বিবর্ণ অভিযোজন: পর্ব ৮

উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।

।। অষ্টম পর্ব ।।

সোমবারের সকাল। শুভদিনকে সঙ্গে নিয়ে সাগর বিজয় সামন্তের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। নানা পুরানো কথা মনে পড়ছে। জীবনের সমস্ত হিসেব নিকেশ মেলাতে একটু কূটকৌশলী হতেই হয়। হতে পেরেছেন বলেই তাঁর জীবন ষোলকলায় ভরে উঠেছে। একটা ভুল রিপোর্ট করে দেওয়ার বিনিময়ে লিজার মতো সুন্দরীকে লাভ করা সম্ভব হয়েছে। শুভদিনের পিতা হিসেবেও তিনি গর্ব অনুভব করতে পারেন। খুব সহজে মনে করতে পারলেন বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কেমন করে সরু ঝুরিটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলতে পেরেছিলেন। কেমন করে তানুস্যারের ব্যক্তিগত জীবনকে শূন্য করে দিতে পেরেছেন। তাও মনে করতে পারলেন। তার পিতামহের হাতে গড়া স্কুলে তানুস্যার আর নেই। এখন তিনি কাগজের ফেরিওয়ালা। তানুস্যারকে সরু ঝুরি ভেবে যে এতটুকু ভুল করেননি, তাও নতুন করে মনে করতে পারলেন। চারদিকের প্রাপ্তিতে বাস্তব অর্থে তার জীবন সোনায় সোহাগা হয়ে উঠেছে।
বিকল্প শিক্ষক বিজয় সামন্তের বাসার সামনে আসতেই সাগরের চিন্তার গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেল। স্যারকে শুনিয়ে বললেন, কোলকাতায় যেতে হবে বলেই একটু আগে শুভদিনকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হল।
বেশ তো, শুভদিন এসে ভিতরে বসুক। আপনি নিশ্চিন্তে কোলকাতায় যেতে পারেন। মিনিট পাঁচেক পরে ওদের পড়াতে শুরু করব।
সম্পাদক সাগর সামনে চলতে চলতে ভাবতে পারলেন যে গেঁয়ো তানুস্যারের তুলনায় শিক্ষক হিসেবে বিজয় সামন্ত অনেক উন্নত মানের। কোলকাতার মতো মহানগরীতে পড়াশোনা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে তাকে বড়ো হতে হয়েছে। সেভাবেই তিনি নিশ্চয় শুভদিনকে গড়ে তুলতে পারবেন। তানুস্যারের বিকল্প হিসেবে তিনি যে উপযুক্ত শিক্ষক পেয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে তার মধ্যে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।
বিজয় সামন্ত শুভদিনকে পাশে বসিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। মাননীয় সম্পাদকের ছেলে বলে কথা, বেশ যত্ন নিয়ে সব কিছু শেখানোর কথাও ভাবলেন। এও ভাবলেন, সম্পাদককে হাতে রাখতে পারলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া সম্ভব হবে। সেকথা সম্পাদকবাবু নিজের মুখেই বলেছেন।
পূবের আকাশ ভরে উঠেছে নতুন সকালের সূর্যালোকিত আভায়। বিজয় সামন্তের দু’চোখ সেই সূর্যের দিকে। জীবনে অর্থবল থাকলে খুব সহজে সূর্যের সৌন্দৰ্য্যশ্রী লাভ করা সুলভ হয়ে ওঠে। প্রাইভেট পড়ানোর শুরুতে বিজয় সামন্তের মধ্যে স্বপ্নের সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার বাসনা দ্রুত দুর্জয় হয়ে উঠছে।
সাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেরফা এসে থমকে দাঁড়ালেন বিজয় সামন্তের বাসার সামনে। দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি সাগরের বন্ধু, ওর মুখে আপনাকে নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। তাই মেয়ে সাহানিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি আপনার কোচিংএ দেবো বলে। গ্রহণ করলে ধন্য হই।
প্লিজ, এভাবে বলবেন না, সকলের মিলিত প্রয়াসে আগামি প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। কেবলমাত্র সেই পথেই আরও উন্নত জীবনযাত্রা লাভ করা সম্ভব। আপনার মেয়ে কোন ক্লাশে পড়ে?
