‘ময়লা আঁচল’ ফণীশ্বরনাথ রেণুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ২৩টি অধ্যায়ে এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ হয়েছে। বিবৃত হয়েছে আন্তেবাসী সমাজে বসবাসকারী মানুষজন ও উপজাতিদের কথা। হিন্দিকথাসাহিত্যে তথা ভারতীয় কথাসাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি মাইলস্টোন বলা যেতে পারে। এইজন্যই শিবদান সিংহ চৌহান বলেছেন : ‘ময়লা আঁচলে শুধু কিষাণ কেন, তথাকথিত ছোটজাত, উপজাতি আর আদিবাসীদের ভেতরেও তাদের জন্যে পূর্ব নির্দিষ্ট বাঁধা মাপের আওতা ছাড়িয়ে ওঠবার অদম্য আকুলতা-বর্ণগত ও শ্রেণীগত উভয় বাঁধন কাটিয়ে ওঠার প্রচণ্ড অস্থিরতার ছবি দেখা যায়। সেইসঙ্গে সাবেকী আমলের মজবুত শেকলের ফাঁস আর নিপুণ ফাঁদের আয়োজন ফাঁকি ভাওতা জালজোচ্চুরি চাঁদিচাবুক একচোখোমির অষ্টপাশে নিপীড়িত মানুষের মাথা চাড়া দেবার সামান্য প্রয়াসকেও গুঁড়িয়ে ফেলার সাফল্যের নির্মম করুণ ইতিবৃত্তও এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে চিত্রিত’। ফণীশ্বরনাথ রেণু জন্ম গ্রহণ করেন ১৯২১ সালে। তাঁর জন্ম বিহারের পূর্ণিয়াতে। তিনি উপন্যাস ও ছোটোগল্প দুই-ই লিখেছেন।‘ময়লাআঁচল’, ‘পরতীপরকথা’, ‘দীর্ঘতয়া’-তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাস। গল্পের মধ্যে লক্ষ করা যায় ‘ঠুমরী আর আদিম রাত্রিকী গল্প’। তিনি একজন একালের সার্থক ভারতীয় কথাসাহিত্যিক এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
স্বাধীনতার পর ভারতে ভোটদানের ব্যবস্থা, বিবিধ গণতান্ত্রিক অধিকারের বৈধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সমাজবাদের প্রতি স্বঘোষিত আনুগত্য ও নিষ্ঠার সংকল্পবাণী, প্রগতি পরিকল্পনা এবং শিল্পায়নের অগণিত বিধিবত প্রয়াস … সমস্ত কিছু সত্ত্বেও কায়েমী স্বার্থবাজদের অতিচতুর চক্রান্ত ও সকল কূটকৌশল সমস্ত মানুষের জাগরণের কল্যাণ স্বপ্নকে নিয়মিত চুরমার করে চলেছে সেই ধ্বংসক্রিয়া স্বাধীনতার পরে আরো তেজীয়ান হয়ে চলেছে। তারই পরিণামে স্বাধীন ভারতে আজকের গরীব, আগামীকাল কাঙাল, পরশু ভিখিরি হয়ে পড়েছে – ধনী আরও বিত্তবান আরও পয়মন্ত আরও আয়ুষ্মন্ত হয়ে উঠেছে। এই সর্বনাশা মারণযজ্ঞের সফল চিত্ররূপ ময়লা আঁচল। সমাজজীবনে এবং ব্যক্তিমানসে এই বিনষ্টির প্রতিক্রিয়া যে কত গভীর এবং কত ব্যাপক – ময়লা আঁচলে তা সুস্পষ্টরূপে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ময়লা আঁচল একটি নির্ভেজাল আঞ্চলিক উপন্যাস। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামীণ জীবনের উপাখ্যান এই উপন্যাসটির উপজীব্য বিষয়। এটি পূর্ণিয়া অঞ্চলের উপাখ্যান। পূর্ণিয়ার একপাশে নেপাল অপরপাশে বাংলাদেশ।
এই উপন্যাসটি সম্পর্কে ফণীশ্বরনাথ রেণু বলেছেন: ‘এতে ফুলের কথাও আছে, কাঁটার কথাও। যতটা ধুলো আছে, ততটা পরাগও আছে। কাদায় চন্দনে মাখামাখি হয়ে আছে। রূপ আর কুশ্রীতা দুইই মিলেমিশে রয়েছে এই কাহিনীতে। কোনো-কিছুর হাত থেকেই গা বাঁচিয়ে চলা সম্ভব হয়নি আমার।’
উপন্যাসের শুরুতেই অত্যাচারের কাহিনি দেখা যায়। অস্পৃশ্যতার প্রাঞ্জল দৃষ্টান্তও উপন্যাসকার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখানে দেখা যায় ‘… কালা চেথরুকে মিলিটারীতে গেরেপ্তার করেছে আর লোবিনলারের কুঁয়ো থেকে বালতি খুলে নিয়ে গেছে।’ পূর্ণিয়ার অজ পাড়াগায়ে ১৯৪২ সালের গণ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব এ গ্রামে এসে না পড়লেও অপ্রত্যক্ষভাবে একটা রেশ যেন ফল্গুধারার মতো এইসব সরল সাধাসিধে মানুষের মনে দাগ কেটে গেছে। ‘…মোগলাহি টিশানে গোরা সেপাইরা এক মুদীর মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে।’
