ইতিহাসের বাস্তব এবং লেখকের বাস্তব: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১

।।এক।।

ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে এম.এ. পিতার অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট পুত্রের জোড় সূরিত্ব ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এশিয়া অস্ট্রেলিয়া হয়ে শেষে চূড়ান্ত পরিব্যাপ্তি নেয় ইউরোপে গিয়ে। ছিলেন সামাজিক ও পেশাগত অবস্থানের শীর্ষে- পিতা-পুত্র দু’জনেই। এরকম পরম্পরাগত উচ্চাবস্থানে আসীন থেকে লেখালেখির মতন মজদুরিকে বেছে নেওয়াটা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। তা-ও আবার, তাঁর সেই লেখালেখিতে তাঁরই সমাজের একেবারে নিম্নতল মানুষজনের প্রাধান্য। এমনকি, তিনি যখন সুদূর ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানি বলে কথিত দেশের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত সেখান থেকেও অবলোকনে গ্রহণ করছেন সেই নিম্নতল মানুষদেরই যাঁদের তিনি শ্রেণি-প্রতিনিধি নন এবং যাঁদের সঙ্গে তাঁর মেরুপার্থক্য চিরকালীন। হ্যাঁ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র কথাই বলা হলো। লেখক কি লিখবেন, কেন লিখবেন, কাদের নিয়ে লিখবেন তার কোন পূর্বনির্দিষ্ট ব্যাকরণ কোথাও কখনও ছিল না, নেই আজও। পুশকিনের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে পূর্ব ইউরোপে এসে স্থিত না হলে পুশকিনের লেখালেখির বিষয় কি হতো কে জানে। রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেংকো’র মতে, অসাধারণ মেধাবী কবি র‍্যাঁবো’র অল্পবয়সে কাব্যচর্চা পরিত্যাগ করার কারণ তাঁর পিতার আফ্রিকায় দাসব্যবসায়। পিতার ব্যবসায়ের হাল ধরা র‌্যাঁবো’র পক্ষে সম্পূর্ণ দুই বিপরীত মেরুর (একটি মানবিক এবং অন্যটি অমানবিক) দু’টি কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়াটা সম্ভব হলেও সেটা র‍্যাঁবো’র পক্ষে হতো হিপোক্রিসি। এসবই এক ধরনের অনুমান। যেটা বাস্তব, কলকাতার ‘স্টেটস্ম্যাান’ পত্রিকার সাংবাদিক ওয়ালীউল্লাহ্’র মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল পূর্ববঙ্গের নিখাদ কৃষিজীবী মানুষের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস। এর দুই বছর আগে বেরিয়ে গেছে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারা। ১৯৪৮-এ যে তাঁরই লেখা লালসালু বেরোবে তাতে আর সন্দেহের কোনো কারণ থাকে না। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটাতেই পাচ্ছি দুর্ভিক্ষগ্রন্থ নিরন্ন মানুষের চিত্র। গল্পটি রচনাকালে লেখকের বয়স কুড়ি/একুশ। এই নতুন গল্পকার সম্পর্কে সুশীল জানা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় একটি মন্তব্য করেছিলেন- “এই জীবন-ধর্মী দৃষ্টিই আশা করি তাঁকে ভবিষ্যতে নতুন সৃষ্টির পথ দেখিয়ে দেবে।”

ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তের আরও দক্ষিণ-পূর্ব কোণের অধিবাসী ওয়ালীউল্লাহ্ সত্যিই দেখিয়েছিলেন ‘নতুন সৃষ্টির পথ’। প্রথম গ্রন্থেরই ‘খুনী’ গল্পে রচয়িতার দৃষ্টি চলে যায় অধিকতর প্রান্তিকতার দিকে। নোয়াখালি অঞ্চলের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এক রাত্রি’ গল্পের শশীভূষণ-মাস্টারের নওয়াখালি।) চরাঞ্চল সোনাভাঙা গ্রামে পটোন্মোচন ঘটে গল্পের। সাতচল্লিশে যখন দেশভাগের ‘অক্ষক্রীড়ার ক্যাবিনেট মিশন’ ইত্যাদি চলছে তখন একই সমান্তরালে চলছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র লালসালু উপন্যাস রচনার কাজ এবং দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তী বছরেই বেরিয়ে যায় সেটি। কিন্তু দেশবিভাগের গভীর-গভীরতর বেদনাকে তিনি আনচ্যালেঞ্জড্ যেতে দেন না। পূর্বজদের মধ্যে তারাশংকর, মানিক, বিভূতিভূষণ, সতীনাথ এঁদের পাশাপাশি পঁচিশ অতিক্রান্ত ওয়ালীউল্লাহ্ লিখলেন অসাধারণ একটি গল্প ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’। একটা ঘরের মধ্যে গোটা দেশবিভাগের রাজনীতি এবং দৃষ্টিকোণগুলোকে কোনো প্রকারের রাজনৈতিক ভাষ্যে না গিয়েও কীভাবে ধরা যায় তার এক প্রকৃষ্ট নমুনা তাঁর রাজনীতিসচেতন এই গল্প। ওয়ালীউল্লাহ্’র তেমন কোনো পার্টিজান রাজনৈতিক স্পৃষ্টতা ছিল না। তাঁর রাজনীতি হলো মানুষ এবং ইতিহাস ও সমাজের খাতে বয়ে যাওয়া মানবপ্রবাহ। ১৯৪৮-এ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাস প্রকাশিত হলে সেই উপনাসের প্রথম পৃষ্ঠাটি পাঠ করলেই এই বোধ জেগে ওঠে, সবকিছুকে ভাগ করে দেওয়া অসম্ভবের সম্ভব হলেও দারিদ্রকে যায় নি ভাগ করা। প্রথম উপন্যাসে রচয়িতার বিষয়বস্তু পূর্ববঙ্গের প্রায় নিস্তরঙ্গ কৃষিজীবী জনজীবন যে-জীবনের গহিনে অবিরাম জলভ্রমির মত আবর্তময় আগুনের কণা। তখন রাজনীতির বিবিধ তোড়ের মধ্যেই ছিল ঔপন্যাসিকের বর্তমানতা। কিন্তু পরবর্তী বা দ্বিতীয় উপন্যাসে তো তিনি সরে গিয়েছিলেন সেইসব তোড় থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে। সেই সরে যাওয়াটাকে আন্তমহাদেশীয় সরণই বলা যেতে পারে। অথচ উপন্যাসের পুঞ্জাক্ষীর ভেতর দিয়ে তিনি ফের চলে আসেন পূর্ববঙ্গেরই গ্রামে। “ফ্রান্সের আলপ্স্ পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে” বসে ওয়ালী লিখলেন চাঁদের অমাবস্যা। ১৯৬৫ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে চলছিল আরেক রক্তক্ষয়ী সংঘাত, ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত যুদ্ধ, যখন প্যারিসবাসী ওয়ালীউল্লাহ্’র শব্দময়দান ভরে উঠছে পূর্ববঙ্গের জীবননিংড়ানো কাঁদো নদী কাঁদো’র অব্যক্ত শব্দশস্যে। ১৯৬৮ সালে বেরোলো সেই উপন্যাস। সব মিলিয়ে তিনটি। অকালমৃত্যুর কবলে না পড়লে তিনি আর কী বিষয়ে লিখতেন সেটা বলা না গেলেও যেটুকু লিখে রেখে গেছেন সেটুকুর সূত্রে কার্ল মার্ক্সের বরাত দিয়ে আমরা বলবো, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন যাদের ভাষা নেই, যাদের ভাষা থাকলেও বলবার কায়দা জানা নেই, যাদের ভাষা প্রকাশের অধিকার-অবস্থান ছিনতাই হয়ে গেছে।

আরও পড়ূন: স্ববিরোধী নাস্তিক, প্রথাবিরোধী সাহিত্য স্রষ্টা হুমায়ুন আজাদ সর্বকালের আলোকিত মানুষ