অষ্টম শ্রেণিতে।
ও, শুভদিনের মতোই।
আপনার সঙ্গে একটা অন্য প্রসঙ্গ ছিল, যদি একটু উঠে আসতে পারেন।
বিজয় সামন্ত বললেন, সাহানি বসো, তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাই কয়েক মিনিটের জন্যে উঠে যাচ্ছি।
ঘরের বাইরে আসতেই দু’জনের ফিসফিস কথা শুরু হল। শেরফার চাপা মন্তব্য, সাগর আমি দু’জনেই চাই শুভদিন আর সাহানিকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে নতুন আত্মীয়তা গড়ে উঠুক। অবশ্য, পরমেশ্বর না চাইলে এসব সম্ভব হয় না। তাই আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ, আমার মেয়েকে শুভদিনের সমতুল্য করে গড়ে তুলুন। পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে দিয়ে বললেন, কত দিতে হবে জানি নে, প্রয়োজনে আরও বেশি দেব। যাতে আমার উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে, সেদিকে কাউন্ডলি খেয়াল রাখবেন।
আপনার প্রশংসা করার ভাষা আমার জানা নেই। এটুকু বলতে পারি, আপ্রাণ চেষ্টা করব আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে।
ধন্যবাদ স্যার।
টিউটর হিসেবে বিজয় সামন্তের জয়যাত্রা এভাবেই শুরু হল। সময় ঘন্টা দিন মাস শেষ হতে থাকল। মাসে মাসে পকেট ভারী হলেও পড়ানোর ক্ষেত্রে সেভাবে সময় দিতে পারলেন না। শহরের ছেলে হিসেবে গ্রামে এসে মনে মনে অনেকখানি রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাস্টার হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। বছর শেষে পরীক্ষার দিন যত এগিয়ে আসছে, তত বেশি করে সামন্তবাবু বুকের গভীরে ঢেঁকি পড়ার শব্দ শুনতে পেতে থাকলেন। তখনও সিলেবাসের অর্ধেক শেষ করতে পারেন নি। আসলে সপ্তাহ শেষ হলেই কোলকাতায় ফিরে যাওয়া। রবিবারের কোলকাতায় ফ্যাসানে দিন কাটে। সোমবার সকালে ফিরে এসে স্কুলে যোগ দেওয়া। হিসেব নিলে সরকারি ছুটির সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। পঁয়ষট্টিটা ছুটির সঙ্গে বারো চোদ্দটা ক্যাজুয়াল লিভ। এছাড়া রয়েছে স্পেশাল মেডিক্যাল লিভ। অন্যান্য টুকিটাকি নিয়েও অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে বিজয় সামন্তকে। একটাই সান্তনা, হয়তো শেখাতে বেশি পারেননি কিন্তু তখনও পর্যন্ত শহুরে কথায় দুই অভিভাবককে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করে রাখতে পেরেছেন, তিনিও পারেন রাজনীতিকদের মতো কথার জাল ফেলে গ্রামীণ মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে।
বার্ষিক পরীক্ষা একেবারে সামনে এসে গেল। রবিবার সন্ধেয় কোলকাতার ঘরে বসে বিজয় সামন্ত চটজলদি সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত। একটা সূত্র ডলফিন মাছের মতো হৃদয় সমুদ্রে বার বার লাফিয়ে উঠে জানিয়ে দিচ্ছিল, চেষ্টা করলেই তিনিও সফল হতে পারবেন। যে খায় চিনি তাকে যোগায় চিন্তামনি। বিজয় সামন্ত সেই চিনি খেয়ে সহজে জিতে যাওয়ার রাস্তায় ছোটার জন্যে একেবারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। সব প্রশ্নপত্র ছাপা হয় কোলকাতায় তাঁর মাধ্যমে। প্রধান শিক্ষকের ভাবনা, বিজয়বাবুর মাধ্যমে এসব হলে ফাঁস হওয়া নিয়ে কোনো কানাকানি থাকবে না, তাতেও সম্পাদক সাগরের পূর্ণ সম্মতি ছিল, বিজয়বাবু মনে করলেন, সেই সুযোগটুকু কাজে লাগাতেই হবে।
পরের দিন সোমবার। বিজয় সামন্ত যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হলেন। অফ পিরিয়ডে প্রধান শিক্ষকের ঘরে একবার ঢু মারতে ভুল করলেন না। জীবনের স্তরে স্তরে রয়েছে সৌজন্যবোধের খেলা। বিজয়বাবু তা ভালোই জানতেন। সাড়ে চারটেয় ছুটির ঘন্টা পড়তেই বিজয় সামন্ত বসে বসে টিফিন করছিলেন। বিদ্যালয়ের সঙ্গে ক্যানটিন যুক্ত। প্রধান শিক্ষক এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সৌজন্য দেখাতে বিজয়বাবু বললেন, স্যার আসুন।
ফাইনাল পরীক্ষা তো এসে গেল। আর মাত্র কুড়ি দিন বাকি। প্রশ্নপত্র সব এসে গিয়েছে। এবারও তোমার মাধ্যমে কোলকাতা থেকে ছাপা হবে। গোপনে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে এনে অফিসের আলমারিতে জমা করার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। আজ কী প্রশ্নগুলো নিয়ে যাবে?