নারী নির্যাতন পৃথিবীর এক চরম অভিশপ্ত গুপ্তরোগ। এই উপন্যাসের গোড়াতেই সেইকথা ঘোষিত হয়েছে কথাকারের বলিষ্ঠ কলম দ্বারা। শিখ ও গোরাদের মধ্যে এই নিয়ে দাঙ্গাও হয়েছে। লেখকের অপর একটি বর্ণনাতে যে তির্যক শ্যেণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়েছে পাঠকদের; তা যেন দৃশ্যায়িত হয়ে সমস্ত পাঠকের মনের ক্যানভাসে। তিনি বলছেন : ‘ঢোলবাজায় গ্রাম-কে-গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে, দুধের বাচ্চাটাও জ্যান্ত বেরুতে পারেনি। মুসহরুর শ্বশুর স্বচক্ষে দেখেছে – ঝলসানো মাছের মতন মরা মানুষের লাশ মাসের পর মাস পড়ে পড়ে পচছে কাগে অব্দি ছুঁতে পায়নি;’ নীচুজাতের ঘরে সাধারণত মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে না। তথাকথিত বাবুমশাই, মোসায়েবরা ধরেই নেন যে নীচু জাতের ঘরে দামি জিনিস মানেই ওটা কোথা থেকে না কোথা থেকে চুরি করে এনেছে। তাই গ্রামগঞ্জের মুরুব্বিস্থানীয় ব্যক্তি তশীলদার বিশ্বনাথ প্রসাদও কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায় – ‘‘লোবিন বালতি কোথায় পেল? নিশ্চয়ই চোরাই মাল। শালারা সব চুরি-চামারি করবে আর গায়ের বদনাম হবে।’’
ইংরেজি কইয়ে ব্রিটিশ কূটনৈতিক রাজনীতিবিদরা ভারতকে স্বাধীনতা দিতে চাননি মন থেকে। তাই স্বদেশী আন্দোলনে যে বা যারা যুক্ত ছিল সকলেই তাদের চোখে ছিল শত্রু বা সাম্রাজ্যবিরোধী। তাদের আসূর্যাস্ত সাম্রাজ্যের পতন স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে কষ্ট হয় মন থেকে। পরাধীন ভারতবর্ষে গয়লারা স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য মতবিরোধের, আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন হওয়াতে কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। আবার কেউ ভারতীয় জনতা পার্টিতেও যোগ দেয়। সেটা অন্য কথা। এখানে উল্লেখ্য গাড়োয়ান আন্দোলনেও গয়লারা বিশেষভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
অতীবকুসংস্কারাচ্ছন্ন চোখে রঙিন চশমাওয়ালারা নিজের মানুষ, পরের মানুষ চিনতে ভুল করে। তাই ‘যাদবটোলীর বাসিন্দারা বালদেবের হাতে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে হৈ-হল্লা করতে করতে এসে পৌঁছোল। তার কোমরের বাঁধা দড়িটার একমুড়ো সবাই মিলে চেপে ধরে আছে। ফেরারী আসামীকে ধরে আনতে পারলে সরকার থেকে ইনাম মেলে হাজার, দু’হাজার পাঁচ হাজার! কিন্তু সায়েব এই দৃশ্য দেখে চটেই আগুন, ‘‘ব্যাপার কী? একে বেঁধে এনেছ কেন? কী করেছে কি?’’
‘‘হুজুর, এই স্বদেশী অলাটার নাম বলদেও গোপ। দু’বছর জেল খেটে এয়েচে। এ-গাঁয়ের লোক নয়, চয়নপট্টিতে বাড়ি। এখানে মাসীর বাড়ি এয়েচে। খদ্দর পরে, জইহীন্ন বলে।’’
‘‘তা একে বেঁধেছ কেন।’’
‘‘আরে বলদেব না!’’ সায়েবের কেরানী বলদেবকে চিনতে পারে। ‘‘আরে এ যে বলদেও দেখছি। স্যার এ রামকৃষ্ণ কংগ্রেস আশ্রমের কর্মী। বড়ো বাহাদুর লোক।’’ যাদবের কবল থেকে মুক্তিলাভ করে বালদেব সায়েব আর কেরাণীবাবুকে দফায় দফায় ‘‘জয় হিন্দ’’ সার। সায়েব হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘আপনার গ্রামে ম্যালেরিয়া সেল্টার খোলা হচ্ছে। খুব বুড়ো ডাক্তার আসছেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের তরফ থেকে বাড়ি তৈরী করে দেওয়া হবে। কিন্তু বাদ বাকী কাজ আপনাদের সাহায্যেই হবে।’’
সাহেব মেমদের সান্নিধ্যে আসা যেন একটা গর্বের ব্যাপার। তখন নিজের দেশমাতৃকাকে ভুলে যাই। ভুলে যাই নিজের মায়ের কথা। সে জন্মদাত্রী মাই হোক আর ধাত্রীদেবীই হোক। বিদেশীয়ানার মধ্যে যেতে পারলে নিজেকে যেন একটু উঁচু উঁচু লাগে। তাই কথাকার একজায়গায় বলছেন ‘‘… গাওণা (দ্বিরাগমন) সেরে নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যুবক বর গাড়োয়ানকে বলে – এই যে ভাই এখানটায় একটু আস্তে হাঁকাও তো, কনেকে সায়েবের কুঠি দেখাব। … এই দেখ, মোকে সাহেবের কুঠি। … আর ঐ যে ওখানে হাওদাটা দেখছ, এতে নীল মাড়াই হ’ত।
নতুন বউ দুহাতে গাড়ির পরদা সরিয়ে, ঘোমটা একটু মাথার পেছন দিকে হেলিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে বাইরে তাকায় – শেঁয়াকুলের দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের মাঝখানে ইট-পাথরের ভগ্নস্তুপ! কুঠি আবার কোথায়!