কুড়ি বছরে তিনখানা উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ। নাটক এবং মৃত্যু-উত্তর গ্রন্থিত ইংরেজি উপন্যাস কিংবা অন্যান্য রচনাকে একসঙ্গে মেলালেও সংখ্যার বিচারে সেসব উনতাচিহ্নিতই। অথচ তাঁর তিনটি উপন্যাসের মধ্যে গাঁথা সমগ্র পূর্ববঙ্গ- সুপরিকল্পিত সেই গ্রন্থনা, কাল এবং সামাজিকতা উভয় প্রেক্ষাপটেই। মিলান কুন্ডেরা’র ভাষ্য- উপন্যাস ইতিহাসের সমান্তরাল রাস্তা, কথাটাকে মেনে নিলে ওয়ালীউল্লাহ্’র তিনটি উপন্যাসে বিধৃত ষাট/সত্তর বছরের পূর্ববঙ্গের ধারাবাহিক প্রতিচিত্রণ। এই কালপরিধির সামাজিক স্বরূপ ঘটনা, চরিত্র, ভাষা, সংলাপ, তথ্য এবং লেখকের দার্শনিকতা প্রভৃতির আঙ্গিকে এক অপূর্ব ইতিহাসালেখ্য হয়ে উঠেছে। লালসালু উপন্যাসের শতাব্দীপ্রারম্ভিকতা (১৯০১ থেকে ১৯০৫ এর মধ্যবর্তী কোনো এক কালগ্রন্থি।) চাঁদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদো’র মধ্যষাটে (দ্বিতীয় উপন্যাসটি বেরোয় ১৯৬৪ সালে এবং এটির কালগত পরিপ্রেক্ষিত ১৯৬২ সাল। শেষোক্ত উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ কালপরিধি ১৯৬৫/৬৬।) এসে প্রায় সাত দশকের একটি বৃত্ত পূর্ণ করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র সাহিত্যের মূল্যায়নে তাঁর সমকাল এবং তাঁর উপন্যাসান্তর্গত সমকাল দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নিজস্ব জীবনপরিবৃত্তের এক অর্ধেক কেটেছে স্বদেশে এবং অন্য অর্ধেক বিদেশে। তাঁর প্যারিস-বসবাস, ফরাসি স্ত্রী এবং তাঁর প্রথম উপন্যাসের ফরাসি অনুবাদের যোগসূত্রে সমালোচকদের অনেকেই তাঁর সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের ছায়াপাত লক্ষ করেন। তাঁর তৃতীয় উপন্যাসের প্রসঙ্গে এসেছে চৈতন্যপ্রবাহ রীতির উল্লেখ। আর সব মিলিয়ে, এমন সমালোচক উক্তিও চোখে পড়ে, তাঁর উপন্যাস বিষয়ে স্বদেশি এবং আঙ্গিকে বিদেশি। যদিও আন্তরবিচারে দেখা যাবে, তাঁর উপন্যাসকে হবহু অস্তিত্ববাদের ছাঁচে ফেলা মুশকিল এবং চৈতন্যপ্রবাহরীতির কাঠামোয় ফেলে তাঁর উপন্যাসের চূড়ান্ত বিচার করাটাও অসঙ্গত। মিখাইল বাখতিন পাঠের সুযোগ পান নি ওয়ালীউল্লাহ্। অথচ, বাখতিনের সাহিত্য-সমালোচনার চারটি প্রধান সূত্রের (ডায়াগ্লসিয়া, হেটেরোগ্লসিয়া, ক্রোনোটোপ এবং কার্নিভ্যাল-দ্বৈতাভাস) আলোকেই তাঁর উপন্যাসগুলো হয়ে উঠতে পারে আশ্চর্য রকমের আলোকিত। হ্যাঁ, তাঁর বিশ্বপর্যটন এবং সুদীর্ঘকালীন ইউরোপাভিবাসের ফলে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাদির পঠন-পাঠন সম্ভবপর হয়েছিল ওয়ালীউল্লাহ্’র পক্ষে। সাহিত্যতত্ত্ব এবং সাহিত্যসমালোচনার নানা রীতিপদ্ধতি হয়তো তাঁর অধিগতই ছিল। কিন্তু সৃজনশীল রচয়িতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সাহিত্যজগতকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর নিজস্বতার গুণেই। তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রসঙ্গে বিদেশি সাহিত্যাঙ্গিক স্মরণযোগ্য হলেও আমরা দেখবো তিনি কোনো সাহিত্যাঙ্গিকের অন্ধ অুনকারক হ’ন নি এবং সমালোচকদের উল্লেখ করা আঙ্গিকসমূহের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যের প্রভেদ মৌলিক।