রেডি হয়ে থাকলে দিতে পারেন।
গত শনিবারে সব প্রশ্ন জমা পড়ে গেছে।
তাহলে দিয়ে দিন। পরীক্ষার পোগ্রাম সেট হয়ে গেলে আমাকে একটা দেবেন। কোলকাতার বাড়িতে বসে যেদিন যে যে ক্লাসের পরীক্ষা, সেই প্রশ্নগুলো পর পর সাজিয়ে গার্ডার লাগিয়ে আলমারিতে রেখে দেব। ফলে পরীক্ষার দিনে এ নিয়ে আর আপনার ব্যস্ত হতে হবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ বিজয়, এডুকেশন নিয়ে তোমার ভাবনাচিন্তাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। খুব এট্রাকটিভ। কোলকাতায় থেকে উন্নত শিক্ষা প্রণালী গ্রহণ করতে পেরেছ বলেই এসব ভাবনা-চিন্তা তোমার মাথায় আসে। এ তো জীবনের বিশেষ ঘরানা।
প্রধান শিক্ষক সর্বেশ্বর ব্যানার্জী আর দেরি করলেন না। সোনারপুরে থাকেন। ট্রেনের সময় মেনে আসা যাওয়া করতে হয় তাঁকে।
বাসায় ফিরে বিজয় সামন্ত বিহ্বল চিত্তে এটা ওটা ভাবতে লাগলেন। সন্ধে গড়িয়ে রাত বাড়ছে। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দের পরে বুঝলেন, দশটা বেজে গেছে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে শুভদিন এবং সাহানির জন্যে অষ্টম শ্রেণির প্রশ্নপত্র বের করে একমনে ভাবতে শুরু করলেন। পরীক্ষার ফলাফলে দু’জনের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পারলে পরের বছর টিউশানির বহর অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে। এও ভাবলেন যে ছাপানো প্রশ্নপত্র কিছুতেই ওদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে কোনো সমস্যা থাকবে না। পরীক্ষার হলে কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী গোপনে যেভাবে নকল করে পাশ করার চেষ্টা করে, বিজয় সামন্ত সেই আদলে খাতা কলম নিয়ে নিজের বাড়িতে বসে প্রশ্নের নকল করতে শুরু করলেন। ইনিই সম্পাদক সাগরের চোখে তানুস্যারের চেয়ে সত্যি সত্যি সেরা শিক্ষক।
পরের দিন সকালে শুভদিন আর সাহানি পড়তে এলে বিজয়বাবু খুব ঘটা করে বললেন, পরীক্ষা এসে গেছে রে। এখন আর সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া ঠিক হবে না, তাতে অহেতুক সময় নষ্ট হবে। এখন পড়াশোনার ব্যাপারটা অনেকখানি আধুনিক হয়ে উঠেছে। যেটুকু প্রয়োজন, তার বেশি হজম করার প্রয়োজন নেই। থালাভর্তি ভাত দিলুম অথচ খাবার ক্ষমতা নেই, এতে পেটের ট্রাবল দেখা দিতে বাধ্য। পড়াশোনার ব্যাপারে তেমনি পরিমিতিবোধ খুব প্রয়োজন। তোদের দু’জনকে আজ ফাইনাল সাজেশন দিয়ে দিচ্ছি, পরীক্ষার জন্যে শুধু ওইগুলোই করলে চলবে। এগুলোর বাইরে অন্য কিছু করার দরকার নেই। মানে অল্প পড়াশোনা করে ভালো ফল করার পথ বাতলে দিলুম।
শুভদিন উৎসাহ নিয়ে বলল, এ ধরনের কথা তানুস্যার কোনো দিন শোনাতে পারেন নি, কোলকাতায় নিয়মে নতুন ধরনের পড়াশোনা, ভালো ফল হবে তো?
অবশ্যই, নাহলে যে আমার দাম থাকবে না। বিশ্বাস করে তোর বাবা তোকে গড়ে তুলতে আমার উপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
সাহানিও সমানভাবে কৌতুহলী, বলল, স্যার, আমি কী প্রথম হতে পারব?
বিজয় সামন্ত মনে মনে একটু হাসলেন। ভাবলেন, সাজেশন কম বেশি করে দেওয়া হয়েছে, তাতেই ঠিক হয়ে আছে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় হবে।
পরীক্ষার আগে ফলাফল নিশ্চিত হয়ে যাবার মতো ভালো খবর ছাত্রছাত্রীদের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। বিজয় সামন্তও ভিতরের অলিক ভাবনার স্রোতে ভেসে চললেন। দুই অভিভাবককে খুশি করতে পারলে টিউশানিতে প্রসার প্রতিপত্তি নিয়ে তাকে আর এতটুকু ভাবতে হবে না।

ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে কিন্তু তা নিয়ে লিজা এবং সাগরের বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলের প্রথম হওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম মানসিক উষ্ণতা উপভোগ করতে পারলেও লিজার মধ্যে অনেকগুলো সাধারণ প্রশ্ন মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। শুভদিনের অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ভিন্নতর হল কেন, তা নিয়ে লিজার মন থেকে একটা গভীর সন্দেহ কিছুতেই সরতে চাইছে না। এমন হতে পারে না কিছুতেই। ক্লাসে প্রথম হওয়ার জন্যে যে অনুশীলন, একনিষ্টতা থাকা প্রয়োজন, লিজা তা শুভদিনের মধ্যে দেখতে পায় নি। তাছাড়া সারা বছর পিছনে থেকে কোনো ছাত্রের পক্ষে কী বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সম্ভব? একেবারে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ নিয়ে লিজার শেষ ভাবনা, ছেলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সাগরের সঙ্গে কথা বলা খুব প্রয়োজন। কিন্তু গত তিনদিনে ছেলের অস্বাভাবিক ফলাফল নিয়ে সাগর এত মেতে ছিল যে লিজার পক্ষে তা নিয়ে তাকে কিছু বলা সম্ভব হয়নি।
সম্পাদক সাগর তখন আত্মপ্রচারে খাঁটি সাগর হয়ে উঠেছেন। পরিচিত মানুষজন দেখলে ডেকে ডেকে বলছেন, দ্যাখো, কেমন উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে পেরেছি তানুস্যারের পরিবর্তে। তানুস্যার ওর পায়ের কাছে মাথা রাখারও উপযুক্ত নন। কথাবার্তায় ভীষণ স্মার্ট, বুদ্ধি ধরেনও তেমনি। পঠন-পাঠনের ভিতরে ঢোকার জন্যে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, তারপর বিষয়টাকে এমনি টুপ করে মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে দেন যে ঠিক ম্যাজিসিয়ান বলে মনে হয়। এতেই প্রমাণ হয় যে তানুস্যারের তুলনায় বিজয়বাবু অনেক বড়ো কৃতি শিক্ষক। অন্য অর্থে দু’জনের মানদন্ড কখনও এক হতে পারে না। দু’জনের বেড়ে ওঠার পরিবেশও আলাদা। তানুস্যার পাড়া-গাঁ থেকে বেড়ে উঠেছেন। তার পক্ষে শিক্ষার শহুরে পদ্ধতি জানা একেবারেই অসম্ভব, সে ক্ষেত্রে বিজয়বাবু শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন দক্ষ, সামাজিক ক্ষেত্রে তেমনি খাঁটি শিল্পী মানুষ।
এত প্রশংসার পিছনে বাস্তব প্রেক্ষাপটও ছিল। সম্পাদক সাগর যে কোনো উপায়ে প্রমাণ করতে চান যে তানুস্যারকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে বিজয় সামন্তকে নিয়োগ করে এতটুকু ভুল করেন নি। বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্যে এমনি পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যা নিয়ে সাগরের এত বেশি উচ্ছ্বাস, তা নিয়ে লিজার মধ্যে চাপে পড়ে থাকার মনোভাব ক্রমে ঊর্ধ্বমুখি হয়ে উঠতে লাগল। সাগর নাকি গতকাল শুভদিনের অনন্য ফলাফলের জন্যে তানুস্যারকে মিষ্টি খাইয়েও এসেছে। এসব করার কোনো দরকার ছিল কী? লিজা ভালো করেই জানে, তানুস্যারকে সম্মান জানাতে সাগর এ কাজ করেনি বরং ছলাকলা করে তাকে ছোটো করতে চেয়েছে। সাগর যে এমনি একগুঁয়ে স্বভাবের, তা লিজার জানা হয়ে গিয়েছিল।
সারা সপ্তাহের মধ্যে কেবলমাত্র রবিবার সন্ধেয় মিষ্টার সাগর সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ হয়ে ওঠেন। রাজনীতি বা ব্যবসা নিয়ে তাঁর মুখে কোনো কথা থাকে না। বরং বাড়িতে বসে তারিয়ে তারিয়ে চা খাওয়া, লিজার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানো, শুভদিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা, এমনি নানা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। সাগর নিজেই সপ্তাহের এই বিশেষ সময়কে বরাদ্দ করে রেখেছেন। মিষ্টার সম্পাদকের একটাই যুক্তি, জালে বল ঠেলতে গেলে ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে বল প্লেস করতে হয়। সেভাবেই নিজের ভিতরের স্বপ্নগুলোকে আকাশমুখি করে তুলতে একটা ভালো সময় খুব প্রয়োজন। রবিবারের সন্ধে সাগরের জীবনে সেই অপূর্ব সন্ধিক্ষণ।
চা খাওয়া শেষ। সাগর বললেন, শোনো লিজা, শুভদিনকে নিয়ে তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। ছেলেকে বড়ো করে তোলার জন্যে ক’দিন ধরে একটা প্লান মাথার ভিতরে ঘুরছে। তোমাকে বলি বলি করে বলতে পারিনি। শুভদিনের ফলাফল নিয়ে ক’দিন হুল্লোড়ে কাটানোর সময়ও ভেবেছি, রবিবারের সন্ধেটা কিছুতেই মিস করব না। আজ তো সেই দিন।
লিজা এমনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বলল, ছেলের ফলাফল নিয়ে শুধু শুধু কল্পনায় ভেসে যেও না। বিশ্লেষণ করলে অন্য কিছু জানতে পারবে।
কল্পনা শব্দটা জুড়ে দিয়ে আমাকে তাচ্ছিল্য করছ লিজা? প্রতিটি বিষয়ে আশির উপরে নম্বর পেয়েছে। তাই ছেলেকে নিয়ে একটু বাড়তি কল্পনা করা কী খুব অন্যায়? তুমি ওর মা, তোমার মধ্যে সেই কল্পনা থাকলে আমি খুব খুশি হতাম। আরেকটা কথা তোমাকে মনে করিয়ে দিই, বিজয় সামন্ত যে তানুস্যারের তুলনায় অনেক দক্ষ শিক্ষক, তা শুভদিনের ফলাফলের মধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে।
এটাও নিছক কল্পনা। খোঁটা দিল লিজা।
কী বলতে চাচ্ছ তুমি? জীবনে বড়ো হওয়ার জন্যে কল্পনাই তো একমাত্র সম্বল।
ছেলের কাছ থেকে প্রথম হওয়ার কারণগুলো জেনে নিতে পারোনি বলেই এখনও কল্পনায় ভাসছ।
একথা সত্যি, এসব নিয়ে ব্যবসার কারণে শুভদিনের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। কিন্তু এসব জেনে নেওয়ার খুব প্রয়োজন আছে কী?
তোমার বিজয়বাবু সিলেবাস শেষ না করে ছেলেকে পরীক্ষায় বসিয়েছেন।
এসব কী বলছ লিজা ? সিলেবাস শেষ না হলে একটা ছেলে পরীক্ষায় প্রথম হতে পারে?
সেটাই আমার প্রশ্ন। উত্তরটা তোমার কাছ থেকে খুঁজে পেতে চাচ্ছি।
তাহলে কী হয়েছে খুলে বলো।
বিজয়বাবু পরীক্ষার আগে প্রথম হওয়ার জন্যে একটা ছোটো সাজেশন করে দিয়েছিলেন, তাতেই শুভদিন এমনি ফলাফল করতে পেরেছে।
তুমি কী ভাবছ, এসব শুনিয়ে শুভদিনকে আবার তানুস্যারের কাছে পাঠাতে আমি বাধ্য হব? ওই ইচ্ছেটুকু ভুলে যাও লিজা। এখন তো তানুস্যার খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা ছাড়া কিছুই নয়। ছেলের জন্যে গৃহশিক্ষক হিসেবে ওকে নিযুক্ত করতে যাব কেন? তুমি হয়তো অতীতের কথা ভেবে নিজের মনকে সম্পূর্ণ বদলে নিতে পারোনি। আমি কিন্তু ছেলেকে গড়ে তোলার জন্যে লৌহমানুষ হয়ে উঠেছি।
চলতে নারি তো উঠোন বাঁকা, তোমার হিসেবগুলো এমনিই। ব্যবসা করো বলেই কী ছেলের প্রকৃত ভবিষ্যৎ নিয়ে কঠোর বাস্তবতা বুঝতে চাচ্ছ না? আমাকে এভাবে খোঁটা দিয়ে কী সুখ পাও তুমি? এও জানি, ছিনিয়ে নেওয়ার পরে কোনো অপরাধী নিজেকে কখনো নির্দোষ হিসেবে ভাবতে পারে না। তবে নিজেকে ঢেকে রাখার জন্যে ছলাকলার শেষ রাখে না।
আজ তুমি আমাকে সবচেয়ে বড়ো আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারলে লিজা। আনাড়ি তর্ক করে পারিবারিক সন্ধের আড্ডাটা একেবারে মাটি করে দিলে। নিজের ভিতরটা গোপনে তানুস্যারের আস্তাকুড়ে ফেলে রেখে দিলে কিছুতেই মস্তিষ্কে ভালো চিন্তা আনতে পারবে না লিজা।
দারুণ পুরুষ তুমি। নিজেকে অন্যায়ভাবে রক্ষা করার জন্যে স্ত্রীকে দ্বিচারী ভাবতে এতটুকু কুণ্ঠা নেই তোমার মধ্যে। তানুস্যারকে ঠকিয়ে আমাকে যে ভাবে লাভ করেছ, সেটাকেই আজও ন্যায় বলে ভাবো নাকি? এখন আবার ছেলেকে নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে। বিজয়বাবুর মাধ্যমে ছেলেকে ঠকিয়ে তার জীবনটা নষ্ট করতে চাচ্ছ।
মৌচাকে ঢিল পড়লে মৌমাছিদের যে অবস্থা হয়, লিজার কথায় সেই অবস্থান লক্ষ্য করে সাগর চমকে না উঠে পারলেন না। আর প্রসঙ্গ বাড়িয়ে নিজেকে অপরাধের মুখোমুখি করে তুলতেও চাইলেন না। বরং লিজার উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে এমনি করে রাগ করে কোনো কোনো মানুষ নিজস্ব আত্মরক্ষায় ব্রতী হয়। সাগরের মতো ঘোড়েল মানুষ সেই শিল্প অনেক আগেই শিখে ফেলেছিলেন।
লিজা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল এই অর্থে যে সে কিছুতেই ছেলের জীবনকে আর ছোটো হতে দেবে না। তার জন্যে যা করলে হয় তাই করবে। প্রয়োজন হলে কঠোর হয়ে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খাদানের গভীরে ডিনামাইট ফাটিয়ে চাঁই পাথরকে খন্ড খন্ড করে দেওয়া হয়। ছেলেকে বড়ো করে তোলার জন্যে লিজা এমনি একটা ডিনামাইট হতে চায়।
নতুন সপ্তাহ এল, লিজার সেই প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভর করে সোম মঙ্গল বুধ টানা তিন দিন লিজা নিজের ভিতরের কম্পনে নিজেই বিহ্বল হয়ে থাকল। বৃহস্পতিবার দিনের আলো নিভে গেলেই সন্ধের অন্ধকারে সাগরকে না জানিয়ে তানুস্যারের বাড়িতে চলে গেল।
হতচকিত তানুর প্রশ্ন, তুমি এখানে?