বরের মুখে একটু অহংকারের রঙ লাগে।’ শাদা চামড়ার প্রতি কালা আদমি, (অনার্য নয়) দুর্বলতা প্রকাশ করে। ভুলে যায় ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’।
ময়লা আঁচলে গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতি প্রবহমাণভাবে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত। এবং আঞ্চলিক বুনোজঙ্গলাকীর্ণ, যা পাঠকের হৃদয়কে আকর্ষণ করে তোলে খুব স্বাভাবিকভাবে।
এই উপন্যাসে বাংলারই যেন প্রতিচ্ছবি প্রকৃতির বর্ণনাতে পাই। অজস্র তালগাছ, অসংখ্য খেজুরগাছ এখানে রয়েছে। আর আঞ্চলিক পরিভাষা বা Local Dialect-এ পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ এই উপন্যাসটি। যেমন ‘নবাবী তাড়বন্না’। নবাবী তাড়বন্না মানে তাল খেজুরের বন। আবার রয়েছে শেঁয়াকুলগাছ। তবে এখানে বন্ধ্যাজমিতে দুর্বাঘাস একেবারেই জন্মায় না। রসকষহীন এক উষর ভূমিতে কীভাবে যে কুলগাছের ঝাড় বেশ বিস্তৃতভাবে রয়েছে; তাও পাঠককে আকৃষ্ট করে। কুলগাছে কুল হলে তখন প্রকৃতি মনোরম হয়ে ওঠে।
ডব্লিউ.জি. মার্টিন সাহেব এই গ্রামে কুঠি বাড়ির ভিত গাথা শুরু করলেন। সেদিন আশে পাশের দশটি গ্রামে টিন বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল এ গঞ্জের নাম হবে মেরীগঞ্জ। জেলাবোর্ড রাস্তা বানিয়ে দেবে। পোস্টঅফিস বসবে। মার্টিন সাহেবের পত্নী ছিলেন অপ্সরার মতো দেখতে। কিন্তু তিনি মারা যান জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। মেরীগঞ্জে মেরীর দেহের সৎকার করেই মার্টিন সাহেব পূর্ণিয়া চলে গেলেন।
এমন সময় জার্মানির বৈজ্ঞানিকরা কয়লা থেকে নীল আবিষ্কারের পদ্ধতি প্রয়োগ করে নীলকর সাহেবদের মুখে চুনকালি ঘষে দিল।
বর্ণবৈষম্য এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে। এখানে তিনটি প্রধান দল রয়েছে। কায়স্থ, রাজপুত আর যাদব। ব্রাহ্মণরা আজও তৃতীয় শক্তি। গ্রামের অন্যান্য জাতের বাসিন্দাদের সুযোগ সুবিধামতো ওই প্রধান তিন দলের একটা না একটার সঙ্গে মিশে থাকে। কায়স্থটোলীর মুখিয়া বিশ্বনাথ প্রসাদ মল্লিক এই বর্ণিত কাহিনিতে রাজপারবঙ্গার তহশিলদার। তহশিলদারী ওঁদের বংশগত পেশা। তিন পুরুষ ধরে তারা করে আসছে। তারা অনেক জমির মালিক। সম্পন্ন কৃষক। গায়ের সমস্ত মানুষ তাই কায়স্থদের সমীহ করে চলে। খানদানী মেজাজ ও জমিদারী হালচাল এই কায়স্থদের মধ্যে দেখা যায়। এরাও বর্ণবাদী সমাজের শ্রেণিশত্রু। খেতে না পাওয়া মানুষকে বঞ্চনা করে জোতদার, জমিদার ধনী, ধূর্ত সামাজিকজীবের প্রতিনিধিত্ব করছে।
যাদবদের দল আলাদা। ও হ্যাঁ কায়স্থটোলীর লোকজন রাজপুতদের অঞ্চলকে বলে ‘সেপাইটোলী’। যাদবদের ‘মুখিয়া খেলাওন যাদবকে দশ বছর আগেও লোকে মোষ চরাতে দেখেছে। দুধ-ঘি বিক্কিরির জমানো পয়সার কথা যখন চারিদিকে বিশ্রীরকম রটে গেল তখন খেলাওনের ভারী চিন্তা হল। মাসের পর মাস তহশিলের বাড়ি ধর্ণা দিল, তোষামোদ করল। সার্কেল ম্যানেজারের বাড়ি ‘ডালা চড়াল’, সেপাইদেরকে পর্যন্ত দুধ-ঘি খাওয়াল। তারপর শেষমেষ কমলার ধারে পঞ্চাশ বিঘে জমির বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হল।
যে যাদবটোলার লোকজন একদা বলদেবকে বেঁধে সাহেবের কাছে ভালো হতে গেছিল। সময়ের সাথে সাথে চাকা ঘোরার মতোই মানুষের মন, ভাবনাচিন্তার স্তর বদলায়। তারা বলদেওর কাছে ক্ষমা চাইতে আসে। এসে বলে: ‘‘বলদেও ভাই! আমরা হলুম মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, তুমি গ্যানী। আমরা কুয়োর ব্যাঙ। তুমি তো দেশ বিদেশ ঘুরেছ, কত বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গ করেচো। আমাদের কসুর মাপ করে দাও।’’ জাত নিয়ে বড়াই করার কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন না করাই শ্রেয়। তবু বিংশ শতাব্দেও পল্লি অঞ্চলে জাত নিয়ে লড়াই বাঁধে। অস্পৃশ্যতা এই ভীমরাও আম্বেদকর-এর দেশে এখনও ছোঁয়াচে রোগের মতো বহাল তবিয়তে জীবিত রয়েছে। খেলাওন সিং অবশেষে বলদেওকে তোষামোদ করে বলে: ‘‘জাতের নাম, জাতের মান ইজ্জত তো তোমাদেরই হাতে। তুমি তো আর বাইরের লোক নও। তোমার মাসি হল আমার খুড়ি। আমরা সম্পর্কে ভাই ভাই।’’ এই অঞ্চলের নাম টোলী দিয়ে বেশিরভাগ। আঞ্চলিক পরিভাষাতে টোলী মানে অঞ্চল। বা এলাকা। তাই নামকরণও হয়েছে : ‘তন্ত্রিমা ছত্রীটোলী, যদুবংশী ছত্রীটোলী, গহলোত ছত্রীটোলী, কূর্ম ছত্রীটোলী, ধনুকধারী ছত্রীটোলী, কুশবাহা ছত্রীটোলী, ইত্যাদি ক্ষত্রিয়পল্লি, আর আমাত্য ব্রাহ্মণটোলী, পলিয়াটোলী এবং রৈদাসটোলীর লোকেরা শপথ করল যে সাতদিন কাজ বন্ধ। চাষাবাদ বন্ধ। আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শেষ তারা করবেই। এখানে অর্থনৈতিক; গ্রামীণজীবনে নিরক্ষর মানুষও যে কতটা অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতন সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজ সচেতন লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু –তিনি চরিত্রের মুখ দিয়ে বলেন: ‘‘কিন্তু ক্ষেতের কাজকম্ম বন্ধ করলে মালিকরা তো মজুরীর পয়সা দেবে না! দু-একদিনের কথা হয়, সে আলাদা! সাত-সাতটা দিন, বিনা মজুরীতে? এটা একটা মুশকিল ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না?’’ গ্রামীণ জীবনের অর্থনীতির কী সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন কথাকার তা বিস্ময় জাগায়। ‘‘রাউতহাটের হাটে কাটিহার মিলের কুলীগুলো চার আনা সের খামালু এমনি হাতে হাতে তুলে ফেলে। ওদের কথা আলাদা। কিন্তু আর সকলের তো অসুবিধা আছে।’’ এই সমস্যার সমাধানও তারা খুঁজে ফেলে নিমেষে। স্থির হয় মালিক পক্ষ যদি এক বেলার অর্থ দেয় তাহলে আর কোনো অসুবিধা হয় না।
যাদবটোলার বলদেওকে ঈর্ষায় সহ্য করতে পারে না। খানিক আগে এই কংগ্রেসী বলদেও’র বাপ উদ্ধার করছিল গালিগালাজ দিয়ে। অথচ কি আশ্চর্য বলদেও সামনে আসামাত্র সকলেই তাদের কাজ হাসিল করে দেবার জন্য তোষামোদ করে। এই হল পল্লিসংগ্রামের একটা বিচিত্র রূপের একদিক। অপর পাশে গয়লাটোলা থেকে একদল লোক আসছে ‘‘গয়লাটোলার লোক হঁসেরী (কাজিয়ার দল) করতে। একটি ছেলে ছুটে এসে খবর দেয়।
ফণীশ্বরনাথ রেণু-র ময়লা আঁচল একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। হিন্দি সাহিত্যে প্রেমচন্দের গোদানের পর এমন উপন্যাস আর নজরে পড়ে না। ভারতীয় আঞ্চলিক উপন্যাস দেখলেও যদিও সমস্ত ভাষার আঞ্চলিক উপন্যাস পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে এটি যে একটি বিশেষ উন্নতমানের ও উৎকৃষ্টমানের একটি আঞ্চলিক উপন্যাস সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অসমিয়া সাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাস আছে। অখণ্ড ভারতে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ রয়েছে। ‘সারেং বউ’ এবং চিত্ত সিংহের ‘নিষাদ’ এছাড়া তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক উপন্যাস। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অপর একটি কংগ্রেসি আন্দোলন ও গান্ধীজীর আবহকে কেন্দ্র করে সতীনাথ ভাঁদুরী ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাস রচনা করেছেন। যা কী না ভারতীয় আঞ্চলিক উপন্যাস ধারাকে করেছে বিশেষ স্থানে উন্নীত। পাশ্চাত্যের হোমিং ওয়ের ‘ওল্ড ম্যান এণ্ড দি সী’ একটি বিখ্যাত আঞ্চলিক উপন্যাস। সেখানেও মৎস্যজীবীর Coastal Culture নিয়ে মৎস্যজীবীদের জীবনালেখ্য নিয়ে অপূর্ব কাহিনি রচিত হয়েছে।
হিন্দি সাহিত্যের ময়লা আঁচল যদি ইংরেজি ভাষায় রচিত হত তবে এই উপন্যাসটি অনিবার্যভাবে নোবেল পাবার যোগ্য। তবে নোবেল প্রাইজের চাইতেও বড়ো বেশি পুরস্কার লেখক পেয়েছেন যে ভারতের প্রায় সব কটি ভাষাতেই এই গ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে। এবং পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাতেও এই গ্রন্থটি অনুবাদিত হয়েছে, যা খুব কম ভারতীয় উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে। সারা পৃথিবীতে জাতি বৈষম্য,অস্পৃশ্যতা একটা বড়ো সমস্যা। ১৮০৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেছেন দাস প্রথা উচ্ছেদকারী মহান মনীষী যিনি পরবর্তী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সেই আব্রাহাম লিঙ্কনও মর্মাহত হয়েছিলেন শাদা কালো বর্ণ বৈষম্য নিয়ে। মানুষকে হাটে কেনাবেচা দেখে লিঙ্কন সিদ্ধান্ত নেন যে যেমন করে হোক পৃথিবীর বুক থেকে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করবেন। তিনি চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু তারপর তিনি দাস প্রথা উচ্ছেদ করেন। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রদান করেন; কিন্তু সময়ের কালচক্রের গণ্ডিতে ব্যক্তিজীবনে টম মুডির অত্যাচারে জর্জরিত হয়েছেন। এবং ১৮৬৫ সালে নাট্যশালায় নাটক দেখার সময় তাকে প্রাণ হারাতে হয়। পাশাপাশি বর্ণবৈষম্য নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা আজীবন লড়াই করলেন। জেল খাটলেন। কিন্তু তিনি তাতে দমে যাননি। তিনি মানুষের জন্য জন্ম গ্রহণ করেছেন। মানুষের সেবায় তিনি আজীবন সঁপে দিয়েছেন।
বর্তমানে আলোচিত ময়লা আঁচলে বলদেও হিংসা, অন্যায়কে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি অন্যায়কাজের চরম বিরোধীতা করতেন। হিংসাত্মক কাজে মদত দেওয়াও পছন্দ করতেন না। ফণীশ্বর রেণুর আঞ্চলিক হিন্দি উপন্যাসে লোকসংগীতের, লোকাচারের অসংখ্য উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন-
চটাক চটপট পরত সিরপর ভাগত বাপ কে ভূতবা।
সবসে বঢ়ি কে তোহরে বন্দো মালিক বাবুক জুতবা!