একটু আগেই বলা হলো, বিশ্বসাহিত্যের পঠন-পাঠন এবং বিদেশ-অধিবাসের সূত্রিতা ওয়ালীউল্লাহ্’র জীবন এবং সাহিত্য দুই অভিজ্ঞতাকেই সমৃদ্ধ করেছে। ফলে, এটি ভাবা অসঙ্গত নয়, তাঁর উপন্যাসের বাক্সংযম, পরিমিতিবোধ, প্রখর সংলাপ, পল্লবগ্রাহিতার বিপরীত বিশ্লেষণধর্মিতা এইসব কুশলতা তাঁর অর্জিত পূর্বাভিজ্ঞতার প্রতিফলন যা কালক্রমে সূক্ষ্মতার মাত্রিকতাস্পর্শী। কিন্তু তাঁর কুড়ি/একুশ বছর বয়সে লেখা ছোটগল্পের দিকে দৃষ্টিপাতে ঘটে ভিন্ন উন্মোচন। তখনও তাঁর বিশ্বসাহিত্যের আয়ত পাঠ কিংবা পাশ্চাত্য অধিবাসপর্ব অনেকটাই দূরের ঘটনা। এরকম গল্প একটি বা দু’টি নয় অন্তত পাঁচ/ছ’টি গল্পের নাম করা যাচ্ছে যেগুলো তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম গল্পগ্রন্থের নামগল্পটাই (নয়নচারা) হতে পারে এরকম এক প্রতিনিধিত্বের নমুনা। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের বিষয়বস্তুনির্ভর শিল্পসফল গল্পটির তুলনা চলে কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পের সঙ্গে। কমলকুমারের গল্পটির আগে লেখা ওয়ালীউল্লাহ্’র এ-গল্প দুর্ভিক্ষগ্রস্ততার অমানবিক রূঢ় নির্দয় সময়টাকে আটকে রেখেছে চিরকালীনতার ফ্রেমে। গল্পকারের ভাষাকুশলতা ও জীবনবোধের সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে অনেক সমালোচক গল্পটিকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম গল্পগ্রন্থের অন্তত তিনটি গল্পের কথা বলা যাবে যেগুলোর ভাষাভঙ্গি তাঁরই অস্তিত্ববাদী বলে বিবেচিত চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের ভাষাভঙ্গির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপন্যাসটি তাঁর বিয়াল্লিশ বছর বয়সে লেখা এবং ততদিনে জ্যঁ পল সার্ত্র-এর অস্তিত্ববাদী উপন্যাস লা নজে’র ইংরেজি সংস্করণ (১৯৬০-এ প্রকাশিত) বেরিয়ে গেছে। কিন্তু নয়নচারা’র গল্পগুলো রচনাকালে ছাত্র ওয়ালীউল্লাহ্’র পক্ষে উপন্যাসটির ফরাসি সংস্করণ (১৯৩৮ সালে প্রকাশিত) পাঠের প্রশ্ন অবান্তর। তাহলে, কুড়ি/একুশ বছরের গল্পকার ওয়ালীউল্লাহ্ এতটা কাল আগেই তাঁর সুমেধ গদ্যের নির্মাণকারী এবং আরও কুড়ি/একুশ বছর পরে মোটামুটি সেই গদ্যভঙ্গির আশ্রয়ে রচিত হবে তাঁর উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা। আসলে ১৯৪৮-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাসের গদ্যই সমগ্র বাংলা উপন্যাসের জগতে ওয়ালীউল্লাহ্কে এনে দেয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৫-এ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থকে মানদ- হিসেবে বিবেচনায় নিলে সেই প্রতিষ্ঠার কাল এগিয়ে যায় আরও তিনটে বছর। অর্থাৎ দূর শৈশবকাল থেকেই ঘটতে থাকে এক অতি সংবেদনাময় সৃষ্টিশীল পরিমিতিসম্পন্ন ওয়ালীউল্লাহ্’র ক্রমোদ্গম। স্মরণ করা যায়, ১৯৩৫/৩৬ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র হাতে লেখা দেয়াল-পত্রিকার কথা যেটির শিরোনামটিও তাঁরই দেয়া- ‘ভোরের আলো’। সেই প্রত্যূষই ছিল তাঁর প্রস্তুতিপর্ব, কেননা, প্রথম গল্পগ্রন্থেই যে-লেখকের ভাষা তাঁর স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গির প্রতিনিধিত্বকারী হয়, বুঝতে পারা যায়, সেই লেখকের হাত মকশো-পর্ব অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল আরও অনেকটা কাল আগেই।

১৯৪৮ সালে প্রকাশিত লালসালু উপন্যাসের একটা জায়গা থেকে পরস্পর-বিরোধী দু’টো বক্তব্য লক্ষ করি-
(ক) ইস্কুলে না পড়লে … মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই।
(খ) হে নাকি ইংরাজি পড়ছে। তা পড়লে মাথা কী আর ঠাণ্ডা থাকে!
