এই উত্তরদেশ, এই জোড়া মহিষের দেশ (সপ্তম পর্ব)

১৯.

‘ধওলি রে মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোনো জনে যুক্তি করি চল পলেয়া যাই’

গঙ্গাধরের পাড়ে পাড়ে চরে চরে সেই কত কত যুগ ধরে গোয়ালপাড়ার মেয়েরা এই গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিয়ে কি এক হাহাকারের সুরে সুরে তাদের শরীরে নাচ জাগাতে জাগাতে জীবনের আবহমান এক আর্তি ছড়িয়ে দেয়। দূরের মাঠপ্রান্তরে তখন বিকেলশেষের মায়া। মায়ায় মায়ায় বুঝি আস্ত এক জীবনের ঘোর। গানের দেশে, নাচের দেশে, হেমন্তের হিমের দেশে গানভরা এক জীবনের গল্প প্রখরতার উত্তাপ ছড়াতে থাকলে আবার ঘুরে ঘুরে গান নেমে আসে মরণ ও জন্মের এই দুনিয়াদারির ভিতর-

‘নাল টিয়া নাল টিয়া রে তোর ভাসা নলের আগালে/
বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে’

এইসব চলতে থাকে। ভরা হাটের ভেতর থেকে এক পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসে নাজিমুদ্দিন ওস্তাদ। সে তার জীবনের গল্পের দিকে একপর্বে আমাদেরকে প্রবল টেনে আনবে। আমরা নুতন করে শুনে নেব চর দখলের লড়াই আর হাতিক্যাম্পের গল্প। বিষ্ময় নিয়ে শুনতে থাকবো কিভাবে গান আর বাজনা আর নাচ দিয়ে বুনো হাতিদের পোষ মানানো হত কুমারসাহেবের জঙ্গলবাড়ির সেই ক্যাম্পে।

আরও পড়ুন: এই উত্তরদেশ, এই জোড়া মহিষের দেশ (ষষ্ঠ পর্ব)

নাজিমুদ্দিন তখন গাবুর বয়সের চেংড়া। আব্বার সাথে রূপসীর জমিদারের লেঠেলবাহিনীর হুকাতামাকের দায়িত্ব তার উপর। পাশাপাশি মুন্সি চাচার কাছে লাঠি চালনার তালিম নিচ্ছে। আর ফাঁক পেলেই গঙ্গাধরের কাছারে কাছারে জল ভরতে আসা সুন্দরী কইন্যাদের সাথে রঙ্গরস করা আর খোসা নাচের মত গেয়েও ওঠা-

‘আন্ধ্যারে ধান্দারে নাচবা নাকি দুলাভাই
দুলা তুই হ্যাচাকের বায়না দে’

এইসব দেখে জরিনা, আবেদা, হাসিনা, ফুলেশ্বরীদের কি খলখল হেসে ওঠা। তারাও কখনো গানে গানে প্রতি উত্তর দিত-

‘ফাতেরা রে ফাতেরা
বগরিবাড়ির ফাতেরা”

কি অন্যরকম জীবন ছিল তখন। আলো ছিল। স্বপ্নের ভেতর খেলে বেড়াতো হলখল মরিচের খেত। আর সেই নদীপাড়ের জীবন থেকেই তো সে তার জীবনে টেনে এনেছিল জরিনাকে।

হায়রে জীবন! সে বারবার তাকে ডুবিয়েই মারলো এই ধানপাটকামলাকিষান আর ভরা সব হাট পাচালির ভিতর!

আরও পড়ুন: পরব ভাঙা হাটের হাটুরে ১

২০.

ইউসুফ মোল্লার বেশ মনে পড়ে শালমারার বড় বালার চরে বড় রাজকুমারীর গান নিয়ে নাচ নিয়ে বাদ্য বাজনা নিয়ে এক শীতের রাতে জমিয়ে তোলা গানবাড়ির কথা। ইউসুফ মোল্লা তখন সদ্য যুবক।পালতোলা নৌকোর দুরন্ত মাঝি। ব্রহ্মপুত্র শাসন করে সে। পণ্য পৌঁছে দেয় বন্দরে বন্দরে। আর নেশা বলতে গানবাড়িতে ঘুরে ঘুরে গান শোনা।

তখন রাজবহাদুর প্রভাত বড়ুয়া বেঁচে। শিকারে যান মস্ত দাঁতাল হাতি জংবাহাদুরের পিঠে চড়ে। বড় রাজকুমারী আর ছোট রাজকুমারী তখন গঞ্জ গা হাট ঘুরে ঘুরে গান, নাচ, শোলোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নিজেরাও নাচছেন। গাইছেন।

বালাবাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব গান। যা চিরকালীন। যা ভরভরন্ত জীবনের কথা বলে-

“কালা বাইগণ ধওলা রে
বাইগণের গোড়ায় কাটা”

এক হাট থেকে বেরিয়ে নুতন এক হাটে প্রবেশ করতে গিয়ে এই চার কুড়ি পেরিয়ে আসা জীবনে বারবার ইউসুফ মোল্লার মনে পড়ে সেই সব সোনার বরণ পাখির মতন দিনগুলির কথা।

হায়রে, কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে মানুষের জীবনে! জলে ভিজে ওঠে ইউসুফের চোখ। সে দেখতে পায় “টলমল টলমল কচুপাতার পানি”।

ঠিক এখানেই একটা গল্প শেষ হয়ে যায়, নুতন এক শুরুর অপেক্ষায়!

আরও পড়ুন: রথযাত্রার সাংস্কৃতিক উৎস

২১.

যাতায়াতের রাস্তায় কত রকমের মানুষের সঙ্গেই যে দেখা হয়! অন্তহীন কথা হয়। গল্প হয়। সেই গল্প জুড়ে পুরোন কোন ধনীবাড়ির খোলানে ঘুরে বেড়ানো হাঁস মুরগী কইতরের দল যেমন থাকে তেমন থাকে পাকঘর, পুরোন খড়ম আর ঢেঁকি পাড়ের শব্দ।

গঙ্গাধরের পারের চরগুলি থেকে ধান নিয়ে যান জামালউদ্দিন ভাই। তার জোড়া মহিষের “ভইসা গাড়ি”। সন্ধ্যের শেয়াল দৌড়ে বেড়ায়। একটা মেটাফিজিকাল ডার্কনেস জড়ানো পৃথিবীতে গান বাজে, গান ঘুরে বেড়ায়-

“আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে”

আর জামালউদ্দিন ভাইয়ের “ভইসা গাড়ি”র নিচে দুলতে থাকে ভুসো কালি মাখা লন্ঠন। আমি কূপি আর লন্ঠন হারানো হাটগুলোর কথা ভাবতে থাকি।

তখন ঘোড়া জোতদারের টাড়িতে চুপচাপ মস্ত এক ছায়াশরীরের মত এগিয়ে আসতে থাকেন মহি গিদাল। রাত ঘন হতে থাকে। নিশি পংখী উড়াল দেয় গঙ্গাধর পেরিয়ে বুঝি নদী গদাধরের দিকে।

মহি গীদাল তার দোতরার কান মোচড়ান আর গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন-

“ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি”

আমি গল্পের শরীরে হাত রাখি। এভাবে গঙ্গাধরের পারে পারে জীবনের পর জীবন বেশ গুছিয়ে রাখা থাকে, হেমন্ত মাঠে শুয়ে থাকা পাকা ধানের আটির মত!

চলবে…

ছবিঋণ: সুবীর সরকার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!