[ভাত-রুটি, চিড়ে-মুড়ি, ফল-ফুলুরী সবই আমার বন্দনীয় বটে। তবে সবার বড়ো সবার ওপরে কাকে বন্দনা করি? মাথার ওপরে যার পটাপট ঘা পড়লে বাপ বাপ বলে মাথার ভূত পালাতে পথ পায় না, সেই মালিকবাবুর জুতোই হ’ল আমার সবচেয়ে বড়ো ভগবান!]
তারপরে প্রচলিত একটি প্রবাদও ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে ‘… পুরানো চাল ভাতে বাড়ে’ এবং রাগ তাল সহযোগে লোকসংগীতের পরিবেশন হচ্ছে। অথচ তিনতালের বোল বাজিয়ে প্রচলিত আঞ্চলিক গান গাওয়া হচ্ছে। যেমন
… ধিন ধিন না, ধিন না তিন না। এই তালে সমাজীরা গান শুরু করেন:
আহে লেল পরবেশ সুকুমারী হে
হংস গমন বিরখামন দুলারী হে।
মৃদঙ্গের তালে তালে নাটুয়া এই লোকসংগীত পরিবেশন করে। গ্রাম্য চরিত্র নাটুয়া। কিন্তু নৃত্যকুশলী নিখুঁত তালে তাল মিলিয়ে পা ফেলে। অপূর্ব, অসাধারণ নৃত্য পরিবেশন করেন এই লোকশিল্পী। ফণীশ্বরনাথ রেণুর শিল্পী মানস থেকে আঞ্চলিক পরিদৃশ্যময়তা যে অপরূপভাবে ধরা পড়েছে তা এক কথায় অনন্য। এই ময়লা আঁচলে অজস্র লোকশিল্পী, লোকসমাজের প্রতিনিধিরা সরাসরি পাঠকের সঙ্গে কথা বলেছেন। যা এককথায় অনবদ্য। ভারতীয় সাহিত্যকে তিনি একটি বিশেষ মাত্রা সংযোজিত করেছেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন ভারতীয় আঞ্চলিক উপন্যাস ও কথাসাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ দিক সমভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেগুলি বিপ্লব চক্রবর্তী তাঁর তারাশঙ্কর ও ভারতীয় কথা সাহিত্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল: ১. স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চিত্র উপস্থাপন। ২. শহর ও গ্রামে সাধারণ মানুষের গণমুখী আন্দোলনের শরিক হওয়ার চিত্রাঙ্কন। ৩. শ্রমিক ও কৃষক জনগন সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি। ৪. গ্রামের শোষিত, পীড়িত নিম্নবর্গের মানুষের অবস্থার রূপায়ণ। ৫. প্রচলিত সাহিত্যিক আদর্শের প্রতি বিরূপতা। ৬. সমাজ বাস্তবের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রবণতা। ৭. সাম্যবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ চরিত্রের অধিকতর রূপায়ণ। ৮. পুঁজিবাদের কাছে সামন্ত্রতন্ত্রের পরাজয়ের ইঙ্গিতপূর্ণ চিত্র পরিবেশন। ৯. জনমানসে গান্ধীজীর অসহযোগ ও অন্যান্য আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বর্ণনা। ১০. যুগসন্ধির দ্বন্দ্বে আলোড়িত ভারতীয় লোকায়ত জীবনধারার স্বরূপ সন্ধান চেষ্টা ও তার সাহিত্যিক রূপায়ণ। ১১. আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার প্রবণতা বৃদ্ধি। এখানে বলা উচিত যে হিন্দি সাহিত্যের অপর উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তাঁর ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ এবং ‘জীনে কে লিয়ে’ এক অনন্য মাত্রা সংযোজিত করেছে ভারতীয় কথা সাহিত্যকে।
ময়লা আঁচল উপন্যাসে ভগ্ন ও ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের প্রতিচ্ছবি ভাসিত হয়েছে; বিশেষত ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও সামন্ততন্ত্রের দ্বন্দ্বের চেহারা ধরা পড়েছে ফণীশ্বরনাথ রেণুর উপন্যাসে।
কন্নড় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক অনন্তমূর্তি। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে পরম্পরাগত মূল্যবোধ নিয়ে সমস্ত চর্চা ও চর্যা এবং জীবনবেদের কেন্দ্রভূমিতেই রয়েছে গ্রামীণ জনজীবন। জীবন ও সংগ্রামে গ্রামীণ পরিবেশ-এর সংস্কৃতি; আবহ বর্তমান। সেইসব মূল্যবোধ আজকের সুশিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় তার সদর্থের দিকটা হারিয়ে ফেলেছে। শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা, আর বিশ্বাস ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গিরও নিজস্ব অর্থ চলে যাচ্ছে। তাই লেখক আধুনিক মনস্ক লেখক হলেও তিনি তাঁর শিকড়কে অস্বীকার করেন না।তাই তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলে। আবার উচ্চস্তরের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে যুক্তিবিচার করে কাহিনির জাল বিস্তার করতে পারার জন্য তার প্রয়োজন প্রথম থেকেই নিজেকে তৈরি করে নেওয়া, প্রথম থেকে নেওয়া, প্রথম থেকে গ্রহিষ্ণু ক্ষমতার অধিকারী হবার মতন মন অনন্ত কৃষ্ণমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন।
