আমি আসাম রোড ধরে সাইকেল চালিয়ে ফুলপুকুর যাচ্ছি। শীতের বিকাল। রোদ মরে এসেছে। রাস্তার পাশে কুন্তিঘাট বাসস্ট্যান্ডে নারকেল গাছের সারি। রাস্তার পশ্চিম পাড়ে। লম্বা ছায়া পড়েছে। দীর্ঘ ছায়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা গেলে ব্রিজ। নিচে কুন্তিনদী বয়ে গেছে। আমি প্যাডেলে জোরে চাপ দিই। অনেকদিন ফুলপুকুর যাইনি। আজ যেতে ইচ্ছে হল। নদীর উপর ব্রিজের কাছে যেতেই একটা বাস বেড়িয়ে গেল হুস্ করে। জিরাট যাবার মিনিবাস। চুঁচুড়া জিরাট বাস রুট। ব্রিজ থেকে নদীতে দেখা যাচ্ছে গাছের ডাল দিয়ে কুমোর বানিয়েছে। এই কুমোরে অনেক মাছ জড়ো হয়। শেরপুরের মালোরা কুমোর বায়। এতে কমবেশি সারাবছরই মাছ পাওয়া যায়। শেরপুরের মালোরা মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে। সারা বছরই তারা কুন্তি নদী ও ভাগীরথীতে মাছ ধরে।
বেলা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। গায়ের হাফ সোয়েটারে রোদ এসে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আমার আরাম লাগছে। আমি মাঝে মাঝেই ফুলপুকুর সাঁওতাল পাড়াতে যাই। মহুয়ার নেশা আমাকে আকৃষ্ট করে। মহুয়ার মাদকতা মনকে অজানা পুলকে ভরিয়ে দেয়। আমি তাতে বিভোর হয়ে থাকি।
প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে মাঝে মধ্যেই ফুলপুকুরের ফুলমণিদের বাড়িতে যাই। ফুলমণির বয়স আঠারো। কালো সুঠাম চেহারা। যেন কষ্টিপাথরে কুঁদ করে গড়া তার দেহ। দেহের অবয়ব মায়াবী। মহুয়ার মতো সেও আমাকে নেশা ধরায়। তার কারণেই ফি বছর ফুলপুকুরে বাহা পরবে যাই। সন্ধ্যায় একসাথে নাচি কোমরে হাত রেখে। ফুলমণিই আমাকে নাচের স্টেপ শিখিয়ে দিয়েছে।
আজ রবিবার। বিকেলে অদ্ভুত এক আকর্ষণে চলেছি। মনে এক অজানা রহস্য উন্মোচনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হতে চলেছে; একথা ভেবেই মনে মনে উত্তেজিত হয়ে পড়ি, সাইকেলের প্যাডেলে জোরে জোরে চাপ দিয়ে এগিয়ে যাই। পড়ে থাকে রাস্তা পিছনে; গ্রাম, মালোপাড়ার বাচ্চাদের বিকেলের খেলার আনন্দ আমাকে স্পর্শ করে। গোল্লাছুট, কানামাছি, লুকোচুরি আমারও খেলতে ইচ্ছে করে; তবু সেইসব বিনোদনকে উপেক্ষা করে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতির টানে, ফুলমণির আকর্ষণে সাঁওতালপল্লির দিকে এগিয়ে চলি। শেরপুর মালোপাড়াতে থাকে দেবু মালো। তার ছেলে আমার কাছে টিউশনি পড়ে। আমাকে দাদা বলে ডাকে। দেবুমালোর ছেলে কমল মালো রাস্তায় আমাকে আটকায়। টালিভাটার কাছাকাছি ওর সাথে দেখা। ও আমার সঙ্গে যেতে চায়। আমি বলি—
—চল। সাঁওতাল পাড়া তোর যদি ভালো লাগে চল আমার সাথে।
