প্রেতপুরী থেকে মরণদোল: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী ১

(প্রথম পর্ব)

সাধারণভাবে অলৌকিকতা ও অতিলৌকিকতা বলতে মানুষের লৌকিক অভিজ্ঞতার সীমানা বহির্ভূত এমন কিছু রহস্যকে বোঝানো হয়ে থাকে যেগুলিকে বাস্তব যুক্তি বা বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করা চলে না; যেমন — ভৌতিক ক্রিয়াকলাপ, দৈব প্রভাব, জন্মান্তরবাদ, মন্ত্রশক্তি ইত্যাদি। সৃষ্টির ঘনতমসাবৃত প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে বর্তমানের আলোকোজ্জ্বল যান্ত্রিক শতাব্দী পর্যন্ত অলৌকিক ও অতিলৌকিকের প্রতি মানব হৃদয়ের কৌতূহল ও বিস্ময়ের কোন অন্তঃ দেখতে পাওয়া যায় না। সুদূর অতীত থেকেই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সাহিত্যেই অপ্রাকৃতকে কেন্দ্র করে জনচিত্তের এই দুর্নিবার জিজ্ঞাসারই প্রতিফলন ঘটেছিল। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি কথাসাহিত্যের ধারাতেও অতি শৈশবকাল থেকেই অনৈসর্গিক ঘটনার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়।

বঙ্গ সাহিত্যের এই শাখার প্রথম সার্থক শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অধিকাংশ গল্প উপন্যাসেই জ্যোতিষচর্চা ও দৈবপ্রভাবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বহুস্বজন-বিয়োগ বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে পরলোকচর্চার প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন, এমনকি তিনি তাঁর বহু সাহিত্য সৃষ্টিতেও অলৌকিক রস পরিবেশনের আয়োজন করেছিলেন; এই প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ তাঁর লেখা একাধিক ছোটগল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যথা — ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ প্রভৃতি। অবশ্য গভীর অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, আপাতদৃষ্টিতে উপরোক্ত গল্পগুলিকে অলৌকিক বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি মানবমনের বিচিত্র অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যেমন ‘নিশীথে’ গল্পটিতে নায়ক যখনই তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীকে সম্ভাষণ করতে গিয়েছিলেন, তখনই তিনি তাঁর মৃতা প্রথমা স্ত্রীর কণ্ঠনিঃসৃত তীক্ষ্ণ প্রশ্ন শুনতে পেয়েছিলেন — “ও কে, ও কে, ও কে গো!” এই জিজ্ঞাসা আসলে গল্পের নায়কের অবচেতন মনের অপরাধবোধের প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। ‘কঙ্কাল’ ও ‘মণিহারা’তেও বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে চরিত্র সমূহের মনোবিকলন ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার প্রকাশ ঘটেছিল। ক্ষুধিত পাষানের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীও আসলে ইতিহাস সচেতন একজন রোম্যান্টিক কবি মনের নানা ভাবনার প্রক্ষেপ-মাত্র।

বাংলা কথাসাহিত্যের অপর একজন দিকপাল শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় মূলতঃ সমকালীন সমাজ-বাস্তবতা ও সামাজিক সমস্যা প্রাধান্য লাভ করলেও অপ্রাকৃতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং অলৌকিকতা চিত্রণে তাঁর দক্ষতা যে কতটা গভীর ছিল, — তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের অষ্টম পরিচ্ছেদে বর্ণিত নিরুদিদির মৃত্যুর দৃশ্যে এবং অষ্টম ও নবম পরিচ্ছেদে শ্রীকান্তের মহাশ্মশানে রাত্রিযাপনকালে বিভিন্ন অনুভূতির বর্ণনার ক্ষেত্রে — সেসবের অভ্রান্ত স্বাক্ষর আজও মুদ্রিত হয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন: বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে প্রান্তিক মানুষ ১