উপন্যাসস্থিত মহব্বতনগর গ্রামের এ-পরিস্থিতি ১৯০০ থেকে ১৯০৫ সালের পূর্ববর্তী কোনো এক সময়কার। প্রথম ভাবনাটা গ্রামের যুবক আক্কাস মিঞা’র যে কলকাতা থেকে লেখাপড়ার একটা স্বীকৃত ধাপ পেরিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। শিক্ষিত আক্কাসের ধারণা, ইংরেজি না শিখলে মানে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ব্যতিরেকে উন্নতি অসম্ভব। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ভাবনাটা উত্থিত সেই গ্রামের মানুষদেরই যৌথ অবচেতনা থেকে। আক্কাস চেয়েছিল গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু জমিদার খালেক ব্যাপারী এবং ভণ্ড পীর মজিদের সম্মিলিত তৎপরতায় প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন মক্তব যেখানে চলবে আরবি ভাষায় ধর্মগ্রন্থের পাঠ। রচয়িতার জন্মের আটাশ বছর এবং পঞ্চাশ বছর আগেকার পূর্ববঙ্গের এ-বাস্তবতা ইতিহাসসম্মত। কিন্তু সে-বাস্তবতার ছবি ওয়ালীউল্লাহ্’র আগেকার ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে আসে খ-িতভাবে। সমাজজীবনের বিশেষ বিশেষ দিকের আলোকন সেইসব উপন্যাসে লক্ষ করা যায়। ওয়ালীউল্লাহ্’ই প্রথম পূর্ববঙ্গের, আরও ভালভাবে বললে, বাঙালি মুসলমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনটাকে ধরলেন সমগ্র’র আলোকে। স্তরপরম্পরা ও স্তরায়ণে বিভক্ত সামাজিক চৌহদ্দির বহির্কাঠামো-অন্তর্কাঠামো, বিভিন্ন শ্রেণির চরিত্র, সামাজিক পুরুষ, নারী, ক্ষমতার অবভাস ও পরিণাম প্রায় সবকিছুই উপন্যাসের সীমাবদ্ধ আয়তনে এসে পড়ে আপাত নিরবচ্ছিন্ন কিন্তু পর্ব-পর্বান্তরের ক্রিয়তায়।

আরও পড়ূন: প্রথম ইঙ্গভারতীয় কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষ 

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র প্রথম উপন্যাসই পূর্ববঙ্গের (তথা বাংলাদেশেরও) প্রথাবদ্ধতার বিপরীতে স্বাতন্ত্র্যের উদযাপন। তিনি যে উপন্যাসের প্রচলিত গল্প বলার রীতি ভেঙে দেন তা-ই নয়, এখানকার নায়ক সম্পর্কিত পুরনো ভাবনাকেও দেন টলিয়ে। উপন্যাসের অভ্যন্তরীণ সংঘটনপ্রক্রিয়ার ভরকেন্দ্রিকতাও ওয়ালীউল্লাহ্তে বদলে যায় আমূল। যেজন্যে ধরাবাঁধা উপন্যাস-সমালোচনায় তাঁর সৃজনশীলতার মূল্যায়ন খানিকটা দুরূহ বৈকি। উপন্যাসের নায়ক হিসেবে এ্যান্টিহিরোদের আমরা দেখেছি ডিকেন্সের উপন্যাসে। ক্রিসমাস ক্যারল-এর নায়ক স্ক্রুজের দোষ ছিল, সে কৃপণ, মমতাহীন, একরোখা। শেষে অবশ্য পরিবর্তন ঘটে তার চরিত্রে। ডিকেন্সেরই দ্য ওল্ড কিউরিওসিটি শপ-এর নিষ্ঠুর-ষড়যন্ত্রকারী কুইল্প-এর কথাও বলা যায়। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসের নায়ক (বা যদি বলি কেন্দ্রীয় চরিত্র) এ-রকম এ্যান্টিহিরোদের অনায়াসেই টেক্কা দিতে পারে। লালসালু’র নায়ক মজিদ আপাত ধার্মিকতার আড়ালে এক ভ-, প্রতারক, নিপীড়ক, সন্ত্রাসী এবং একনায়ক ধরনের চরিত্র। অথচ ঔপন্যাসিকের উপস্থাপনায় এমন একটা চরিত্রকে লালসালু’র জন্যে নির্বিকল্প মনে হয়। প্রশ্ন, এমন নায়ক কেন। আর, লোকটার এমনই প্রতাপ, মহব্বতনগর গ্রামে এত লোক থাকা সত্ত্বেও সবাইকে ছাপিয়ে নায়ক হয়ে উঠেছে সে। এমনকি একটু আগে যে-শিক্ষিত যুবকের কথা বলা হলো, সে তো মহব্বতনগর গ্রামেরই মূল বাসিন্দা। লেখাপড়া শিখে অনেকের মধ্যে এক হয়ে ওঠা একজন। তবু বহিরাগত একটা লোক আচমকা উড়ে এসে জুড়ে বসে স্থায়ী অধিষ্ঠান পেয়ে গেল গ্রামে। অসংখ্য গ্রামবাসীদের মাঝখানে নায়কত্ব পেয়ে যাওয়া এই লোকটাকে দিয়েই যাত্রা শুরু হয় নতুন মানচিত্র পাওয়া পূর্ববঙ্গের উপন্যাসের।