এই ময়লা আঁচল উপন্যাসে আরও একটি লোসংগীত দেখা যায়। গানটি এখানে দেখানো হল:
আরো রাম রামরে দৈবা রে ঈসর রে মহাদেব,
রামে মাড়ী দেবী দুরগা দাহিন বোলে কাগ।
আপন মন মেঁ সোচ করৈয়ে মানিক সবদার
বাত মে নাহী মানে বীর কনোজিয়া গুয়ার…
হিন্দু মুসলিম নিয়ে এই উপন্যাসেও বিশেষত কংগ্রেসী ও কিছু অতীবকুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তির মনের সংকীর্ণতাও প্রকাশ পেয়েছে।ফণীশ্বরনাথ রেণু সমাজসচেতন লেখক। তিনি সমাজের জাতিভেদ প্রথাকে পর্যবেক্ষণ করে সুনিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং বলেছেন : ‘মেরীগঞ্জ থেকে কমলদহ দশ ক্রোশ পথ। দশ ক্রোশ যাতায়াত এমন কোনো বড়ো কথা নয়। কিন্তু সিলিপ্ পাওয়াটাই ছিল মহা ভাগ্যের কথা। কামরুদ্দিনবাবু আসলে কুঁজড়া (সবজিঅলা), বেগুন বেচে জমিদার হয়েছেন; ‘মুস্লীংগের’ (মুসলিম লীগ) লীডার। কাটিহার পূর্ণিয়া মোটর রাস্তার পাশেই তাঁর বাড়ি। হাকিম-হুকুমের দল হামেশাই তাঁর বাড়ি ওঠা-বসা করে থাকেন। মাসে ষাটটা মুরগি খরচা হয়। লোকে বলে, নতুন ‘ইস্ডিয়ো’ আসতেই গোটা এলাকায় চাউর হয়ে গেল যে এবারকার হাকিম বড় কড়াখাতের মানুষ। কারুর বাড়ি যাওয়া কি চা-পান খাওয়ার ধার ধারে না। তা কামরুদ্দিন বাবুই কি ছেড়ে দেবার বান্দা! ইস্ডিওর ডালেবর (ড্রাইভার) মুসলমান।তাকে কোরানের কসম খাইয়ে, পান-সুপুরির খরচা দিয়ে হাত করলেন। একবার কাটিহার থেকে ফেরার পথে, ঠিক কামরুদ্দিনবাবুর বাড়ির সামনে এসডিয়োর গাড়ি গেল খারাপ হয়ে।রাত দশটার সময়ে সায়েব আর কোথায় যাবেন? … ব্যস। এই ঘটনার পর থেকেই কামরুদ্দিনবাবু চোখ বুজে ‘বিলেক্’ করতে লাগলেন। একবার পুরৈলিয়ার মিটিনে কংগ্রেসী খুশায়বাবু হাকিমকে বললেন – ‘পাবলিস নানান কথা বল্ছে।’ কামরুদ্দিনবাবুও হেসে জিজ্ঞেস করলেন – হিন্দু পাবলিস না মুসলমান পাবলিস।’
সাম্প্রদায়িকতার মতো ছোঁয়াচে মারণব্যধি সমস্ত সমাজেই ছিল। এখনও অনেক বুদ্ধিজীবী জোর দিয়ে বলেন – আমরা সাম্প্রদায়িকতা মানি না। অথচ খবরের কাগজে বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে নজর দিলেই বোঝা যায় এইসব বুদ্ধিজীবীদের কঙ্কালসার প্রকৃত চেহারা।
আঠারো অধ্যায়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছে নিরমলা নামের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। ডাক্তারবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করেন নাম কী –
‘নিরমলা।’
‘‘ডাগতার বাবু, আমার মেয়ে।’’ – এক বুড়ো হাত জোড় করে এগিয়ে আসে। বিড় বিড় করে বলে – ‘‘আজ থেকে প্রায় একবছর আগে একটা চোখের ওপর ভোমরায় ঝাপটা মেরেছিল। কিছুদিন বাদে দুটো চোখেই ঝাপসা দেখতে থাকে। নানারকম জংলী দাওয়াই করেছি। কিছু ফল হয়নি। এখন একদম দেখতে পায় না।’’ নজর দেবার মতো সুন্দরী নিরমলা। দুধে আলতায় গোলা রঙ। … অবিমিশ্র মৈথিলী সৌন্দর্য। ভ্রমরের ভ্রম হয়নি। দেখি চোখ! … আর একটু এগিয়ে আসুন। … এক ফোঁটা আইড্রপের অভাবে পদ্মের মতন সুন্দর চোখ দুটো জন্মের মতন নষ্ট হয়ে গেছে। … এখন সব চিকিৎসার বাইরে। …’
এরপর নিরমলার করুণ আর্তনাদ ব্যক্ত হয়। প্রকাশ পায় নারী হৃদয়ের গাণিতিক বা লোকগণিতের চেতনা। নিরমলা বলে: ‘‘ডাগতার বাবু!’’
‘রোগিনী কথা বলছে। কী মিষ্টি গলার স্বর। ‘‘অনেক নাম শুনেছি আপনার। অনেক আশা নিয়ে এসেছি – বাইশ ক্রোশ দূর থেকে ভগবান আপনাকে যশ দেবেন!’’
