একথা আমরা জানি যে, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সমস্ত শাখায় বিচরণ করেছেন। জীবনকে তিনি সঁপে দিয়েছেন সাহিত্যের সেবায়। এছাড়া তিনি সংগীত ও চিত্রকলার জগতেও সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বাঙালি হিসাবে গর্ববোধ করি এই বাংলার বুকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তিনি বাংলা ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন। এবং তারজন্য তিনি নোবেল প্রাইজও পেয়েছেন।
হৃদয়ের ভাব উদ্রেক করা সাহিত্যের প্রধান কাজ এবং ধর্ম। মানুষের সঙ্গে মানুষের নিবিড় ষোগাষোগ স্থাপন করাও অন্যতম কাজ। এই কাজকে সুচারুভাবে নিষ্পন্ন করে হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের সূক্ষনিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে। সাহিত্যের কাজই হল মানুষকে একত্রিত করা। আর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন সাহিত্যসেবার মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন মনুষ্যত্বকে মর্যাদা দিয়ে। কবিতা হল মানবজাতির মাতৃভাষা। শুধু মাতৃভাষাই নয় বরং তা সংকেতময় ভাষা বললেও কিছু খারাপ বলা হয় না। কবিতা যূথবদ্ধ সমাজের মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে। বহু প্রচীনকাল থেকে কবিতার উৎস। আগে ছিল কবিতা শ্রুতিতে পরে আসে তা লেখনীতে। আমরা সকলেই জানি যে কবি হল আনন্দের স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
রবীন্দ্রনাথ আজীবন কবিতা নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছেন। তারই একটি প্রয়াস ‘কণিকা’ কাব্য। কাব্যটি ১৩০৬ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘কণিকা’ কাব্যে সর্বমোট ১১০ টি কবিতা রয়েছে। আকারের দিক দিয়ে কবিতা গুলি সংক্ষিপ্ত বা ছোট। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত ভাবের দিক থেকে অনেক গভীর ও ব্যাপ্তি বিশাল। কবি যে সমস্ত কবিতাকে এই কাব্যে স্থান দিয়েছেন সেগুলি হল—‘যথার্থ আপন’, ‘শক্তির সীমা’, ‘নূতন চাল’, ‘অকর্মার বিভ্রাট’, ‘হার জিত , ‘ভার’, ‘কীটের বিচার’, ‘যথাকর্তব্য’, ‘অসম্পূর্ণ সংবাদ’, ‘ঈর্ষার সন্দেহ’, ‘অধিকার’, ‘নিন্দুকের দুরাশা’, ‘রাষ্ট্রনীতি’, ‘গুণজ্ঞ’, ‘চুরি নিবারণ’, ‘আত্মশত্রুতা’, ‘দানরিক্ত’, ‘স্পষ্টভাষী’, ‘প্রতাপের তাপ’, ‘নম্রতা’, ‘ভিক্ষা ও উপার্জন’, ‘উচ্চের প্রয়োজনে’, ‘অচেতন মাহাত্ম্য’, ‘শক্তের ক্ষমা’, ‘প্রকারভেদ’, খেলেনা, ‘একতরফা হিসাব’, ‘অল্প জানা ও বেশি জানা’, ‘মূল’ , ‘হাতে-কলমে’, ‘পর-বিচারে গৃহভেদ’, ‘গরজের আত্মীয়তা’, ‘সাম্যনীতি’, ‘কুটুম্বিতাবিচার’, ‘উদারচরিতনামা’, ‘জ্ঞানের দৃষ্টি ও প্রেমের সম্ভোগ’, ‘সমালোচক’, ‘বিদ্বেষ দ্বেষী’, ‘ভক্তি ও অতিভক্তি’, ‘প্রবীন ও নবীন’, ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘কৃতীর প্রমাদ’, ‘অসম্ভব ভালো’, ‘নদীর প্রতি খাল’, ‘স্পর্ধী’, ‘অযোগ্যের উপহাস’, ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’, ‘পরের কর্ম বিচার’, ‘গদ্য ও পদ্য’, ‘ভক্তিভাজন’, ‘ক্ষুদ্রের দণ্ড’, ‘সন্দেহের কারণ’, ‘নিরাপদ নীচতা’, ‘পরিচয়’, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘অসাধ্যচেষ্টা’, ‘ভালো মন্দ’, ‘একই পথ’, ‘কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ’, ‘গালির ভঙ্গি’, ‘কলঙ্ক ব্যবসায়ী’, ‘প্রভেদ’, ‘নিজের ও