তবে অতীতের যে সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে অনেকগুলি ভৌতিক গল্প উপহার দিয়েছিলেন, তাঁর নাম হল — ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বঙ্গ সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটিকে সমৃদ্ধ করে তোলবার কাজেই বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখা ‘পৌষ-পার্বণে চীনে ভূত’, কিংবা ‘মেঘের কোলে ঝিকিমিকি’, কিংবা ‘সতী হাসে ফিকিফিকি’ প্রভৃতি গল্পে ভূতের আনাগোনা দেখতে পাওয়া গেলেও তাঁরা মোটেও ভীতিপ্রদ নয়, — বরং কৌতুকবহ। তবে তাঁর লেখা — ‘মাস্টার মশায়’ — একটি ভৌতিক গল্প হিসাবে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শরদিন্দুর সমসাময়িক একজন খ্যাতকীর্তি সাহিত্যিকও অতিলৌকিক ও অলৌকিক জগতে বেশ স্বচ্ছন্দচারী ছিলেন, তাঁর নাম হল — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, অর্থাৎ বনফুলও বাংলা সাহিত্যের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নতুন আঙ্গিকে ও অভিনব দৃষ্টিকোণ থেকে অপ্রাকৃতকে উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং, আলোচ্য ধারায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বগামী, সহযাত্রী ও উত্তরসূরী অনেকেই ছিলেন, কিন্তু ভৌতিক কাহিনীর বক্তব্যে ও প্রকাশভঙ্গীতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাতন্ত্র্য নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। শুধুমাত্র অগণিত পাঠক-পাঠিকার চিত্ত জয়ের সহজ উপায় হিসাবেই তিনি যে অলৌকিক কাহিনী রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন — এমনটা কিন্তু নয়; বস্তুতঃ অপ্রাকৃতের প্রতি লেখকের একটা নিগূঢ় আন্তরিক আকর্ষণ না থাকলে উক্ত বিষয় অবলম্বন করে কারো পক্ষেই বহুসংখ্যক রসোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভবপর নয়। শরদিন্দুর বিষয়ে এই তথ্যটি শুধু একটি অনুমান মাত্র নয়; কারণ — একজন কৌতূহলী পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে নিজের মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে স্বয়ং লেখকই জানিয়েছিলেন — “ভূতের গল্প সম্বন্ধে আমার একটু দুর্বলতা আছে।” (শরদিন্দু অমনিবাস, পঞ্চম খণ্ড, গল্প পরিচয়) অবশ্য শরদিন্দুর অলৌকিক গল্পগুলির পিছনে একই সঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের, বিশেষতঃ — আর্থার কোনান ডয়েল ও মোপ্যাসার লেখা কয়েকটি গল্পের পরোক্ষ প্রেরণা ছিল। যেমন — লেখকের স্বীকৃতি অনুসারে জানা যায় যে, তিনি তাঁর ‘রক্তখদ্যোত’ গল্পের শেষ কয়েকটি পংক্তির ভাবাংশ আর্থার কোনান ডয়েলের একটি গল্প থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, এবং তিনি তাঁর ‘অশরীরী’ গল্পটি মোপ্যাসার ‘La Horla’ গল্পের ভাবানুপ্রেরণায় রচনা করেছিলেন। (শরদিন্দু অমনিবাস, পঞ্চম খণ্ডের গল্প পরিচয় অংশ দ্রষ্টব্যঃ) অবশ্য এরকম দু’-একটি ক্ষেত্র ছাড়া শরদিন্দুর অধিকাংশ অলৌকিক গল্পই তাঁর মৌলিক চিন্তার ফসল। তিনি শুধু অনেকগুলি ভৌতিক গল্পই রচনা করেননি, একটি প্রেতপ্রেমিক চরিত্রও সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর নাম হল — বরদা। শরদিন্দুর প্রথম রোমাঞ্চ কাহিনী (যতদূর জানা যায় সেটি তাঁর লেখা প্রথম ছোট গল্পও বটে) ‘প্রেতপুরী’ ১৯১৫ সালে বা ১৩২২ বঙ্গাব্দে লেখা হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর বয়স। শরদিন্দুর সেই গল্পেই বরদার সঙ্গে পাঠক-পাঠিকার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। এরপরে শরদিন্দু সৃষ্ট অলৌকিক রসলোকের আলোছায়াময় পথে আরও বহুবার তাঁর দেখা পাওয়া যায়। মূলতঃ বরদার অভিজ্ঞতা সূত্রেই মুঙ্গের শহর ও বিহারের গ্রামাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে অপ্রাকৃত জগৎ নিজের অফুরন্ত রহস্য ও বিচিত্র বিস্ময় নিয়ে পাঠক-পাঠিকার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত বরদা কাহিনীর তালিকা এরকম — প্রেতপুরী (১৩২২ বঙ্গাব্দ), রক্তখদ্যোত (১৩৩৫-৩৬ বঙ্গাব্দ), টিকটিকির ডিম (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), মরণ ভোমরা (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), অশরীরী (১৩৩৯ বঙ্গাব্দ), সবুজ চশমা (১৩৪০ বঙ্গাব্দ), বহুরূপী (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ), প্রতিধ্বনি (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ), আকাশবাণী (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ), দেহান্তর (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ), নীলকর (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), মালকোষ (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ), এবং মরণদোল (১৩৪০ বঙ্গাব্দ)। স্থানাভাবের জন্য এখানে প্রথমে প্রেতপুরী, রক্তখদ্যোত, টিকটিকির ডিম, সবুজ চশমা, বহুরূপী, আকাশবাণী, দেহান্তর ও নীলকর কাহিনীগুলি এবং পরিশেষে বরদা চরিত্রটি নিয়ে আলোচা করা করা হল।
প্রেতপুরী (১৩২২ বঙ্গাব্দ): এই গল্পে বাংলার একটি পল্লীগ্রামে ভূতুড়ে বাড়ী বলে পরিচিত একটি নির্জন, পরিত্যক্ত গৃহ, সেখানকার ভৌতিক পরিবেশ, এবং সর্বোপরি গল্পটির শীর্ষনাম — পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে একটি রোমহর্ষক অলৌকিক গল্প পাঠের প্রত্যাশা জাগিয়ে তুললেও প্রকৃতপক্ষে এই কাহিনীতে লৌকিক জীবনেরই এক সকরুণ ট্র্যাজেডি উদঘাটিত হয়েছে। মদ্যাসক্তি ও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ক্রোধ মানুষের সমস্ত সাধ ও স্বপ্নকে কেমন করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারে — ‘প্রেতপুরী’ সেটারই নির্মম প্রতিচ্ছবি। প্রেতপুরীর বিপত্নীক গৃহস্বামী — মদ্যাকর্ষণ ও ক্রোধ — এই উভয় প্রভাবে একই দিনে নিজের চাকরি হারিয়েছিলেন, এবং তারপরে তিনি নিজের আদরিণী শিশু কন্যাটিকে হত্যা করে পুলিশের ভয়ে ফেরার হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নিষ্ঠুর অপরাধের গুরুত্ব অনুভব করে অনুতপ্ত হওয়ার শক্তিটুকুও তাঁর মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না, বরং তিনমাস যাবৎ মদ্যপান করতে না পারবার কষ্টেই তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। তাই গল্পে তাঁকে বলতে শোনা যায় — “মেয়েটা মরেছে—যাকগে। কিন্তু তার মল ক’গাছা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।” মেয়ের লুকিয়ে রাখা সেই মল ক’গাছার সন্ধানেই সে রাতের অন্ধকারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অগ্রাহ্য করে সর্বশক্তি দিয়ে গাছতলার মাটি কোপায়, আর সেটারই তালে তালে জনহীন ঘরের আলমারিতে রাখা সুরার শূন্য বোতলগুলিতে শব্দ হয় — ঝনঝন, ঝনঝন! সেখানকার সাধারণ মানুষ এই বাস্তব কার্যকারণ সূত্রকেই অপ্রাকৃত ঘটনা মনে করে বিভ্রান্ত হয়েছিল এবং সেই বাড়িটিকে প্রেতের আবাস ভেবে অযথা ভয় পেয়েছিল। কিন্তু ভূতের সম্পর্কে যাঁর অপরিসীম কৌতূহল ছিল, সেই বরদা বাড়িটি সম্পর্কে জনশ্রুতি শুনেও সেখানেই রাত্রিবাস করতে চেয়েছিলেন, এবং গভীর রাত্রে হঠাৎ দেওয়াল-আলমারির মধ্যে থেকে ভেসে আসা ঝনঝন শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়লেও নিজের মনোবল কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন নি। তাই তাঁর পক্ষে প্রেতপুরীর প্রকৃত রহস্য জানা সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য সেজন্য তাঁকে কিছু মূল্যও দিতে হয়েছিল, তাঁকে তাঁর সোনার ঘড়ি ও মানিব্যাগ খোয়াতে হয়েছিল। সেই চৌর্যক্রিয়াটুকুও কোনও প্রেতের অলৌকিক কাজ ছিল না, প্রেতপুরীর ভূতপূর্ব গৃহস্বামীই নিজের ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবারণের একান্ত লৌকিক প্রয়োজনেই সেগুলিকে আত্মসাৎ করেছিলেন। তাই এই গল্পের সূচনায় ভয়ানকের আভাস থাকলেও সমাপ্তি কিন্তু করুণ রসে ঘটেছে।

আরও পড়ুন: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৫ 

রক্তখদ্যোত (১৩৩৫-৩৬ বঙ্গাব্দ): এই গল্পে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে প্রেতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলোচ্য গল্পে মৃত সুরেশবাবুর আত্মা বরদার ভাই পাঁচুর মাধ্যমে তাঁর নিজের জীবনের একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছিল। তবে তাঁর বক্তব্য মুখের কথায় নয়, হাতের লেখায় প্রকাশিত হয়েছিল। সুরেশবাবুর প্রেতাত্মার সেই জবানবন্দী পাঠ করবার পরে পাঠক-পাঠিকার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, সত্যিই সুরেশবাবু কি সেই শীতের রাত্রে মুঙ্গেরের গঙ্গা উপকূলে অবস্থিত মুসলমানদের গোরস্থানে অলৌকিক কিছু দেখেছিলেন? অথবা তাঁর যুক্তিবাদী চেতন মনের অন্তরালে অবচেতনে সুপ্ত ভয়ের সহজাত সংস্কার, সেই জীবন্ত গোরস্থানটি সম্পর্কে ভীতিপ্রদ জনশ্রুতি, সেখানে দিনের আলোয় দেখা একটি গোরের উপরে শায়িত ভয়ংকর দর্শন কুকুরটির হিংস্র আচরণ, সর্বোপরি তমসাবৃত নির্জন রাত্রির প্রভাব কি সুরেশবাবুকে মানসিক দিক থেকে দুর্বল করে ফেলেছিল? তাই নিভন্ত চুরুটের অগ্নি-স্ফুলিঙ্গকে তিনি সেদিন সকালেই দেখা গোরস্থানের প্রহরী, অদ্ভুত কুকুরটির রক্তখদ্যোত সদৃশ মণিহীন, রক্তাভ দুটি চক্ষু বলে মনে করেছিলেন? গল্পে অবশ্য কুকুরের কামড়ে অথবা অলৌকিক কোনও কারণে সুরেশবাবুর মৃত্যু ঘটেনি, বরং সেই হিমশীতল আবহাওয়ায় সারারাত ধরে উন্মুক্ত প্রান্তরে অচৈতন্য অবস্থায় অতিবাহিত করবার ফলস্বরূপ তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সংশয় জাগে যে, তাঁর সেই জীবন পরিণাম কি নিছক ঘটনাচক্র, নাকি জীবন্ত কবরটির অশুভ প্রভাবে অবিশ্বাস করবার প্রতিফল ছিল? এই সংশয় ও রহস্যই রক্তখদ্যোতকে অলৌকিক গল্প হিসাবে সার্থক করে তুলেছে। গল্পের শেষাংশে সুরেশবাবুর আত্মার প্রেতলোকে অবস্থানের পরিকল্পনাটিও প্রশংসনীয়। দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি পেলেও অনেক সময়ে সদ্যমুক্ত আত্মা এই বিপুল পরিবর্তনকে সহজে অনুভব করতে পারে না — সুরেশবাবুর ক্ষেত্রেও সেরকমই কিছু ঘটেছিল, এবং নিজের মৃত্যুর পরেও প্রেতলোককে তিনি মর্ত্যলোক বলে ভেবেছিলেন। মৃত্যুর মহানিদ্রার শেষে আত্মার জাগরণকে তাঁর মানবদেহের রোগমুক্তির আনন্দ বলে মনে হয়েছিল, — তাই বহুকাল আগেই মৃত বাল্যবন্ধু বিনোদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পরে তিনি সবিস্ময়ে ভেবেছিলেন যে, কি উপায়ে পরলোকগত বিনোদের ইহলোকে আগমন ঘটেছিল? তখন বিনোদের আত্মাই তাঁকে সেই চরম সত্যটি জানিয়েছিল — “তুমিও আর বেঁচে নেই বন্ধু।” মানুষের জীবন ও মৃত্যুর প্রাকৃত ও অপ্রাকৃতের দ্বৈতলীলায় ভাস্বর রক্তখদ্যোত শরদিন্দু-সাহিত্যাকাশে একটি অত্যুজ্জ্বল আলোকবিন্দু।

টিকটিকির ডিম (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ): এই গল্পের উপসংহার পর্বে ভূতবিজ্ঞানী বড়দা মন্তব্য করেছিলেন — “ভয়ের যে বস্তুটা চোখ দিয়ে দেখা যায় না, যার ভয়ানকত্ব যুক্তির দ্বারা খণ্ডন করা যায় না এবং যার হাত থেকে উদ্ধার পাবার কোনো জানিত উপায় নেই, সে বস্তুই বোধ করি জগতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ভূতের ভয় ঐ জাতীয়।” কোন মানবাত্মা নয়, একটি মৃত টিকটিকির প্রতিশোধলিপ্সু আত্মা এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। একরাত্রে বরদার হস্তনিক্ষিপ্ত অভিধানের আঘাতেই সেই টিকটিকির মৃত্যু হয়েছিল, এবং সেই ঘটনার পর থেকেই বরদা প্রায়ই একই সঙ্গে দুটি করে টিকটিকির ডিম দেখতে পেয়েছিলেন। সেই অপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার অভিঘাতে ঘৃণায় ও আতঙ্কে বরদার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। টিকটিকির ডিম গল্পের বর্ণনা কৌশলের দ্বারা অলৌকিকতার স্বাদ সৃষ্টি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে গল্পটি কিছুটা মনস্তত্বমূলক। টিকটিকির প্রতি বরদার প্রথমাবধিই তীব্র বিতৃষ্ণা ছিল, তাঁর মতে — “জগতে যত রকম জানোয়ার আছে, আমার বিশ্বাস তার মধ্যে সবচেয়ে টিকটিকি বীভৎস। মাকড়সা, আরশোলা, শুয়োপোকা, কচ্ছপ এমনকি ব্যাঙ পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারি। কিন্তু টিকটিকি!” তাই তাঁরই টেবিলে একটি প্রকাণ্ড টিকটিকিকে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে দেখে ঘৃণায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য বরদা প্রবল আক্রোশে সেই টিকটিকিকে বধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবচেতন মনে সেই ঘটনার গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, নিগূঢ় এক পাপবোধ তাঁর অন্তরাত্মাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেই রাত্রেই বরদা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন, এবং তার পরদিন প্রভাতী চা পান করবার সময়ে টেবিলের ওপরে পাশাপাশি রাখা দুটি টিকটিকির ডিম তাঁর চোখে পড়েছিল। সেই ডিম দুটির অস্তিত্ব হয়ত অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু এরপর থেকেই তিনি যত্রতত্র টিকটিকির ডিম দেখতে শুরু করেছিলেন। তবে সেটা যে তাঁর রজ্জুতে সর্পভ্রম, তাঁর অস্থির মানসিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশমাত্র ছিল, এরকম অনুমানের সূত্রও গল্পটির মধ্যেই পাওয়া যায়; যেমন — ভাতের মধ্যে দুটি সিদ্ধ করমচাকে টিকটিকির ডিম বলে মনে করে তিনি প্রবল বিতৃষ্ণায় খাবার ফেলে উঠে গিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত নিজের বন্ধু শুভেন্দু মারফৎ বরদা গয়ায় গিয়ে সেই নিহত টিকটিকির উদ্দেশ্যে পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করে, টিকটিকির প্রেতাত্মার হাত থেকে নয় — প্রকারান্তরে নিজের বিবেক দংশন থেকেই মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই কাহিনীর পরিসমাপ্তিতে তাঁকে লঘু পরিহাসের সুরে বলতে শোনা গিয়েছিল — “সেই মায়ামুক্ত জীবাত্মা বোধ করি এখন দিব্যলোকে বৈকুণ্ঠের দেয়ালে উঠে পোকা ধরে ধরে খাচ্ছেন।”

মরণ ভোমরা (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ): এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি আশ্চর্য কাকতালীয় ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। মুঙ্গের শহরে অবস্থিত বরদাদের ক্লাবঘর হল এই গল্পের স্থান। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকের এক শীতার্ত সন্ধ্যায় সেখানে ভূতনাথ শিকদার নামের একজন বিচিত্র আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটেছিল। ছত্রিশ বছর বয়স্ক সেই শীর্ণ দর্শন মানুষটি ক্লাবের তিনজন সদস্যের কাছে তাঁর নিজের জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর বিবৃতি অনুসারে জানা যায় যে, ষোল থেকে ছত্রিশ — এই কুড়ি বছরের মধ্যে সেই ব্যক্তিটি তিনশো একুশবার একটি কালো ভ্রমরকে দেখেছিলেন। আর সেই ভোমরা দেখবার ফলে তাঁর কোনও ক্ষতি হয়নি বটে, কিন্তু তিনদিনের মধ্যে অপর কোনও ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, এবং প্রতিবারই সেই অলৌকিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। কুড়ি বছর ধরে বারংবার ভ্রমর দর্শন ও মৃত্যুর অপ্রতিহত সেই যোগাযোগ ভূতনাথ শিকদারকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল, ফলে তিনি নিজেই নিজের কাছে মূর্তিমান অলক্ষণরূপে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন এবং মানব সঙ্গ পরিহার করে স্বেচ্ছা নির্বাসনকে বরণ করে নিয়েছিলেন। ভূতনাথের সেই অদ্ভুত জীবনকথা ক্লাবের অন্য সদস্যেরা তো দূরের কথা, স্বয়ং বরদা পর্যন্ত সহজে বিশ্বাস করতে চাননি। বরদা নিজে ভূত-অভিজ্ঞ হলেও সেই ধরণের কোন অলৌকিকতার সঙ্গে তাঁর আগে কখনও পরিচয় ঘটেনি। তাই ভূতনাথের সম্বন্ধে তিনি তাঁর বন্ধুদের কানে কানে বলেছিলেন — “একেবারে বদ্ধ পাগল-মনোম্যানিয়াক।” কিন্তু ভূতনাথের বিবৃতি যে পাগলের প্রলাপ-মাত্র ছিল না, সেটার প্রমাণ অল্প কয়েক মুহূর্ত পরেই পাওয়া গিয়েছিল — যখন ক্লাবঘরের পশ্চিমদিকের জানালাটি খুলে দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাতায়ন পথ দিয়ে সেই ঘরে একটি কৃষ্ণ ভ্রমর প্রবেশ করেছিল। সেই মৃত্যুদূতের সাক্ষাৎ পাওয়া মাত্রই ভূতনাথ শিকদার উন্মাদের মত ঘর ছেড়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, আর ওই ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় তিন শ্রোতা — “বিহ্বল জিজ্ঞাসুভাবে পরস্পরের মুখের পানে” — তাকিয়ে ভেবেছিলেন — “তিন দিনের মধ্যে কাহাকে যাইতে হইবে?” এই মর্মন্তুদ জিজ্ঞাসার মাধ্যমে গল্পটি সমাপ্ত করবার পরিকল্পনায় শরদিন্দুর ছোট গল্প রচনার দক্ষতা সুপরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: হরিনাথ মজুমদারের সমাজসেবা

সবুজ চশমা (১৩৪০ বঙ্গাব্দ): একদা নাস্তিক বরদা হঠাৎ কি কারণে প্রেতের অস্তিত্বে গভীরভাবে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন, সবুজ চশমায় সেই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাই বিবৃত হয়েছে। একরাত্রে কিউল স্টেশনের প্রথম শ্রেণীর বিশ্রামাগারে পদার্থবিদ্যার স্বনামধন্য অধ্যাপক বিরাজমোহন সেনের সঙ্গে বরদার দেখা হয়েছিল; আর সেই সূত্রেই বরদার হাতে বাইনোকুলার চশমার মত দেখতে একটি অদ্ভুত চশমা এসেছিল — যেটার কাচের রং ছিল ফিকে সবুজ। সেই বিচিত্র বস্তুটির নির্মাতা অধ্যাপক সেনের সানন্দ সম্মতিতে ও সহযোগিতায় কৌতূহলী বরদা সেই সবুজ চশমাটি চোখে পরেছিলেন, এবং পরবার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বরদার চোখের সামনে ছায়াছবির মত ক্রমান্বয়ে অলৌকিক দৃশ্যাবলী পরিস্ফুট হতে সুরু করেছিল। কিউল স্টেশনের সেই প্রতীক্ষালয়ে প্রফেসর সেন ও বরদা ছাড়া তৃতীয় কোন প্রাণী উপস্থিত ছিল না, কিন্তু সবুজ চশমার ভেতর দিয়ে বরদা দেখতে পেয়েছিলেন — “… টেবিল ঘিরে প্রত্যেক চেয়ারে একটি করে লোক বসে আছেন— তাঁদের পেছনে মাথার পর মাথা, ঘরের মধ্যে তিল ফেলবার জায়গা নেই! … এঁদের যে কত রকম চেহারা, তা বর্ণনা করা যায় না। সাহেব আছেন, চীনাম্যান আছেন, ভারতীয় লোক আছেন, আবার নিকষকান্তি নিগ্রোও রয়েছেন— কোনও ভেদজ্ঞান নাই।” শুধুমাত্র অন্ধ বিশ্বাস নয়, অধ্যাপক সেনের আবিষ্কৃত সেই সবুজ চশমাটি — প্রেতলোক ও প্রেতযোনির অস্তিত্বকে বিজ্ঞানসম্মতরূপে প্রতিষ্ঠাদানের একটি দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে অধ্যাপক সেনের সেই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারটিকে প্রতিষ্ঠা দান করা শেষপর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কারণ — ওই চশমা চোখে দিয়ে প্রেতলোক দর্শনে তন্ময় বরদা এমনই বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন যে, সহসা তাঁর প্রতি বহুসংখ্যক প্রেতাত্মার সমবেত ক্রোধকে লক্ষ্য করে প্রাণভয়ে চশমাসহ পলায়ন করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে তিনি নিজে কোনমতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই সবুজ চশমাটি ট্রেনের চাকায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনাটি না ঘটলে বহু মানুষই ওই সবুজ চশমাটি চোখে দিয়ে অদৃশ্য প্রেতলোক দর্শন করবার সুযোগ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু অধ্যাপক সেনের সেই আবিষ্কার একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়নি। কারণ — বিশ্বের অন্ততঃ একটি মানুষ তাঁর সেই সবুজ চশমার মাধ্যমে প্রেতবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর নাম ছিল — বরদা। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ওই সবুজ চশমা শুধু বরদার কাছেই নয়, আজও শরদিন্দু-সাহিত্যের পাঠক-পাঠিকাদের কাছেও প্রেত চরিত্র সম্বন্ধে একাধিক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে চলেছে। যেমন — প্রেত সমাজে যে কোনও ধরণের বর্ণভেদ প্রচলিত নেই, প্রেতাত্মাদের দর্শন করা গেলেও তাঁদের কথা শোনা যায় না এবং তাঁদের সম্পর্কে মানুষের অযথা কৌতূহল তাঁরা মোটেই পছন্দ করেন না — এইসব বিষয়গুলি শরদিন্দুর ‘সবুজ চশমা’ গল্পটি পাঠ করলেই জানতে পারা যায়। শরদিন্দুর অলৌকিক ও অতিলৌকিক গল্পের সংকলন — ‘কল্পকুহেলী’–র ভূমিকায় সুভদ্রকুমার সেন সবুজ চশমাকে — ‘fantasy’ — জাতীয় রচনারূপে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর সেই অভিমত সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত ছিল। একটা অসম্ভব কল্পনা যে যথাযোগ্য উপস্থাপনার গুণে কতটা রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, শরদিন্দুর সবুজ চশমা সেটারই একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই গল্পে অলৌকিকতা থাকলেও সেটা মোটেও ভীতিপ্রদ নয়, বরং কৌতুক ও বিস্ময়ের অপূর্ব সমন্বয়ে গল্পটি পরম উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!