তোমার কাছে এসেছি।
সাগরকে জানিয়ে এসেছ কী?
না।
তাহলে এভাবে এসে ঠিক করোনি।
আমি কীভাবে কেন এসেছি, তা তোমাকে জানাতে হবে কেন?
তাহলে বলো কেন এসেছ?
আমার ছেলে শুভদিনকে পড়াতে হবে।
তা কী সম্ভব?
অসম্ভব ভাবছ কেন?
সম্পাদক জানতে পারলে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
যাতে জানতে না পারে, সেই ব্যবস্থা যদি করতে পারি।
তাও কী সম্ভব?
শুভদিন তোমার কাছে পড়বে, তা কেবল আমিই জানব। ওর হাতে খামে পোড়া মাসিক পাওনা তোমার হাতে পৌঁছে যাবে।
বড়োলোক বলেই আমাকে টাকা দিয়ে কিনতে চাচ্ছ?
আজ তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়েছি।
এতটা শান্ত হয়ে গেছ?
সেদিন তোমাকে যা বলেছি, তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি। বড়ো বিপদে পড়ে তোমার কাছে আসতে হয়েছে। তুমি ছাড়া যে আমার শুভদিন বড়ো হয়ে উঠতে পারবে না।
এভাবে বলতে নেই লিজা।
মা হয়ে আমি তো ছেলেকে পথে বসাতে পারি না।
ও তো বিজয় সামন্তের কাছে পড়ে, আমার পরিবর্তে যাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
সব জানি। শুভদিন যেমন বিজয়বাবুর কাছে পড়তে যায়, যাবে। বাকি দিনগুলো তোমার কাছে আসবে। আমাকে কথা দাও, আগের স্মৃতি মনে না রেখে শুভদিনকে নিজের ছেলে ভেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেবে।
তানুস্যার আবেগে মাথা দোলাতে লাগলেন। লিজার গলা বুজে এল। আরও কী সব বলতে চাইলেও তা প্রকাশ করতে পারল না। দু’জনেই মানসিক মাদকতার মোড়কে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে থাকল। স্বপ্নের দোলাচল দুজনের মধ্যে সমান তালে বাজছে। লিজা ছেলের জন্যে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠেছে। তানুস্যার শিক্ষকজীবনের সার্থকতা নতুন করে প্রমাণ করার জন্যেই যেন বড়ো বেশি উদ্বেলিত। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন লিজার দিকে। মেয়েটি যে চরম দুঃখে পড়ে সন্ধের অন্ধকারে লুকিয়ে বিশেষ প্রয়োজনে তার কাছে আশ্রয় নিতে এসেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকল না তানুর মধ্যে। জীবনের পর্বগুলো কীভাবে যে পাল্টে যায়। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে, তা ভেবে তানু আরও বেশি বিহ্বল হয়ে পড়লেন। মাথা নেড়ে বললেন, বাড়িতে ফিরে যাও লিজা। শুভদিনকে পাঠাবে সামনের সপ্তাহে, তবে একটাই শর্তে। ওকে আসতে হবে সন্ধের পরে। সকালে সময় পাব না আমি।
একটা স্বচ্ছন্দ উতরোল লিজাকে ভীষণভাবে নাড়া দিতে থাকল। তবুও নিজেকে সামলে নিল। যেমন এসেছিল গোপনে, তেমনি গোপনে নিজের বাড়িতে ফিরে গেল। মিষ্টার সাগর ভাবতেই পারলেন না, তার ছেলেকে বড়ো করে তোলার জন্যে লিজা কত বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে। জোয়ারের উদ্দাম স্রোত সমুদ্রের গভীরে কত জোরে বয়ে যায়, বাহির থেকে বোঝা যায় না। এমন কী সেই উদ্দামতা রোধ করার ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই। চরম বিজ্ঞান চেতনার যুগে প্রকৃতির কাছে মানুষ এভাবেই পরাভব মেনে নেয় সামনাসামনি। মিষ্টার সাগর তো একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাত্র। লিজার ভিতরকার সামুদ্রিক উদ্দামতা রুখে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!