সাধারণের’, ‘মাঝারির সতর্কতা’, ‘শত্রুতা গৌরব’, ‘উপলক্ষ’, ‘নূতন ও সনাতন’, ‘দীনের দান’, ‘কুয়াশার আক্ষেপ’, ‘গ্রহণে ও দানে’, ‘অনাবশ্যকের আবশ্যকতা’, ‘তন্নষ্ট্য যন্নদীয়তে’, ‘নতিস্বীকার’, ‘পরস্পর’, ‘বলের অপেক্ষাবলী’, ‘কর্তব্য গ্রহণ’, ‘ধবানি তস্য নশ্যন্তি’, ‘মোহ’, ‘ফুল ও ফল’, ‘অস্ফুট ও পরিস্ফুট’, ‘প্রশ্নের অতীত’, ‘স্বাধীনতা’, ‘বিফল নিন্দা’, ‘মোহের আশঙ্কা’, ‘স্তুতি নিন্দা’, ‘পর ও আত্মীয়’, ‘আদি রহস্য’, ‘অদৃশ্যকারণ’, ‘সত্যের সংযম’, ‘মহতের দুঃখ’, ‘অনুরাগ ও বৈরাগ্য’, বিরাম, ‘জীবন’, ‘অপরিবর্তনীয়’, ‘অপরিহরনীয়’, ‘সুখদুঃখ’, ‘চালক’, ‘সত্যের আবিষ্কার’, ‘সুসময়’, ‘ছলনা’, ‘সজ্ঞান’, আত্মবিসর্জন, ‘স্পষ্টসত্য’, ‘আরম্ভ ও শেষ’, ‘বস্ত্রহরণ’, ‘চিরনবীনতা’, ‘মৃত্যু’, ‘শক্তির শক্তি’, ‘ধ্রুব সত্য’ এবং ‘এক পরিণাম’।
আরও পড়ুন: ভারতীয় দর্শন ও রবীন্দ্রনাথ
ছোট ছোট স্তবকের কবিতা বা কবিতা কর্ণিকাতে প্রকাশিত হয়েছে জীবনের সারস্বত্য বাণী। এবং কবিতাগুলির মধ্য দিয়ে কবি মহত্তর ভাব প্রঞ্জলভাবে প্রকাশ করেছেন। কবি অপূর্ব ভাবের সমন্বয় সাধন করেছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির উপলব্ধ যে শাশ্বত ধারণা তা ছন্দোবদ্ধ পদের মধ্যে এনে মানবিক রসে জারিত করে ভাবের জগতে উত্তরণ ঘটিয়েছেন সুন্দরভাবে। কল্পনা এবং বাস্তবতা এখানে মিলেমিশে একাকার।
কণিকা কাব্যগ্রন্থের ‘যথার্থ আপন’ কবিতায় প্রকৃত বান্ধবকে বা আত্মজকে অস্বীকার করলে তার যে কী করুণ পরিণতি হয় সে কথা কবি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। কবিতায় কবি বলছেন—
‘কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,
বাঁশের মাচাটি তাঁর পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই।
নভশ্চর বলে তাঁর মনের বিশ্বাস,
শূন্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিঃশ্বাস।
ভাবে, শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাতে কুটুম্বিতাডোরে;
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।
বোঁটা যবে কাটা গেল বুঝিল সে খাঁটি—
সূর্য তার কেহ নয়, সবি তার মাটি।’
আপন ভিত্তিভূমিকে কখনোই অস্বীকার করতে নেই। যার উপর নির্ভর করে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি তাকে সম্মান করতে হয়, আপন করে নিতে হয়, ভালোবাসতে হয় মন প্রাণ দিয়ে। নিজের শিকড়কে যদি ভুলে যাই তাহলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়। তাই কুমড়ো গাছও শেষে বুঝতে পারে সূর্য তার কেউ নয়, মাটি তার প্রকৃত বন্ধু, আত্মীয় এবং উৎসভূমি।
‘শক্তির সীমা’ কবিতায় যে ক্ষুদ্র, সে তার ক্ষুদ্রত্বের মহত্তে যে অটল সে কথা ব্যক্ত হয়েছে। দশ চরণের কবিতায় কূপ বলে ওঠে—
‘তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।’
পাঠক যদি সংবেদনশীল হয়, সহৃদয় হৃদয় সংবাদী হয় তবে সে বুঝতে পারে যে কিনা ক্ষুদ্র তারও এই প্রকৃতির দরবারে অনেক কিছু দেবার থাকে। এটা সম্পূর্ণ উপলব্ধির ব্যাপার।
‘ভার’ কবিতায় কবি ভার গ্রহণের মধ্যে সৌন্দর্য চেতনার কথা ব্যক্ত করেছেন। এবং এই সৌন্দর্য চেতনায় বিশেষ গৌরব প্রকাশ পায়।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে অধিকার সম্পর্কে দ্বন্দ্ব প্রবহমান ভাবে চলে আসছে। এই দ্বন্দ্ব সময়ের সরণিতে কালের পরম্পরায় গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে প্রতীয়মান হয়ে চলেছে। ‘অধিকার’ কবিতায় সেই ভাব প্রকাশিত হয়েছে। ‘অধিকার’ কবিতায় অসাধারণ ব্যঞ্জনায় কবি বলেছেন—