এখানে দূরত্বের পরিমাপের কথা ‘বাইশ ক্রোশ’-এর কথা বলা হয়েছে। সে অন্ধ হলেও তার মনে দূরত্বের পরিমাপের এককের কথা তার মানসজাত তা সে তার বক্তব্যে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ ফণীশ্বরনাথ রেণু যথার্থ একজন উচ্চতর শ্রেষ্ঠতম কলাকার না হলে সময় চেতনা, কালচেতনা, দূরত্ব ও পরিমিতবোধ এত নিখুঁত হত না। তাই তাঁর ময়লা আঁচল পাঠকমহলে এত সমাদৃত হয়েছে। সোসাইটি বা সমাজ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে আইনস্টাইনের মত স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন: A man’s value to the community depends primarily on how far his feelings, thoughts, and actions are directed towards promoting the good of his fellows. We call him good or bad according to his attitude in this respect. It looks at first sight as if our estimate of a man depended entirely on his social qualities. এছাড়া আইনস্টাইন ক্লাসিক মাহাকাব্যিক সাহিত্য সম্পর্কে On Classic Literature বক্তৃতাতে বলেছেন : ‘The reare only a few enlighted people with a lucid mind and style and with good taste with in a century. What has been preserved of their work belongs among the most precious possessions of mankind. We owe it to a few writer so fantiquity that the people in the middle Age coulds lowly extricate themselves from the superstitious and ignorance that had darkened life for more than half a millennium. Nothing is more needed to overcome the modernist’s snobbishness.
গল্পসাহিত্য বা কথাসাহিত্য আধুনিক সাহিত্যের একটি বিশেষ শক্তিশালা ধারা। কিন্তু আজকে নয় আদিকাল বা মানবসভ্যতার গোড়া থেকেই গল্পবলা, কাহিনি মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ লোককথার হাত ধরেই আজকের এই আধুনিক কথাসাহিত্যের উৎপত্তি। তাই সাহিত্যজগতে কাহিনি বা আখ্যানকাব্যই সবচাইতে পুরাতন। আগে, বহু আগে এইসব কথিতসাহিত্য ছিল গেয়। এবং তা তাল লয় সুর সহযোগে পরিবেশিত হত। ‘পুর্বতন উপকথা থেকে অধুনাতম গল্প অবধি কালের গতি ও মানুষের রুচিভেদে বহু পরিবর্তন হয়েছে; প্রাচীন উপাখ্যান কৌতূহলোদ্দীপক এবং আধ্যাত্মভাববহুল; কিন্তু আধুনিক গল্প সম্পূর্ণভাবে জীবনধর্মী।একদা কাহিনীতে নানা রূপ বৈচিত্র্য, কৌতূহলভাব ও অতীন্দ্রিয় অনুভূতি প্রভৃতি স্থান পেত। কাহিনীতে নানারূপ বৈচিত্র্য, কৌতূহলভাব ও অতীন্দ্রিয় অনুভূতি প্রভৃতি স্থান পেত। কিন্তু আধুনিক ছোটোগল্পে জীবনের সমস্যা, মনোজগতের রহস্য, বহুবিধ অভিজ্ঞতা প্রচুর পরিমাণে স্থান পাচ্ছে যার ফলে জীবন আমাদের কাছে এক গভীর সত্য ব’লে প্রতীত হচ্ছে। গল্পবর্ণিত চরিত্রগুলির সুখদুঃখে আমরা যতটা প্রভাবিত হই বাস্তব জীবনে তত হই না যে পর্যন্ত না তা বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিধির মধ্যে এসে পৌঁছায়।’
আধুনিক বা Modern Literature বলে আমরা যতই গলাবাজি করি না কেন – তার উৎসমূল রয়েছে অতীতের আদিম মানুষের মুখনিঃসৃত ছোটোছোটো রূপকথা। সেই কথাও কাহিনি আজকের সাহিত্যিকরা উপকরণ ও উপাদান হিসাবে গ্রহণ করে তাতে সমাজতন্ত্র, রোমান্টিকতা, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ, প্রতীকবাদ সহ আরো অন্যান্য অজস্র মতবাদ মিশিয়ে সাহিত্যিকরা সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন। তাই প্রকৃত শিল্পী কখনও তাঁর ঐতিহ্য, শিকড়কে অস্বীকার করে না।
‘জীবনের স্বরূপ ও যথার্থ্য আবিষ্কারের প্রয়াস গল্প সাহিত্যিকে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী করে তোলে।
কেরলের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের মতোই গল্প-সাহিত্যেও অতঃপর উত্থান পতনের পরিস্থিতি এলো। গোড়ার দিকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের ভূমিকা এমনই এক অভ্যাসে পরিণত হয় যে শিল্প-নৈপুণ্যের বিষয়টি অবহেলিত হতে থাকে। একই সময়ে বিশ্বসাহিত্যে আবির্ভূত হ’ল আধুনিকতার জোয়ার সৃষ্টিশীল কাজে যে কোন রকমের বিধিনিষেধ আরোপই অপাংক্তেয় গণ্য হ’ল। নতুন লেখকদের অনেকেই তখন মানবজীবনের বাহ্যিক রূপের প্রতি আর অনুরক্ত নন, প্রাণের গভীরে ডুব দিয়ে নতুন রহস্য সন্ধানেই তারা অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মানব প্রকৃতির অন্তর্জগতের যে-সব প্রতিক্রিয়া মানুষের প্রত্যক্ষ জীবনকে প্রভাবিত করে সেগুলির প্রতিই সৃষ্টি হ’ল তাঁদের আগ্রহ এবং ঘটনার ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ করার চেয়ে পাঠকের কাছে আভ্যন্তরীণ প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিক্রিয়াজাত অনুভূতির উন্মোচন করাই তাঁরা শ্রেয় বোধ করলেন। এই নতুন ভাবরূপের বিশ্লেষণে তাদের অনুসৃতব্য রূপ ও রীতির সাবেকী ধরণ ও শৈলী অপর্যাপ্ত মনে হ’ল।’
ময়লা আঁচল উপন্যাসে সাঁওতাল জীবনযাপনের কথাও সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। সাঁওতালরা কঠোর-কঠিন পরিশ্রমী। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে। সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরে। সামান্য কিছু আনাজপাতি দিয়ে কোনোরকমে দুটো চাল ফুটিয়ে খায়। তাদের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ ও সংগ্রাম পূর্ণ। আজও তারা বঞ্চিত শোষিত। ময়লা আঁচলেও তার আভাস দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে তহশীলদার দিনভর তাড়ি খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। রাত্তিরে সাঁওতাল পল্লির রমনীরা চোলাই করে মহুয়ার রস তৈরি করে। আর সেই মহুয়া আকন্ঠ পান করে তহশীলদার। তাকে সজ্ঞানে কখনো পাওয়া যায় না। তাদের প্রতি যে কেমন জোর জুলুম চলে ফণীশ্বরনাথ রেণু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছেন। সামন্ততান্ত্রিক প্রতিনিধির মুখ দিয়ে বলিয়েছেন:
‘‘কাজ করছে না তো এই নাও এক গেলাস। গেলো শালা। যদি কোথাও মুখ খুলেছ, তো এই দেখেছ বন্দুক!’’
উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে আমরা মমতা নামে যে চরিত্রটি পাই সে ভাস্বর। লেখক যেভাবে বর্ণনা করেছেন সেখানে হাসির আড়ালে থেকে যায় অব্যক্ত যন্ত্রণা। যন্ত্রণা নিয়েই মমতাকে আজীবন কাটাতে হবে। মমতা মায়াময়। তার স্নেহে মানুষ শান্তি পেলেও সে নিজে কিন্তু শান্তি পায় না। যে শান্তি দেয়, সে নিজে থাকে অশান্তিতে এই চিরকালের শাশ্বত নিয়ম। তাই লেখকের বিবৃতিতে পাই:
‘মমতা হাসে’ বলে, ‘‘মন বলছে আঁচল বিছিয়ে কাউকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করি – সফল হও, সার্থক হও। লোভ হচ্ছে – কোন কর্মযোগীর পায়ের ধুলো নিয়ে বলি …’’ হাসতে হাসতে প্রশান্তর পায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে।
‘মমতা!’
‘মমতাদি। নাও তোমার ছেলে। কেবল দুধ তোলে।’ কমলা হাসতে হাসতে ছেলে কোলে ঘরে ঢোকে।’
আবার এই উপন্যাসের একেবারে শেষ অংশে মমতা বলে: ‘‘না না না … আ আ। কী হয়েছে, কিছু হয়নি। খেয়ে নাও বাবু। আমার নীলু, আমার সোনামাণিক … আমার রাজা বাবু … কাঁদে না! আর তো কাঁদবার কিছু নেই বাছা’’ মমতা হেসে ওঠে।
কালিমুদ্দিপুর ঘাটের পাশে চেথরিয়া-পীরের থানে, আবার কেউ বুঝি মানত ক’রে আর-একখণ্ড ফালি বেঁধে দিয়ে গেছে।’
সমাজ সংসারের মানুষের বিশ্বাস, সংস্কার, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, গণনক্রিয়া, সহ লোকসংস্কৃতির সমস্ত উপাদান ময়লা আঁচল উপন্যাসে উপস্থিত। এছাড়া গান্ধিজীর মতাদর্শ নিয়ে এই উপন্যাসের চরিত্ররা অধিকাংশই মেনে চলেছে। দেশকে স্বাধীন করার জন্য স্বদেশীয়ানার বাস্তব প্রয়োগে তারা ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
স্বদেশীয়ানা, অহিংসা, বিলাতী দ্রব্যপণ্য বর্জন এইসব আদর্শ চরিত্রগুলির মধ্যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের মজ্জায় মজ্জায় নিহিত রয়েছে। এবং সমস্ত চরিত্রগুলিকে অতিমনোহর সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার অমর সৃষ্টি ‘ময়লা আঁচল’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১। রেণু, ফণীশ্বরনাথ (অনুবাদ: প্রসুন মিত্র), ময়লা আঁচল, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া, ১৯৭৫;
২। চক্রবর্তী, বিপ্লব, তারাশঙ্কর ও ভারতীয় কথা সাহিত্য,পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৯৯;
৩। নায়ক, জি.এইচ. (অনুবাদ: মুকুল গুহ), কন্নড় ছোটগল্প সঙ্কলন, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট,ইণ্ডিয়া, ১৯৯৬
৪। Einstein,A. Ideas and Opinions, Rupa&Co.,NewDelhi, 2006; pp. 13
৫। Einstein,A. Ideas and Opinions, Rupa&Co.,NewDelhi, 2006; pp. 65
৬। পট্টনায়ক, পাঠানি (সম্পাদক) (অনুবাদ: জ্যোতিরিন্দ্রমোহন জোয়ারদার), ওড়িয়া ছোটগল্প সংকলন, ভূমিকা থেকে নেওয়া, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, নয়াদিল্লি,১৯৮৬; পৃ. ৫
৭। পিল্লে, এন.এন. ওমচেরী (সম্পাদক) (অনুবাদ: দিবেন্দু পালিত) মলয়ালম গল্পগুচ্ছ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৯৮৬; পৃ. ৮-৯
৮। সিং ড. নামবর (সম্পাদক), (অনুবাদ : ইন্দ্রানী সরকার) হিন্দী গল্পগুচ্ছ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৯৯৫;