কমল আমার সঙ্গ নেয়। ও একটা লেডিবার্ড সাইকেল চালাতে চালাতে আমার সঙ্গে চলল। উত্তর দক্ষিণ বরাবর আসাম রোড। যানবাহনের ভিড় বেশ। রাস্তায় বর্ষাতে খানাখন্দ হয়েছিল। সেই খানাখন্দ এখনো সারেনি। রাস্তার বামপাশে বিজয় সংঘ। ক্লাবের উঠানে একটি বাঁশে বিবর্ণ জাতীয় পতাকা ফত ফত করে উত্তুরে বাতাসে উড়ছে। ওদিকে চোখ যেতেই নিজে লজ্জিত হলাম। খানিকটা এগোনোর পর কমল বলল—
— দাদা, সর্ষেফুলের পোকা; কী উড়ছে। চোখে মুখে পড়ছে।
– হুম, বললাম।
তারপর দুজনে চুপচাপ সাইকেল চালিয়ে এগোতে লাগলাম। রাস্তার দুপাশ দিয়ে হলুদ সর্ষে ক্ষেত। অপূর্ব লাগছে। মনোরম দৃশ্য। চোখ আরামবোধ করছে এতক্ষণ পড়ে। কালো পিচের রাস্তার দু’পাড়ে হলুদ সবুজ ক্ষেত কোনো দক্ষ শিল্পীর আঁকা ছবির মতো লাগছে। মনটা ভরে গেল। এইসব দৃশ্য কেমন মাদকতা সৃষ্টি করে, নেশা ধরায়। মন ভরে ওঠে এক অজানা আনন্দে। কমলের গায়ে লাল ফুল সোয়েটার, পুরোনো রঙ বিবর্ণ হয়ে এসেছে। মালোপাড়ার ছেলেমেয়েরা পুরোনো জামাকাপড়ই বেশি পড়ে। প্রকৃতিতে রঙ বদলায়। বদলায় মালোদের মনের রঙ। তারাও আজকাল সাঁওতালদের মকরপরবে যায়। সাঁওতাল পল্লিতে আমার সঙ্গে আমার বয়সী মালো ছেলেরাও ভিড় করে। অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে। আমি যাই ফুলমণির আকর্ষণে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ— যা উপেক্ষা করতে পারি না। কালো পিচের রাস্তা শেষ হলে আসে লালমাটির রাস্তা— সেই রাস্তার পাশেই ফুলমণিদের বাড়ি।
কমল আর আমি সাইকেল থেকে নামি। কচা গাছের বেড়া দেয়া ফুলমণিদের বাড়ির চারপাশে। ফুলমণিরা তিনবোন। ও বড়ো। ছোটো দুই বোন পড়াশোনা করে। ফুলমণির বাবা নেই। মা মাঠে কাজ করে। সঙ্গে ফুলমণিও যায়। ফুলমণি মুর্মু। এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। তাঁর উত্তাপ নিতে যাই আমি। কমল ছোটো। সে জানে না। কচা গাছের বেড়ার ভিতরে সাইকেল রেখে কাশি দিই। কাশির শব্দে ফুলমণি মাটির ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। মুখে হাসি ভর্তি। বলে—
— ভাত খেয়েছ তুমি।
— হ্যাঁ খেয়েছি। তুই খেয়েছিস!
— আমি খাইনি। এই কাজ থেকে এলাম মা আর আমি।
— রান্না করবি কখন?
— এখনই করব। মা স্নান থেকে ফিরুক।
কমল আর আমি বারান্দার খাটে বসে পড়ি। কমলকে মুড়ি চানাচুর খেতে দেয় ফুলমণি। আকাশ জুড়ে লালচে পশ্চিমি আভা লম্বয়িত হয়ে ঘরের ছায়া সামনের উঠানে পড়ছে। আমার মনে অজানা আশঙ্কা দেখা দেবার আগের মুহূর্তের টেনশন কাজ করছে। একটু বসার পর ফুলমণি আমাকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল সাথে করে। আমি যেতেই বলল—
— সঞ্জয়দা আস না কেন এখন?
— আমি বললাম, সময় হয় না রে।
— আমার ভীষণ কষ্ট হয়।
বলেই শিয়ালে মুরগি ধরার মতো আচমকা আমার গলা মাথা টেনে ধরে চুম্বন করতে লাগল। মনে হল হাজার বছরের শুকনো বালি জল শুষে নিচ্ছে। আমিও সাড়া দিতে লাগলাম। এভাবে ক্ষাণিকক্ষণ যাবার পর বললাম—
— দাঁড়া ফুলমণি, দরজা বন্ধ করি।
আমি উঠে ওর হাত ছাড়িয়ে দরজার শিকল তুলে দিলাম।#