। লাভার আরো একটা মজার ব্যাপার নিমেষেই প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন। এই ঝকঝকে রোদ, এই মেঘ, এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আরো যেটা অদ্ভুত লাগে, তিন চার হাত দূরেই দুরকম দৃশ্য। একদিকে বৃষ্টি -চার হাত দূরে সেই মুহূর্তেই রোদ। ভাবা যায় এমন প্রকৃতি! সবচেয়ে বড় কথা হালকা শীতে পাহাড়ের নির্জনতা মনটাকে উদাস করে দেয়।

আরও পড়ুন: শুধু বাঁশি 

লাভার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য পাইনের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। রাস্তার দু’ধারে আকাশ ছোঁয়া পাইন গাছ। একটা পাহাড়ের পেছনে আরো একটা পাহাড়। আকাশে টুকরো টুকরো সাদা বা ধূসর মেঘ, শীতের চাঁদরে ঢাকা অপূর্ব নিসর্গ। এই অঞ্চলে রয়েছে অদ্ভুত বনস্পতি। ফার, পাইন, পপলার ও অন্যান্য গাছ দিয়ে ঢাকা তার ঢালগুলো।

শিলিগুড়ি থেকে লাভার দূরত্ব প্রায় একশ দশ কিলোমিটারের মতো। সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। প্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাভার নৈসর্গিক শোভা অতুলনীয় বললেও কম বলা হয়। লাভা হল একটি পাহাড়ি গ্রাম।

কুয়াশা ও মেঘে ঢাকা পাইন গাছে ঘেরা লাভা গ্রামটি। ভূটানের সঙ্গে বাণিজ্যের পুরনো পথের মধ্যে অবস্থিত গ্রামটি রয়েছে ২৩৫০ মিটার উচ্চতায়। এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রকৃতি উপভোগ ও পাখি দেখার জন্য বিখ্যাত লাভা, নেওরাভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ওঠার সূচনা বিন্দুও।

পাহাড়ের মাথায় মুকুটের মতো সৌন্দর্যে ভরপুর এক হিমেল ঠিকানা। নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের উদ্ধত পাইনের বন এসে মিশেছে পাহাড়ের ঢালে। আর তারই মাঝে মাঝে সারি সারি বাক্সবন্দি বাড়ি। লাভার কাছেই লাভা মনাস্ট্রি। সুন্দর গুম্ফায় লামাদের স্কুল। সুন্দর মনাস্ট্রি, মেঘমুক্ত আকাশে এই গুম্ফার বারান্দা থেকে হিমেল পর্বতশ্রেণীদের দেখা মিলবে। লাভা থেকে তিন কিমি দূরে শেরপা ভিউপয়েন্ট। রেচেলা লা, জেলেপ লা-সহ নানা শৃঙ্গরাজের দেখা মেলে। লাভা থেকে নানা আকর্ষণীয় ট্রেকরুট রয়েছে। তবে যাঁরা হাল্কা ট্রেক পছন্দ করেন তাঁরা অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন ছাঙ্গে ফলস। পাইন, ধুপির পরশ জড়ানো এ পথের বাঁকে বাঁকে শুধুই রোমাঞ্চ। প্রতি মুহূর্তে নানা বন্যপ্রাণের আনাগোনা। মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরে। মায়াময় পথে পাখির কলতান শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখা মেলে সুন্দর ঝর্নার।পাহাড়, জঙ্গল থেকে চুঁইয়ে আসা সূর্যের আলোকমালায় সেই ঝর্নার গায়ে রামধনু তৈরি হয়।

লাভার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে মনেস্ট্রী , নেওরা ভ্যালী, চ্যাঙ্গী ঝর্ণা ইত্যাদি। মনেস্ট্রীর সামনে গেলে মনটা কেমন হয়ে যায়। পাহাড়ের ঢালে বানানো খুব সুন্দর আর শান্ত পরিবেশ। মনেস্ট্রীর পেছনে গেলে চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। এছাড়া লাভার খুব কাছেই লোলেগাঁও হওয়ার কারনে খুব সহজেই ওখানকার দর্শনীয়স্থানগুলো দেখে আসা যেতেই পারে। কখন যাবেন—
আসলে বর্ষার সময়টা ছাড়া যেকোন সময় লাভা ভ্রমণ করা যায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চারটি মাস এড়িয়ে চলাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
কিভাবে যাবেন-

কলকাতা থেকে বাসে কিম্বা ট্রেনে এন জে পি অথবা বিমানে বাগডোগরা পৌঁছে গাড়ি নিয়ে লাভা । শিলিগুড়ি এর জংশন টার্মিনাল থেকে জিপে করে যেতে হবে কালিম্পং। ভাড়া ১৫০ টাকা । রিজার্ভ গাড়ি ২৫০০-৩০০০ টাকা পাওয়া যাবে। কালিম্পং থেকে লাভা জীপে কিম্বা বাসে যেতে পারবেন। অথবা শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি জীপে করে লাভা যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস করে নিউ মাল জংশন নেমে ওখান থেকে জীপে করে লাভা যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন-

লাভা বাজারে গ্রীন প্যালেস (Hotel green palace)
লাভা বাজারে অবস্থিত লাভা ভিউ পয়েন্ট (Lava View Point)
হোটেল অর্কিড (Hotel Orchid)
এছাড়াও লাভাতে প্রচুর হোটেল রয়েছে।

তিন/চার দিনের পরিকল্পনা থাকলে প্রথম দিন লাভাতে সারাদিন কাটিয়ে পরের দিন অনায়াসেই চলে যাওয়া যায় লোলেগাঁও । আসলে পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গা যেন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। তাই একটি জায়গায় এলে পাশের জন হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করে। ভারী মজার ব্যাপার, অদ্ভুত আন্তরিক এবং অতিথিপরায়ন এখানকার প্রকৃতি। পরের দিন তাই মন চলে যায় লোলেগাঁওএর উদ্দেশ্যে।#

ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!