বহিরাগত বা বাইরে থেকে এসে স্থিতি নেওয়াটা সভ্যতারই একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য অভিযোজন-প্রক্রিয়ার প্রতিফল। রোমক সভ্যতার প্রথম যথার্থ বীর মহাকাব্যের নায়ক ঈনিস মূলত গ্রিসের অধিবাসী। সমুদ্র পেরোনো গ্রিকরা গ্রেকো-রোমান সভ্যতার জন্মদাতা। রামায়ণ-এর নায়ক রাম ছিলেন বহিরাগত, অভ্যন্তরীণ রাবণের পক্ষে নায়কত্ব অর্জন সম্ভব হয় নি সেখানে। আধুনিক সভ্যতায় বিশেষ করে বাস্তবের প্রচ্ছায়ায় গড়া উপন্যাসের পৃথিবীতে বাইরে থেকে আসা নায়কের নতুন নামাকরণ ঘটে। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁরি বারবুস-এর নরক উপন্যাসের নায়ককে বলা হয়ে থাকে প্রথম ‘এৎঘঁঝে’ বা ‘আউটসাইডার’ বা ‘বহিরাগত’ নায়ক। তার কোন নামও থাকে না- সে অনামা, গ্রাম থেকে এসে ঢোকে প্যারিসে। নিজের কামরার দেয়ালের ছোট্ট গর্ত দিয়ে দেখে সে দুনিয়ার বিচিত্র বিষয়। দেখে লেসবিয় মানুষ, যৌনাচার, রক্তসম্পর্কে নিকট পরস্পরের মধ্যকার সন্নিধান-সংসর্গ, চৌর্য, মৃত্যু ইত্যাকার সমস্ত কিছু। বারবুস-এর ‘বহিরাগত’ ধারণাটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ইংরেজ লেখক কলিন উইলসনের গ্রন্থের শিরোনামে স্থান পেলে সেটি একটি সাহিত্যিক পরিভাষায় পরিণত হয়। সাহিত্যের নানা দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করে উইলসন দেখান, ‘আউটসাইডার’ এমন একটি ধারণা যেখানে বিচ্ছিন্নতার স্বভাব ব্যক্তির সর্বব্যাপী চারিত্রলক্ষণে রূপ পরিগ্রহ করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র নায়ক মজিদ বহিরাগত হলেও এটি বলা যায়, চরিত্রটির ¯স্রষ্টার বারবুস সম্পর্কে ধারণা থাকাটা অসম্ভব নয়। কিন্তু লালসালু উপন্যাসের নায়ককে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্নতার বিশেষত্বে মণ্ডিত বলে চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ, সে প্রচ-ভাবে সমাজসংলগ্ন এবং লগ্ন না হয়ে টিঁকে থাকা সম্ভব নয় মজিদের পক্ষে। পরবর্তী দুই উপন্যাসের নায়কও বহিরাগত এবং স্বভাবে তারা আবার ভিন্নরকম। ফিরে যাওয়া যাক আগের কথায়, মজিদ নায়ক কেন, এবং সে নায়ক হওয়ার ফলে লালসালু উপন্যাসটির গতিপ্রকৃতি ঠিক কোন্ পরিণতি বয়ে আনে মহব্বতনগরে বা মহব্বতনগরোপম পূর্ববঙ্গে এবং সেই সঙ্গে আমাদের উপন্যাসের ভুবনে।

১৯০০-১৯৬৫, পঁয়ষট্টি বছরের ইতিহাসের যে-বাস্তব লেখকের পুঁজি এবং তাঁর তিনটি উপন্যাসে চিত্রিত যে-বাস্তব, দু’টোর সমান্তরলতা এবং দু’টোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসশিল্প বিচার্য। এই সময়পরিধির ক্রমবিবর্তনের ছাপ আমরা লক্ষ করবো উপন্যাসগুলোর চরিত্র, সংলাপ, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের উপস্থাপন-প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়ায়। উপন্যাস মজা করবার জায়গা নয়, নয় সেটি