‘গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব,
গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব।
কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে,
হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে।
মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর,
প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।’
এখানে ভূমির উপরে কার কতটা অধিকার সে বিষয় নিয়ে বিচার হচ্ছে। ফুল তার সৌরভ নিয়ে গর্বিত। ফুলেরা সৌরভে ভূমির উপরিভাগ অধিকার করে আছে। ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের অঞ্চলের অধিকার। সেখানে ভূমি অধিকার করেছে কচু। সে পৃথিবীর আবরণে মূল প্রবেশ করিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে সে ভাস্বর।
আরও পড়ুন: জন্মদিন
আবার ‘রাষ্ট্রনীতি’ এমনই একটি সাংকেতিক কবিতা যার ব্যঞ্জনার্থে ধরা পড়ে দেশীয় শাসনব্যবস্থার কথা। যে ক্ষমতা অর্জন করে প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনের কাছ থেকে সেই একদিন ওই প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনের ধ্বংসকে করে তরান্বিত। কবি তাই আক্ষেপ করে বলেছেন—
‘বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চূতলতা
নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা।’
সমাজে কেউ কেউ নিজেকে উজার করে দেয়, শেষ করে দেয়, এবং তাতেই তাদের জীবন ধন্য। আর কেউ সমাজে বেঁচে থাকে নামমাত্র অথবা অর্থবহ জীবনের সময়কে সভ্যতার, সমাজের কাজে লাগায় তারাও সফল। তাই কবির চোখে বেঁচে থেকে যেমন সফল এক শ্রেণি অপর শ্রেণিও কবির দৃষ্টিতে সমান মূল্য পেয়ে থাকে।
সমাজে নিষ্কর্মার দল সকর্ম মানুষদের চিরকাল সমালোচনা করে। ‘হাতে-কলমে’ কবিতায় সেকথা ব্যক্ত হয়েছে। সেখানে যে ক্ষুদ্র কর্মী তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যে বড় সে নির্গুন হলেও আত্মপ্রসাদে ফুলে ওঠে। তাই মধুকর বোলতাকে বলে—
‘মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রূপে দেখে যাই।’
ভাবাবেগ প্রকাশে কবি অবিসংবাদী। ভষার গভীরতায়, অলঙ্কারের প্রয়োগে, এবং ছন্দের ব্যবহারে তিনি রাজাধিরাজ ও কবি সম্রাট। তিনি কবিতায় কথার ভিতরকার ভাবাবেগকে প্রকাশ করেছেন অপূর্ব ব্যঞ্জনার প্রয়োগে। কবির ‘কুটুম্বিতাবিচার’ আর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। সেখানে কবি বলছেন—
‘কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;
কেরোসিন বলি উঠে, এস মোর দাদা।’
ছোট কিন্তু সে তার নিজস্বতায় ভাস্বর। আলো দেয় সে তার নিজের সাধ্যমতো। অন্যের উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু তার চাইতে একটু বড় কেরোসিনের আলো তার তীব্র অহংকার। ছোট মাটির প্রদীপকে সে অবজ্ঞা করে আকাশেতে চাঁদের সঙ্গে সখ্যতা পাতাতে চায়। কৃত্রিম আলো দেয় চাঁদ। তার আলো আসলে সূর্যের কাছ থেকে ধার করা। অথচ কেরোসিন আলো চাঁদের আলোকেই দাদা বলে সমাদর করতে অধিক আগ্রহী।
আরও পড়ুন: ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস ও বিশ্বকবি
