গল্প: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৬

।।শেষ পর্ব।।

পোস্টমর্টেম শেষ। পোস্টমর্টেম চলাকালীন আমি আমার দু’হাত দিয়ে চোখ দু’টি ঢেকে মর্গ থেকে অল্প দূরে এক জায়গায় বসেছিলাম। দরজা খোলার শব্দে আমি চোখ দুটো খুললাম। আমি হাত সরিয়ে দেখি, ডাক্তারবাবু মর্গের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার দেহকে কাটাছেঁড়া অবস্থায়, দ্বি-খন্ডিত অবস্থায়, চেরা অবস্থায় দেখতে পারব না বলে আমি আমার দেহের কাছে যেতে পারলাম না। অনেকটা দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দূর থেকে আমি দেখলাম, মর্গের ভেতর থেকে আমার দেহকে বাইরে বের করা হলো। তারপর আমার দেহকে ধীরে-ধীরে ‘স্বর্গের রথ’ লেখা শববাহী গাড়ির দিকে নিয়ে চলল। আস্তে-আস্তে ‘স্বর্গের রথ’ নামক শববাহী গাড়িতে আমার দেহকে তুলে দিল।

আমার চোখের পাতা স্থির পাতা হয়ে গেল। হাত-পা নিশ্চল হয়ে গেল। যে-জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম,সেই জায়গায় আমার শরীর আটকে গেল। আমার মুখের কথা হারিয়ে গেল। স্থির‌ চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমার মৃতদেহকে দেখতে লাগলাম।

আরও পড়ুন: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৫

মানুষের মন তিন প্রকার–চেতন মন, অচেতন‌ মন ও অবচেতন মন। জাগ্রত অবস্থায় মানুষের যে মন থাকে, তাকে বলা হয় চেতন মন। যে-মনে কোনও ঘটনা পৌঁছলে, সেই ঘটনা আর মানুষ স্মরণ করতে পারে না বা ভুলে যায়, সেই ধরনের মনকে বলে অচেতন মন। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে যে-মন কাজ করে, যে-মনে মানুষ স্বপ্ন দেখে, সেটা হলো অবচেতন মন। আমার দেহের ভেতর এখন কোন প্রকার মন আছে, আমার শরীরের মধ্যে এই মুহূর্তে কোন ধরনের মন অবস্থান করছে তা আমি তা জানি না। তবে আমার শরীরের ভেতরে প্রবল ধারায় অতিবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি‌। এক মিনিটের কম সময়ের মধ্যে শিলা ও বজ্রপাত সহকারে আমার দেহের মধ্যে ভীষণ ভাবে মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। ‘হিমালয়ান সুনামী’ নামক মেঘ-ভাঙা বৃষ্টির মতো আমার দেহের মধ্যে ব্যাপক হারে অনবরত মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল।

আমার দেহের বাইরে অনাবৃষ্টি। ভীষণ অনাবৃষ্টি। এক ফোঁটা জলের চিহ্ন নেই। গ্রীষ্মকালের ভয়ানক খরার মতো তীব্র খরা দেহের বাইরে। দেহের বাইরের দিকটা শুষ্ক। খুবই শুকনো। দেহের বাইরে জলাভাব। আমার শরীরের বাইরে জলের আকাল।

স্বর্গের রথে চালকের আসনে চালক বসল। চালক রথে স্টার্ট দিল। স্বর্গের রথ চালু হলো। আমার রুক্ষ, শুষ্ক দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগল। অঝোর ধারায় জল ঝরতে লাগল। আমার শরীরের বাইরে গাল, গলা ও বুক বেয়ে অজস্র ধারায় জল ঝরতে লাগল। স্বর্গের রথ চলতে শুরু করল। আমি আর নিশ্চুপ থাকতে পারলাম না, চুপচাপ থাকতে পারলাম না। আমি খুব জোরে কেঁদে উঠলাম। আমি বলে উঠলাম, ‘আবির, আর কিছু সময় পরে আমার শরীরের দাহ হবে, আমার দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর অল্প সময় পর আমার দেহ চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যাব আমি, চিরকালের জন্য হারিয়ে যাব আমি। আবির, তুমি একবার এসে আমাকে দেখে যাও। আবির, তুমি একটিবার আমাকে দেখে যাও।’

সমাপ্ত

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!