কোনো নিরর্থক-নিছক শব্দক্রীড়া। হোক সেটি র‌্যাবেলে’র গরগনচুয়া কি সার্ভান্তেস-এর দোন কিহোতে কি দিদেরো’র লা রেলিজিয়ুস কি গোগোল্স্-এর মের্ৎভিয়ে দুশি (ডেড সোল্স্) কিংবা ওয়ালীউল্লাহ্’র লালসালু। গোগোল তাঁর কমেডি ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং উপন্যাস ডেড সোল্স্ দু’টোরই প্লট পেয়েছিলেন পুশকিনের কাছ থেকে। ১৮৩৫-এ গোগোল লিখতে শুরু করেন তাঁর উপন্যাস। লেখা হয়ে গেলে প্রথম দিককার অধ্যায়গুলো তিনি পড়ে শোনান পুশকিনকে। পাঠ শুনে হাস্যে ফেটে পড়েন পুশকিন এবং মন্তব্য করেন, “কী দুঃখজনক অবস্থা রাশিয়ার।” ইন্সপেক্টর জেনারেল নাটকের মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার পরিণামে তিনি ইউরোপে চলে যেতে বাধ্য হ’ন। প্যারিসে বসে পুশকিনের মৃত্যুসংবাদ শুনে গোগোল বলেছিলেন, “তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল আমার জীবনের আলো, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। গোগোলের উপন্যাসটির প্রথমাংশ সমাপ্ত হয় তাঁর রোমে প্রবাসজীবন কাটাবার সময়। ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাস লিখেছেন দেশে এবং বিদেশে বসে কিন্তু তাঁর উপন্যাসের অভ্যন্তরে কালের যে-ফ্রেমটি নির্মিত সেটির মধ্যে থাকে নিখুঁত ধারাবাহিকতা। প্রথম উপন্যাস থেকে তৃতীয় উপন্যাস পর্যন্ত সময়ের পরিক্রমায় যে-বাস্তব বদলাতে বদলাতে এগিয়ে গেছে সে-বাস্তবের রূপ উপন্যাসের চরিত্র, সংলাপ, পরিস্থিতি এবং নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের অবস্থান ও পরিণতি থেকে বুঝতে পারা যায়। গোগোল তাঁর রচনার প্লট পুশকিন থেকে পেলেও তাঁর হৃদয়ের গভীরে থাকা রাশিয়ার বাস্তবতা সেটিকে গোগোলিয় করে তুলেছে। তেমনি বলা যায়, পূর্ববঙ্গে প্রায় কাছাকাছি সময়ে রচিত শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, সরদার জয়েনউদ্দিন এরকম অনেকের উপন্যাসেই লালসালু’র মজিদ কিংবা খালেক ব্যাপারী’র চরিত্রের মত চরিত্র লক্ষ করা যাবে কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসগুলোর মধ্য দিয়ে স্থান-কাল-পাত্রের ত্রিমাত্রিকতা যে-কুশলতায় শিল্পিত হয় সেভাবে হয় না আর কারও উপন্যাসেই।

আরও পড়ূন: চক্রবৎ আবর্ততে

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসে সত্যিকার অর্থে নায়ক নেই কিন্তু একনায়ক আছে। একই সঙ্গে একথার দ্বিতীয়ার্থ দাঁড়ায়, ১৯০১ সাল থেকে হিসেব শুরু করলে পঁয়ষট্টি বছরের পূর্ববঙ্গের ইতিহাসেও নায়ক নেই, আছে একনায়ক। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত একটি প্রবাদের অর্থ এরকমÑ যেদেশে মোরগ নেই সেদেশে মুরগি ভোরের ঘোষণা দেয়। তা-ও ভাল। কিন্তু এমন জনবহুল একটা লোকালয়ে নায়ক হওয়ার মত যোগ্যতাধারী লোকের দেখা পাওয়া ভারÑ ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসের মুখোমুখি হয়ে একথা ভাবলে দেশটির একটা ম্লান-অসহায়-বিষণœ-হতাশ ছবিই ভেসে ওঠে। নায়ক না থাকার ফলে সর্বত্র একনায়কের একচ্ছত্র প্রতাপ। সে থাকে পরিবারে, সে থাকে সমাজে-রাষ্ট্রে। থাকে প্রত্যক্ষভাবে, থাকে প্রাতিষ্ঠানিকতার আড়ালে, থাকে আইনকানুনের বিবিধ শস্ত্রপািণ হয়ে। একদিকে এসব একনায়কের