সমাজে স্বার্থপর, একমুখী মানুষের ভিড় বেশি। একটু নজর দিলেই দেখা যায় দরিদ্র মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আত্মীয়তা পাতাতে বা সম্পর্ক রাখতে চায় না। ‘প্রবীন ও নবীন’ কবিতায় কেউ নিজের অবস্থানে খুশি নয়। একে অন্যকে বেশি সুখি বলে মনে করে। সমাজে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে বেশি সুখি বলে মনে করে এবং তারজন্য নিজেরা হতাশাও প্রকাশ করে। কবি তাই বলছেন—
‘পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,
কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায় হায়।
পাকাচুল বলে মান সব লও বাছা
আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।’
ঘাত-প্রতিঘাত সংঘাতময় বাস্তবজীবনে কেউই প্রকৃত অর্থে শান্তিতে, স্বস্তিতে থাকে না। তাই স্বস্থানে সকলেরই আক্ষেপ থেকে যায়। এই কবিতাটিতেও সেইভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
সমাজে একদল নীচু মানসিকতার মানুষ বসবাস করে। অধিক তাদের আত্ম অহংকারবোধ। সামান্য কোনো কাজ করে মহৎকাজের সম্মান দাবি করে। আবার একদল মানুষ আছে তারা নীরবে নিভৃতে সকলের অন্তরালে নিঃশব্দে কাজ করে যায়, এরা প্রচারের আলোকে আসতে চায় না, এরা শুধু কাজই পছন্দ করে। কর্তিকা কবিতা ‘ক্ষুদ্রের দম্ভ’-তে কবি প্রঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করছেন—
‘শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।’
দিঘির জলে জন্ম যে শৈবালের, সেই শৈবালই দিঘিকে একফোঁটা শিশির দান করে তার হিসাব রাখতে বলছে। কবি দুই চরণের কবিতায় অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ছোট কবিতাও যে কতো গভীর ভাবকে ব্যক্ত করে হৃদয়গ্রাহী হয় তা না পড়লে বোঝা যায় না। কণিকা কাব্যে ২০টি দুই পংক্তির কবিতা রয়েছে। এবং সব কবিতাগুলির ভাবার্থ যতেষ্ট গভীর।
আরও পড়ুন: আধুনিক ভারতীয় কথাসাহিত্য: প্রসঙ্গ ময়লা আঁচল
অপর একটি কবিতায় সময়ের কাজকে সময়ে করার জন্য হাহাকার করছে। সময়ের কর্ম অসময়ে হয় না। তারজন্য হাহাকার করে, ব্যর্থ আশা করে সময় অপচয় করে কোনো লাভ হয় না। তাই কবি বলছেন—
রাত্রে যদি সূর্যশেোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা।
দিনের বেলায় সূর্য তাকে, আলো দেয়। তাকে যদি রাত্রে আলো দেবার জন্য কান্নাকাটি করা হয় তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কণিকা কাব্যে রবিচেতনার এক নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটেছে। যেখানে জীবনের সারস্বত্য বাণীর সাথে সাথে কবিতার আঙ্গিক নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলেছে। এছাড়া অধিকাংস কবিতার মধ্যে নৈতিক চেতনা, আদর্শবাদের কথা প্রকাশ পেয়েছে। নিসর্গ, জীবজন্তু এবং মানবসমাজের সমস্ত স্তরই যে নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, তার ব্যত্যয় হলেই যে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে পড়ে, দেকা দেয় বিশৃঙ্খলা।
সমগ্র মানব জাতির ভাবাদর্শকে যেন কবি প্রতিভার জাদুকাঠির স্পর্শে একটি অপূর্ব সিম্ফনী সৃষ্টি করে এক মহানন্দময় ভাবজগতের রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন। সভ্যতা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে তার বিবর্তনের ধারা মেনে। কবির বিজ্ঞান মনস্কতা তাই তাঁর কবিতাতে সহজেই ধরা পড়ে। এমন মানবদরদী কবি শেষ পর্যন্ত কাব্যেও মানুষের জীবনের জয়গান করে গেছেন। তাই অবশেষে বিনম্রভাবে কবি বলেছেন—
‘আমি বিন্দুমাত্র আলো, মনে হয় তবু
আমি শুধু আছি আর কিছু নাই কভু।’