স্বঘোষিত নাস্তিক, প্রথাবিরোধী সাহিত্য স্রষ্টা হুমায়ুন আজাদ সর্বকালের আলোকিত মানুষ

হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) বহু ক্ষণজন্মা মানুষের মতোই সময়ের অগ্রগামী চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার বললেও তাঁর চিন্তাক্ষেত্রকে সীমায়িত করা যায় না। কেননা প্রথাবিরোধী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী,সংস্কার বিরোধী বহুমাত্রিক জীবনের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। যৌনতা, নারীবাদ, ধর্মীয় অন্ধকারবাদ প্রভৃতি ধারণাকে তিনি যুক্তির আলোয় নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেন। আশির দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি নিয়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘নারী’ (১৯৯২), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (২০০১) এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) এই তিনটি গ্রন্থেই বিতর্কের ঝড় তোলে সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার এই গ্রন্থ তিনটি বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হন। ধর্ম ও মৌলবাদ চেতনায় আঘাত হানার জন্য ২০০৪ সালে জমিয়তুল মুজাহেদীনের দ্বারা তাঁর উপর নেমে আসে সন্ত্রাসী হামলা। এই আঘাতের কারণেই হয়তো তাঁকে জার্মানির মিউনিখে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর তাঁর বহুমাত্রিক ভাবনার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থতালিকা সত্তরটিরও বেশি। দশটি কাব্যগ্রন্থ, তেরোটি উপন্যাস, বারোটি সমালোচনা গ্রন্থ, আটটি কিশোর সাহিত্য, সাতটি ভাষা-বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। বাকিগুলি প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পরে। ১৯৭৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলা সর্বনামীয়করণ’ অর্থাৎ Pronominalization in Bengali. ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিষয়ে তাঁর আরও দুটি বিখ্যাত বই হল: ‘বাক্যতত্ত্ব’ ও ‘বাঙলা ভাষা’। বাংলা ভাষা বিষয়ে নানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ তুলনামূলক আলোচনা ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন পর্ব তিনি তুলে ধরেন। তবে বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।তবু উক্ত বইগুলিতে তাঁর মেধা ও ঐতিহাসিক গবেষকের একটা সমন্বয় দেখতে পাই। সমকালে একজন ছাত্রের কাছে যেমন বিষয়গুলি উপযোগী ছিল আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তখন ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কির প্রভাবেই তিনি প্রেরণা পান। Transformational generative grammar(TGG)-র দ্বারা। এই তত্ত্বকেই তিনি পিএইচডির বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন।

একটা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা যেমন হুমায়ুন আজাদের কাছে কাম্য ছিল, তেমনি একটা শোষণহীন পুরুষতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা-ই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যেই তিনি রচনা করেন ‘নারী’ নামক প্রবন্ধ গ্রন্থটি। আর বিশেষ করে এই জন্যই তিনি বাংলাদেশের মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন। নারীকে যৌনদাসীতে রূপান্তরিত করে পুরুষ শুধু ভোগ করে। তাকে দাসী হিসেবেই ব্যবহার করে। তার স্বাধীন সত্তার কোনো মূল্য দেয় না। এই গ্রন্থে লেখক নারীদের সমমর্যাদার জন্য যুক্তির আলোয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। লিখলেন ‘নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত পশু।’ পুরুষ নারীকে পশু হিসেবেই দয়া করে। তিনি আরও লিখলেন ‘পুরুষ নারীকে দেখে দাসী রূপে, করেও রেখেছে দাসী; তবে স্বার্থে ও ভয়ে কখনো কখনো স্তব করে দেবী রূপে। পুরুষ এমন প্রাণী, যার নিন্দায় সামান্য সত্য থাকতে পারে; তবে তার স্তব সুপরিকল্পিত প্রতারণা।’ তার শরীয়ত বিরোধী কথাবার্তা মৌলবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানে। চাপে পড়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে। চার বছর পর ২০০০ সালে বইটি পুনর্মুদ্রিত হয় এবং পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করে। আর তখন থেকেই তিনি টার্গেট হন জমিয়তুল মুজাহেদীনের।

আরও পড়ুন: বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে প্রান্তিক মানুষ ১

বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা, শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা, রাজনৈতিক নানা ভ্রান্তনীতি হুমায়ুন আজাদের সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৮০ এর শেষ দিক থেকেই তিনি গণমাধ্যমগুলিতে তার বক্তব্য প্রকাশ করতে থাকেন। ‘খবরের কাগজ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে থাকেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেই তাঁর এইসব সমালোচনামূলক রচনা। ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার শোষণপীড়নের প্রামাণিক দলিল। বাংলাদেশের দুরবস্থার সাহসী বর্ণনা করেছেন এই বইটিতে। সবচেয়ে মৌলবাদীদের কাছে মারাত্মকভাবে যে উপন্যাসটির নাম উঠে আসে সেটি হল ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। এটি ২০০৩ সালের ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি ছাপার পর পরই মৌলবাদীরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। সরকারের কাছে নিরাপত্তারও দাবি করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে তাঁকে তেমন নিরাপত্তা দেওয়া হল না। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চাপাতির আঘাতে তাঁকে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হল। আসলে খালেদা জিয়া সরকারের মদতপুষ্ট জমাতিয়া গোষ্ঠী তা বলাই বাহুল্য। সেই সময় লেখকের পরিবারও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের প্রথম পংক্তি ব্যবহার করে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটির নামকরণ করেন। প্রথাবিরোধী লেখকের প্রথাবিরোধী উপন্যাস হিসেবেই এটি খ্যাতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা সহযোগিতা করে। তার উপর ভিত্তি করেই এটি লেখা। লেখকের ভাষাভঙ্গির ব্যবহার এবং তির্যক ও বিদ্রোহী মনোভাব একটা সময়কে জীবন্ত করে তোলে। মৌলবাদকে কঠোরভাবে আক্রমণ করার কারণেই তিনি তাদের শিকার হন। জামায়াতে ইসলামীকে তিনি ফ্যাসিবাদী বলেই সরাসরি উল্লেখ করেছ্ন। অন্যান্য উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ‘ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল’ (১৯৯৪) মূলত এটিই তাঁর প্রথম উপন্যাস। কর্কশ অশ্লীল সামরিক অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিসত্তা তথা জাতিসত্তার মহাঅভিশাপকে তিনি রাশেদের চরিত্রের মধ্যে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যাচারের কাহিনিটিই প্রাধান্য পেয়েছে। বিপন্ন দেশের ইতিহাস তুলে এনেছেন লেখক। সরল কাহিনি নয়, ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল হৃদয়ের সংকেতে সমূহ জাতিরই অস্তিত্ব সেখানে।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণ নিয়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসটি হল ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫)। জীবনবাদী প্রচ্ছায়ায় মানুষের নানা বাঁকের দৈহিক ও মানসিক রূপকে খুব মননশীল করে এঁকেছেন এই উপন্যাসে। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ, সৌন্দর্য, যৌনতা সবকিছু স্থান পেয়েছে। এই উপন্যাসের জন্যই বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন (২০০২)। ‘১০,০০০, এবং আরও ১টি ধর্ষণ’ (২০০৩) উপন্যাসের মূল বিষয়ই ‘ধর্ষণ’। উৎসর্গ করেছেন ধর্ষিতাদেরই বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ধর্ষণের বিশাল এক রঙ্গমঞ্চ। ধর্ষণ শুধু নারীরাই হয় না, হয় দেশ, মাটি, মেঘ, রৌদ্র, জোৎস্নাও। ধর্ষিতা ময়না তার অবৈধ সন্তানকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে একটি ধারালো দা দিয়ে। এটিই তার প্রতিশোধ যে অন্তত একটা শুয়োরকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ (২০০৪) উপন্যাসটিও বাংলাদেশের পটভূমিতেই রচিত ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সময়কালের নানা অত্যাচার ও হত্যার কাহিনি।

আরও পড়ুন: এক বাউণ্ডুলের ভুবন  

হুমায়ুন আজাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি হল তাঁর কবিতা। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাস-গল্পের মতোই কবিতাগুলিও ভাবনার অমোঘ জারক হয়ে উঠেছে। গদ্যের সঙ্গে সঙ্গে আমৃত্যু তিনি কবিতা রচনা করেছেন। মূলত ষাট দশকের কবিদের সমপর্যায়ী ভাবনার কবি। সেইসময়ের জীবনের নানা ভাঙন, হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, প্রেম, যন্ত্রণা, বিবমিষা তাঁর কবিতায় ঠাঁই পেয়েছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। মোট ৪২ টি কবিতা আছে এটিতে। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘জ্বলো চিতাবাঘ'(১৯৮০), ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'(১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে'(১৯৯০), ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু'(১৯৯৮) এবং ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪)। তাঁর মৃত্যুর পর আরও সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ কিভাবে ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকার যাবে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ;—চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চলে যাবে এই সমাজ সভ্যতা—সমস্ত দলিল”

রাজনৈতিক পীড়ন-শোষণের অত্যাচারের কাহিনি আর মৌলবাদের আগ্রাসন মানবিক শক্তিকে কিভাবে ধ্বংস করেছে তারই স্বরূপ কবিতাটিতে তুলে ধরেছেন। তেমনি ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ কবিতাতেও দেশের বিষাক্ত প্রভাব মানবহৃদয়ের অবশেষ চিহ্নটুকুও মুছে দিতে চেয়েছে। তাই কবি হাহাকার করে উঠেছেন:

“এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?
তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল—
সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।”

হৃদয়েই লাশের কবর। মানুষও জীবন্ত লাশ হয়ে যন্ত্রণা বহন করে। এই স্বাধীনতা কবি চাননি। আরেকটি কবিতায় কবি লিখেছেন:

“তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি
বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ে না।”

বাংলাদেশ বেদনার, বাংলাদেশ কষ্টের, বাংলাদেশ মৃত্যুর, বাংলাদেশ রক্তপাতের এবং বাংলাদেশ কায়েমি গোষ্ঠীর স্বার্থের। কবি তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ কবিতায় স্পষ্ট করেই বলেছেন:

“আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।”

বিশুদ্ধ চেতনা নিয়ে, আত্মবিকাশের সদর্থক কোনো ক্ষেত্র কবির সামনে ছিল না। নিজের মতো করে তাই পারেননি বাঁচার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে। কবির সত্তা ধ্বস্ত হয়েছে। পীড়িত হয়েছে। সেখানে বুলি বলা শিখতেও তিনি চাননি। বিশ্বাসেও দূষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মতো বাধ্য করেছিল বাঁচতে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রীড়নক হয়ে কি বাঁচা যায়?

নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভেতরেও কতখানি ফারাক ছিল তা নিজের ঘরের মা-বাবার সম্পর্কের মধ্যেই কবি টের পেয়েছিলেন। ‘আমার মা’ কবিতায় লিখেছেন:

“আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লাহর মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম।”
পুরুষতন্ত্র কিভাবে নারীকে ব্যবহারের কৌশলে দাসী করে রেখেছে তা কবিতাতেও অকপটভাবে কবি তুলে ধরেছেন। তেমনি মুক্তির ভাষা বাংলাভাষাও কবির লেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার স্বরূপ বোঝাতে কবি ‘বাঙলা ভাষা’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন:

“তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম”

বোঝা যায় কতটা সমীহ ছিল কবির। উত্তরাধিকারের প্রত্যয় জাগিয়ে দিতে বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি ও ব্যঞ্জনা কত অমোঘ হয়ে উঠেছে। অন্য একটি কবিতায় বলেছেন:

“অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।”

এই পৌঁছানোর প্রয়াস থেকে গোলাপ ফোটানোর আবেদন থেকে, মুক্ত আকাশে ডানা মেলে দেবার স্বপ্ন থেকে এক স্বাধীন সত্তা বারবার জেগে উঠেছে হুমায়ুন আজাদের কবিতায়। প্রেমিক সত্তা থেকে বিদ্রোহী সত্তা, নির্জন থেকে পরিব্যাপ্ত সত্তা এবং সর্বময় বাঙালি সত্তার গভীর পর্যটন। মানবিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই জীবনের সুবিস্তৃত আকাশকে তিনি নিরীক্ষণ করতে চেয়েছেন। কী জাতীয়তাবোধ, কী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কী ইতিহাস চেতনা সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে তাঁর প্রথাবিরোধিতার সাহসী পদসঞ্চার। মৌলবাদীরা তাঁকে হত্যা করতে পারে না। সাহসের মৃত্যু ঘটে না। বহু হুমায়ুন আজাদের জন্ম হচ্ছে আজও। তাঁর কথাতেই বলতে হয় “একটি মানুষ হয়তো লাশে পরিণত হয়, তখন তার কোনো পরিচয় থাকে না, তার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, তাকে চাইলেই জড়িয়ে ধরা সম্ভব নয়, চুম্বন করতেও সাহসিকতার অভাব দেখা দেয়, কিন্তু তার মননশীলতা বেঁচে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। হত্যা কোনো সমাধান নয়। একজন মানুষকে হত্যা করে কিছু সময় কিছু বছরের জন্যে হয়তো ভালো থাকা যায়, উন্নতি লাভ করা যায়, শান্তি পাওয়া যায়, লাভবান হওয়া সম্ভব, কিন্তু জীবনে চলার পথে সেই হত্যাকারী দিনে দিনে হিংস্র ধ্বংসাত্মক রূপে নিজেকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় এবং একসময় মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু একজন জ্ঞানী মানুষ মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে।”

বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আর কী-ই-বা বলার ছিল! একের পর এক বুদ্ধিজীবীদের খতম করে চলেছে তারা। কিন্তু তাদের মুক্তচেতনার কি সমাপ্তি ঘটাতে পেরেছে? পারেনি বলেই আজও তারা ধ্বংসাত্মক পথেই এগিয়ে চলেছে। হুমায়ুন আজাদ যে মানবতাবাদের বৃহত্তর হৃদয়ভূমির দিক নির্দেশ করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে তা সর্বকালের দার্শনিক সত্যে গৃহীত হবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। মৌলবাদীরা ঘৃণিত জীব হিসেবেই বর্জিত হবে, নিষিদ্ধ হবে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!