(শেষ পর্ব)
বহুরূপী (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ): বিহারের একটি গ্রামাঞ্চলের পটভূমিতে লেখা বহুরূপীতে প্রেত সম্পর্কে একটি অভিনব তথ্যকে কেন্দ্র করে কাহিনীবৃত্ত গড়ে উঠেছে। শরদিন্দুর অধিকাংশ গল্পেই প্রেতাত্মারা বিদেহী বলে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে যে, একটি অশরীরী আত্মা শুধু যে দেহধারণ করতে পারে তাই নয়, সে ইচ্ছারূপধারীও বটে! আবার কি কৌশলে প্রেতাত্মা দেহধারণ করতে পারে, সেই থিওরিও এই গল্পে বরদার রূপধারী প্রেতাত্মার মুখ থেকেই শুনতে পাওয়া যায় — “অশরীরী আত্মাকে স্থূল দেহ ধারণ করতে হলে কিছু জান্তব মাল-মশলার দরকার হয়, তার নাম বিজ্ঞানের ভাষায় একটোপ্লাজম। এই একটোপ্লাজম প্রয়োজন মত না পেলে চেহারা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। … প্রেতযোনি ইচ্ছা করলেই চেহারা বদল করতে পারে; কারণ তাদের দেহের উপাদান মানুষের দেহের উপাদানের মত কঠিন বস্তু নয়।” গল্পে বরদার গ্রামের বাড়ীতে আমন্ত্রিত বন্ধুরা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেননি যে , বরদার অনুপস্থিতিতে যিনি তাