অতীত হোক বা বর্তমানে, সমগ্র পৃথিবীতেই বিবাহবহির্ভূত যৌন সংসর্গের মধ্যে গণিকাবৃত্তি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। সাধারণ অর্থে গণিকা বলতে সেই নারীকে বোঝানো হয়ে থাকে, যিনি অর্থের বিনিময়ে পুরুষ নির্বিশেষে যৌনমিলনে রত হন বা সেকাজের জন্য নিজের দেহকে সমর্পণ করে থাকেন। ইতিহাস বলে যে, পতিতাবৃত্তি হল কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন একটি ব্যবসার নাম। লোকমুখে এই পেশাটির আরও অনেক বিচিত্র নাম রয়েছে; যথা— গণিকাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, দেহব্যবসা ইত্যাদি। পৃথিবীর বিচিত্রতম ব্যবসার এই দোকানীরাই আমাদের সমাজে— পতিতা, গণিকা, বেশ্যা, রক্ষিতা —ইত্যাদি নানানামে পরিচিত। আর যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা মাপ-পরিমাপহীন এই পণ্যটি বিক্রি করে থাকেন, সেটিই হল— পতিতালয়, গণিকালয় বা বেশ্যালয়। আধুনিক সুসভ্য সভ্যতার বিবেচনায় এই ব্যবসাটিকে অন্ধকার গলিও বলা হয়ে থাকে। হয়ত অন্ধকার গলি বলেই আলোয় থাকা মানুষেরা এই গলিকে চেনেন না; এবং এই জগতের খোঁজ রাখেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাকাশের কৃষ্ণ গহ্বরের মতোই অতীত থেকেই এই অন্ধকার গলির অস্তিত্ব রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কখন, কোথায় ও কিভাবে এই বিচিত্র ব্যবসার উৎপত্তি হয়েছিল— সেকথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে, এখনও পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদের প্রদত্ত তথ্য থেকে যেটা জানা যায়, সেটা হল যে— মধ্যযুগীয় বর্বরতার গর্ভে এই অদ্ভুত বৃত্তিটির জন্ম হয়েছিল; অর্থাৎ— এই বৃত্তিটি হল সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পাপের ফসল। অতীত হোক বা বর্তমান, প্রাচীনযুগ হোক বা আধুনিকযুগ, পৃথিবীর এমন কোন দেশ বা সমাজ নেই— যেখানে এই বৃত্তিটি বিস্তারলাভ করতে পারেনি। অতীতে গবেষক জর্জ রালি স্কট (George Ryley Scott) তাঁর— ‘A history of prostitution from antiquity to the present day’ —গ্রন্থে পতিতাবৃত্তির যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটার বঙ্গানুবাদ করলে হয়—পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলেন সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যাঁরা পুরুষকে যৌনসুখ ভোগ করানোর জন্য নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে থাকেন।
তবে জর্জ রালি স্কট তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে, আরো একশ্রেণীর পতিতার কথা বলেছিলেন, যাঁরা অর্থ ছাড়াই পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে থাকেন; তাঁদেরকে তিনি— ‘Amateur Prostitutes’, অর্থাৎ— পেশাহীন পতিতা বলে অভিহিত করেছিলেন। অন্যদিকে এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটেনিকা নামক গ্রন্থে পতিতার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটার বঙ্গানুবাদ করলে হয়— পতিতারা এমন মহিলা যাঁরা অর্থ বা পণ্যের বিনিময়ে পরিচিত, অপরিচিত, দেশ, ভাষা নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের সঙ্গে যৌন মিলনে রত হয়ে থাকেন।
আগেই বলা হয়েছে যে, পতিতা, অর্থাৎ বেশ্যারা হলেন সেইসব নারী, যাঁরা পুরুষকে যৌনসুখ ভোগ করাবার জন্য নিজেদের দেহ দিয়ে এই জীবিকার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। সেকাজের জন্য বেশ্যারা প্রয়োজনমত নিজেকে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও অলঙ্কারে ভূষিতা করে রাখেন। কারণ— এই ব্যবসায় তাঁরাই হলেন পণ্যদ্রব্য। তাঁরা মনে করেন যে, সৌন্দর্য্য দিয়ে পুরুষকে জয় করতে পারলেই কাঙ্খিত অর্থলাভ করতে পারবেন। অনেকক্ষেত্রে বেশ্যাদেরও আবার ঘটক বা দূত থাকে। তাঁরা কাঙ্খিত ব্যক্তিকে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাওয়া যায় যে, মানব সভ্যতার সেই আদিকাল থেকেই পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হত; যথা— দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু, গণিকা ইত্যাদি। তবে কামসূত্র গ্রন্থের লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের যে ন’টি ভাগে ভাগ করেছিলেন, সেগুলো হল— কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রূপজীবা এবং গনিকা। (কামসূত্র, চতুর্থ ভাগ, ষষ্ঠ অধ্যায়, পৃ- ২৪) ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে পাওয়া যায়—
“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা।”
ইতিহাসবিদ মরিস ভিন্টারনিৎসের মতে— এখানে যে— বিশ্যা —শব্দটি রয়েছে, সেটার থেকেই নাকি পরবর্তীসময়ে— বেশ্যা —শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল।
ইতিহাস বলে যে, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে গণিকাবৃত্তি প্রচলিত রয়েছে। এমনকি মহাকাব্যদ্বয়েও গণিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুতঃ প্রাচীন ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান অধিকার করতেন। তখন নাচ-গান করবার জন্য বিভিন্ন উৎসবের সময়ে প্রায়ই তাঁদের ডাকা পড়ত। কিছু প্রাচীন পুরাণে একথাও বলা হয়েছে যে, গণিকা দর্শনে দিন ভালো যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বিষ্ণুস্মৃতিতে বলা হয়েছিল যে, যদি কেউ যাত্রায় শুভ চান, তাহলে তিনি যেন নিশ্চই কোন গণিকার মুখ দর্শন করে পথে বের হন। এসব ছাড়াও গণিকারা প্রাচীন ভারতের সমাজে একটা মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে ছিলেন। তখন বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে তাঁদের বসবার জন্য বিশিষ্ট আসন দেওয়া হত। মহাভারতের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সেকালে উৎসবের সময়ে তাঁরা রক্তবর্ণ বস্ত্র, মালা ও স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করতেন। তখন বিভিন্ন উৎসবে যোগদান করা ছাড়াও তাঁরা যুদ্ধের সময়েও সৈন্যবাহিনীর অনুচারিণী হতেন। সেকালের রাজা-রাজড়ারাও অনেক সময়ে তাঁদের প্রাসাদ অভ্যন্তরে স্থান দিতেন। এছাড়া ভিন্ন দেশীয় কোন নৃপতি অন্য কোন দেশে ভ্রমণের জন্য উপস্থিত হলে, বারাঙ্গনারা নগরের বাইরে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতেন। সেই আগন্তুক অতিথি রাজার সম্পূর্ণ মুক্তভাবে গণিকাদের গৃহে গমন বা প্রবেশ করবার অধিকার থাকত। এককথায়, প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে গণিকার বিশেষ গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল।
আগেই বলা হয়েছে যে, মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, বিভিন্ন প্রাচীন পুরাণ ও মহাকাব্যদ্বয়ে প্রচুর অপ্সরার উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা— ঊর্বশী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, সরলা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু প্রমুখ। এঁদেরকে স্বর্গ বেশ্যাও বলা যেতে পারে। কারণ— এঁরা দেবরাজ ইন্দ্রের সভার সাথে জড়িত ছিলেন। আবার বাংলা অভিধান মতেও অপ্সরা শব্দের অর্থ হল— স্বর্গের বারাঙ্গনা বা বেশ্যা; সুরসুন্দরী। (সংস্কৃত; অপ্ + সৃ + অস্ = অপ্সরস্ = অপ্সরা) মহাভারতে বলা হয়েছে যে, একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে তিনি নিজের উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারেন। এই জীবিকাটি সম্বন্ধে বৌদ্ধধর্মেরও একই মত দেখতে পাওয়া যায়। যাঁরা মহাভারত ও পুরাণগ্রন্থগুলি পড়েছেন, তাঁরা সকলেই অবগত রয়েছেন যে, সেগুলিতে সেকালের এমনকিছু বিখ্যাত ঋষির নামও পাওয়া যায়, যাঁরা স্বর্গবেশ্যা দেখে সবকিছু ভুলে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌনমিলনে রত হয়েছিলেন। মহাভারতের যুগের ভারতের অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তি অন্যতম ছিল। তখন রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। এই কারণেই অতীতের বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছিলেন—
“মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল।” (দেবলোকের যৌনজীবন, পৃ- ৬২)বাংলা অভিধান মতে মৈথুন শব্দটির অর্থ হল— রতিক্রিয়া, রমণ, স্ত্রী-পুরুষের যৌন সংসর্গ (সংস্কৃত, মিথুন + অ)।
প্রাচীন মহাকাব্যদ্বয়ে একদিকে যেমন বারাঙ্গনাদের গৌরবময় চিত্র অঙ্কন করা হয়েছিল, অন্যদিকে সেযুগের স্মৃতিকারেরা আবার তাঁদের নিন্দাও করে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতি তো তাঁদের প্রবঞ্চক ও জুয়ারীদের সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত করেছিলেন বলে দেখা যায়। এছাড়া সেকালের অন্যান্য স্মৃতিকারেরাও তাঁদের প্রবঞ্চক ও তস্কর বলে অভিহিত করেছিলেন। মনু বলেছিলেন যে, ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থব্যক্তির পক্ষে তাঁদের কাছ থেকে কোনধরনের দান কিংবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করাটা রীতিমত দুষণীয়। আবার কোন কোন শাস্ত্রে এমন বিধানও দেওয়া হয়েছিল যে, কোন ব্রাহ্মণ কখনও গণিকাগৃহে গমন করবে না, এবং যদি তিনি সেখানে যান, তাহলে তাঁকে কৃচ্ছসাধন করে পুত হতে হবে। পরাশর (৯|১০|১২) ও মহানির্বাণতন্ত্রে (৪।৪৩) বলা হয়েছিল যে— গণিকার সঙ্গে যৌনমিলন ও পুংমৈথুন একই শ্রেণীভুক্ত। গৌতম (২২২৩) বিধান দিয়েছিলেন যে— যদি কেউ কোন বারাঙ্গনাকে হত্যা করেন, তাহলে সেকাজের জন্য তাঁকে কোন শাস্তি পেতে হবে না।
একইসাথে সেযুগের স্মৃতিকারেরা এই নির্দেশও দিয়েছিলেন যে, গণিকারা যেন তাঁদের বৃত্তিটি সম্মানের সঙ্গে অনুসরণ করেন। যাজ্ঞবল্ক্য (২।২৯২) বলেছিলেন, যদি কোন বারাঙ্গনা কোন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেন এবং তারপরে তাঁর সঙ্গে যৌন মিলনে অনিচ্ছুক হন, তাহলে তাঁকে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ প্রত্যর্পণ করতে হবে। অগ্নিপুরাণও তাঁর বিধানেরই প্রতিধ্বনি করে অনুরূপ বিধান দিয়ে জানিয়েছিল যে, দ্বিগুণ অর্থ প্রত্যর্পণ করা ছাড়া তাঁকে রাজকোষেও কিছু অর্থদণ্ড দিতে হবে। কৌটিল্যও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে গণিকাদের অর্থ প্রত্যর্পণ করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া কৌটিল্য আরও বলেছিলেন যে, যদি কোন ব্যক্তির সঙ্গে কোন গণিকার অর্থ নিয়ে বিবাদ দেখা দেয়, তাহলে প্রধান গণিকা সেই বিবাদের মীমাংসা করে দেবেন।
প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রগুলিতে গণিকাদের একটি প্রশস্ত স্থান দেওয়া হয়েছিল বলে দেখা যায়। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে চক্রপূজায় পাঁচশ্রেণীর গণিকা শক্তি বা দেবীর স্থান অধিকার করতে পারেন; যথা— রাজবেশ্যা, নাগরী, গুপ্তবেশ্যা, দেববেশ্যা ও ব্ৰহ্মবেশ্যা বা তীর্থগ। এই নির্দেশ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, প্রাচীনকালে গণিকাদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ ছিল। তখন রাজবেশ্যা বলতে— রাজার দ্বারা অনুগৃহীত গণিকাকে; নাগরী বলতে— নগরবাসিনী গণিকাকে; গুপ্তবেশ্যা বলতে— সদ্বংশীয় নারী, কিন্তু যিনি গোপনে অভিসার করতেন তাঁকে; দেববেশ্যা বলতে— মন্দিরের দেবদাসীদের; এবং ব্রহ্মবেশ্যা বা তীর্থগ বলতে— তখন যাঁরা বিভিন্ন তীর্থস্থানে গণিকাবৃত্তি করতেন, —তাঁদের বোঝানো হয়েছিল। এই বিবরণ থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে— গণিকারা যদি সম্মান ও শ্লীলতার