আগ্রাসি অধিষ্ঠান এবং তার বিপরীতে অন্যদিকে সংখ্যায় বিপুল কিন্তু অকার্যকর জনসমষ্টি। ওয়ালীউল্লাহ্’র যখন এগারো বছর বয়স, জার্মানিতে মাত্র একজন হিটলারের ইচ্ছের আগুনে বার্লিনে দাউদাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নাজিদের সমর্থক নয় এমন এবং ইহুদি লেখকদের লেখা সব বই। দ্বিতীয় বিশ^সমরের চলমানতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় ওয়ালীউল্লাহ্’র সাহিত্যিক মানস। ইউরোপিয় একনায়কদের আগ্রাসনের পরিণাম তাঁর চাইতে ভাল আর কে জানবে। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্ একনায়কদের দেখেছেন তাঁর শৈশবে তাঁর পারিবারিক-সামাজিক পরিবেষ্টনীর মধ্যে। তাঁর পর-পর তিনটি উপন্যাসেই আসতে থাকে একনায়কেরা। আসে তারা প্রথমে এক হয়ে (মজিদ), তারপর একে-একে একাধিক হয়ে এবং একপর্যায়ে তাঁর উপন্যাসের একনায়ক এবং তাঁর সমকালীন রাষ্ট্রের একনায়ক মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। উপন্যাসেও ঘটে তার প্রতীকী ছায়াপাত। বস্তুত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ উপন্যাসের বিষয়ভাব বিন্যাসে নিজেকে স্থাপন করেন তাঁর জাতিগত চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে জমিলা (লালসালু), যুবক শিক্ষক (চাঁদের অমাবস্যা) কিংবা মুহাম্মদ মুস্তফা’র সংগ্রামকে (কাঁদো নদী কাঁদো) যতই তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম বলে মনে হোক না কেন তারা এক বৃহৎ জনসমষ্টির প্রতিনিধি যারা ইতিহাসে চাপা পড়ে রয়েছে মূক স্তূপের নিচে। একনায়কদের বিপরীতে জনসমষ্টি তাদের অর্থহীন অস্তিত্বকে ছাপিয়ে কারও পক্ষে ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠাটা সম্ভবপর হয় না। ভিড়ের মধ্যে দূর থেকে যাদের ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়, নিকটে গেলে দেখা যাবে তারা প্রতিনায়ক, ভিলেন। নায়কের অনুপস্থিতিতে চারপাশে কায়েম করছে দখলদারির রাজত্ব। ওয়ালীউল্লাহ্’র উপন্যাসে সেই দখলদারির রাজত্বের চেহারাটা আমরা দেখতে পাবো। কথা হচ্ছে, প্রতিনায়কদেরই নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্র করা কেন। এর জবাবে বলা যাবে, হ্যাঁ, প্রথম উপন্যাসেই আসলে প্রতিনায়ককে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। আর তার বিপরীতে চলে একটি জনগোষ্ঠির সামগ্রিক অবস্থার একটা জরিপÑ ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিক জরিপ তবে কথাশিল্পের চোখ দিয়ে। পরবর্তীতে সেই অবস্থার পরিবর্তন লক্ষণীয় হয় এবং সেই পরিবর্তন বৈপ্লবিক না হলেও সেটির অভিমুখ থাকে প্রত্যাশার দিকে। সে-প্রত্যাশা হয়তো আশাবাদের নিয়ামক হয় না অন্তিমে কিন্তু বাস্তবের যথার্থ মাত্রিকতা ফুটিয়ে তুলতে পারে। ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর একনায়ককেন্দ্রিক পৃথিবীটার পরিচয় দিতে গিয়ে ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র-ঔপনিবেশিকতা সব একাকার করে দেন। সর্বোপরি তাঁর দৃষ্টি আরও গভীর গভীরতর অনুসন্ধানের দিকে। সেখানে যৌথ অবচেতনা দেশ-সমাজ ও জাতিগত চেতনা ছাপিয়ে দূরাভিসারী।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!