সঙ্গে তাঁদের বৃত্তির অনুশীলন করতে, তাহলে তৎকালীন জগতের অন্যান্য জাতির তুলনায় ভারতবাসীদের গণিকাদের প্রতি একটা অনুকূল মনোভাব ছিল। এই কারণে প্রাচীন ভারতে গণিকাদের নিয়ে অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। তখনকার সেইসব রচয়িতাদের মধ্যে— দত্তক —সবথেকে প্রসিদ্ধ ছিলেন। উক্ত দত্তক, প্রাচীন পাটলিপুত্র নগরের বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে তাঁর গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। দত্তকের রচিত সেই গ্রন্থটি বর্তমানে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র গ্রন্থে দত্তকের গ্রন্থটির সারাংশ নিবদ্ধ করেছিলেন বলে এখনও ইতিহাসে সেটির নাম পাওয়া যায়। যদিও বাৎসায়নের লিপিবদ্ধ করা সেই বিবরণটি আকারে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, তবুও প্রাচীন ভারতের গণিকাদের সম্পর্কে এত বিশদ বিবরণ অন্য কোন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না। কামসূত্র লিপিবদ্ধ সেই বিবরণের বঙ্গানুবাদের কিছু অংশ নিম্নরূপ—
‘গণিকা তাঁর বৃত্তির অনুশীলন করে শুধু যে যৌনসুখ লাভ করেন— তা নয়, তিনি এই বৃত্তির দ্বারা নিজের জীবিকাও অর্জন করেন। গণিকা সুসজ্জিত ও সালংকৃত হয়ে তাঁর গৃহদ্বারে উপবিষ্ট থাকবেন এবং নিজেকে অধিকমাত্রায় প্রকট বা প্রদর্শন না করে পথের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকবেন, যে তাঁর উপরে পথচারীদের দৃষ্টি পড়বে। … তাঁকে সুন্দরী, মিষ্টভাষিনী ও সুলক্ষণা হতে হবে। অপরের অর্থের প্রতি তাঁর যে লোভ থাকবে— তা নয়, অপরের গুণের প্রতিও তাঁর অনুরাগ থাকা চাই ও অপরের সঙ্গে প্রেম ও সঙ্গম করে তাঁর আনন্দ পাওয়া চাই। … যেসব ব্যক্তিকে তিনি মনোরঞ্জনের জন্য গ্রহণ করবেন না, তাঁরা হলেন— ক্ষয়রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, অসুস্থ ব্যক্তি, যে ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস ও মুখ থেকে পুরীষের মত দুৰ্গন্ধ নির্গত হয়, লোভী ব্যক্তি, নিষ্ঠুর ব্যক্তি, তস্কর, অধিকমাত্রায় আত্মগৰ্বী ব্যক্তি, তুকতাকে পারদর্শী ব্যক্তি, যে ব্যক্তি অপরকে সম্মান প্রদর্শন করতে জানেন না, যে ব্যক্তি নিজের শত্রু ও অর্থের দ্বারা বশীভূত হন এবং যে ব্যক্তি অত্যন্ত লজ্জাশীল। … প্রমোদকারী যখন তাঁর গৃহে আসবেন, তখন তিনি তাঁকে তাম্বুল, মাল্য ও সুগন্ধদ্রব্য দিয়ে সংবর্ধনা করবেন; তাঁকে শিল্পকলায় নিজের পারদর্শিতা দেখাবেন, তাঁর সঙ্গে আলাপনে নিযুক্ত থাকবেন, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে উপহার বিনিময় করবেন এবং যৌনকর্মে নৈপুণ্য দেখাবেন।’
অতীতের আচার্যরা বলেছিলেন যে, গণিকারা কোন পরিচিত প্রমোদকারীর পরিবর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রমোদকারীকেই আগে নির্বাচন করবেন। প্রাচীন আচার্যদের সেই উক্তিকে উদ্ধৃত করে বাৎসায়ণ জানিয়েছিলেন যে— যেহেতু পরিচিত প্রমোদকারী চেয়ে অপরিচিত প্রমোদকারীর কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু কোন অপরিচিত প্রমোদকারীকেই তাঁর পছন্দ করা উচিত।
বাৎসায়নের বাল্যকাল একটি বেশ্যালয়ে কেটেছিল; সেখানে তাঁর এক মাসি কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি গণিকাদের সম্পর্কে ও কামকলা সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেছিলেন। (Ascetic of Desire, Sudhir Kakar, Overlook Press, 2000) কামসূত্রের ০৬ নং ভার্যাধিকারিক (৩.১)–এর ৫৩ নম্বর শ্লোকে যা বলা হয়েছে, সেটার বঙ্গানুবাদ করলে হয়— ‘স্বামী যাঁহাকে প্রচ্ছন্নভাবে কামনা করেন, তাঁহার সহিত স্বামীর সঙ্গম করিয়া দিবে ও গোপন করিয়া রাখিবে।’
এই শ্লোকটি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সেকালের সমাজে অনাচার কোন পর্যায়ে ছিল। তাছাড়া বাৎস্যায়নের সময়ে বেশ্যারা তাঁদের বৃত্তিন ত্যাগ না করেই অন্য পাঁচজন সাধারণ নারীদের মতোই বিবাহ, সন্তানের জন্মদান ও ঘর-সংসার করতে পারতেন। কিন্তু তখন বিবাহের পরে প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া তাঁদের অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিবাহের একবছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা পুনরায় তাঁদের বৃত্তিতে ফিরে যেতে পারতেন।
প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে প্রাচীন ভারতের পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত যে চিত্রটি পাওয়া যায়, সেটা হল যে— সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়ে কৌটিল্যের হাত ধরে দেহব্যবসা একটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল, যে শিল্পের নাম ছিল— বৈশিক কলা। দেহব্যবসা তখন একটি সন্মানিত পেশা ছিল। তখনকার জ্ঞানী মানুষেরা সেই শিল্পের চর্চা করতেন এবং অন্যদের সেগুলি শিক্ষাও দিতেন। (কৌটিল্য: প্রেম ও নৈতিকতা, ডঃ প্রতাপ চন্দ্র) কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রের বক্তব্য অনুসারে— দেহব্যবসা তখন একটি একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা ছিল। সেটা পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় ছিল না। বরং সেযুগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই এই ব্যবসার অনুমোদন করত এবং সংগঠকের ভূমিকা নিত। কৌটিল্য প্রদত্ত তথ্য থেকে একথাও জানা যায় যে, দেহব্যবসা তখন মূলতঃ শহরকেন্দ্রীক ছিল; এবং সেটি তৎকালীন নগরজীবনের একটি অবশ্যঅঙ্গ ছিল। কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে রাজকোষের আয়ের যেসব বিভিন্ন উৎসের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেসবের মধ্যে দুর্গ নামক বিভাগটিতে তিনি— বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর গ্রন্থে— গণিকাধ্যক্ষ — নামের একটি সরকারি পদেরও উল্লেখ পাওয়া যায়; রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করাই সেই পদাধিকারীর কাজ ছিল। তবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে প্রাচীন ভারতের পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত যে চিত্র পাওয়া যায়, সেসব নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিবাদও দেখতে পাওয়া যায়।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়েই প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস ভারতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর রচিত একটি গ্রন্থে সেযুগের একধরণের পরিদর্শকের কথা বলেছিলেন, যাঁরা তখন রাজ্যের সব কার্যক্রমের ওপরে গণিকাদের সাহায্যে নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে সেসব নিয়ে গোপন রিপোর্ট জমা দিতেন। অন্যদিকে গবেষক স্টার্নবাকের মতে, সেযুগের গণিকারা সরকারি কর্মচারীও হতেন, এবং তখনকার অন্য যে কোনো সরকারি কর্মীর মত তাঁরা রাজকোষ থেকে বেতনও পেতেন। অর্থশাস্ত্রে গণিকারা ছাড়াও, তখন সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাঁরা দেহব্যবসা করতেন, তাঁদেরও একটি তালিকা পাওয়া যায়; যথা— পুংশালী, অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী; সুরাসুন্দরী, অর্থাৎ পানশালায় মদ্য পরিবেশনকারিনী; বন্ধকী, অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ; বেশ্যা, অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর; সাধ্বি-ব্যঞ্জনা, অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর; দেবদাসী, অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা; পরিব্রাজিকা, অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল। তবে এঁদের সামাজিক মর্যাদা সেযুগের রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম ছিল। অতীতে যেসব গ্রিক লেখকেরা ভারতে এসেছিলেন, তাঁরাও— যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময়ে রাজাদের সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাঁকজমকের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন— মহাভারতের উদ্যোগপর্বে কৌরবপক্ষের বেশ্যাদের কাছে যুধিষ্ঠির তাঁর শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। আবার রামায়ণে দেখা যায় যে, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে— তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কিনা। প্রাচীন জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে রাজা নন্দকে একজন গণিকার গর্ভজাত নাপিতের সন্তান বলা হয়েছিল। এছাড়া প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে সেযুগের বিখ্যাত গণিকা— আম্রপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা —প্রমুখ ছাড়াও এমন অনেকের কথাও পাওয়া যায়, যাঁরা নিজের বুদ্ধি ও শৈল্পিক দক্ষতার গুণে তৎকালীন সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ— সেযুগের গণিকা নারীরা সমাজে ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সন্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সেই সময়ে তাঁদেরকে যে কেউ যখন তখন নিজেদের ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারতেন না, কিংবা তাঁদের উদ্দেশ্য করে কোন মন্দ কথা বলতে পারতেন না। এমনকি সেযুগের গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারও ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক, অন্যান্য উপঢৌকন ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। প্রাচীন ভারতে কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা কন্যার সঙ্গে বলপূর্বক দৈহিক মিলনের চেষ্টা করলে সেকাজে অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হত।
এসব ছাড়াও প্রাচীন ভারতে আরো একধরণের পতিতাবৃত্তি চালু ছিল যেটাকে ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি বা ‘Sacred prostitution’ বলা হত। স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌনমিলন করাকে সেই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তখন যেসব নারীরা এধরণের কাজে জড়িত থাকতেন তাঁদের দেবদাসী বলা হত। এই দেবদাসীরা মূলতঃ বিভিন্ন মন্দিরের সেবিকা ছিলেন। বর্ধিত অর্থে তাঁদের— মন্দিরের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা বলা যেতে পারে। কিছুকাল আগে পর্যন্তও ভারতের বেশ কিছু মন্দিরে এই প্রথা চালু ছিল, যা পরে রীতিমত কড়া আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এছাড়া অতীতের উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শিশুকন্যাকে পতিতা বানানোর একধরণের প্রথাও চালু ছিল। তাঁরা বিহার ও উত্তরপ্রদেশে— নায়েক, পশ্চিম ভারতের গুজরাটে এবং দাক্ষিণাত্যে মোহর নামক উপজাতীয় পতিতারাও ছিলেন।
বাণভট্ট খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন। বানভট্ট তাঁর ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাতেন। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক তাঁরাই পরিয়ে দিতেন। কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি দামোদর গুপ্ত খৃষ্টীয় নবম শতকে ‘কুট্টনীমত’ নামক একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। বিকরবালা নামের একজন বৃদ্ধা বেশ্যার উপদেশনামা নিয়েই উক্ত গ্রন্থটি মূলতঃ লেখা হয়েছিল। বাৎসায়নের কামসূত্রের মতোই এই গ্রন্থটিও একটা কামশাস্ত্র গ্রন্থ। এছাড়া মহাকবি কালিদাসের লেখা কাব্যগুলিতেও প্রাচীন ভারতের গণিকাদের উল্লেখ পাওয়া যায়।#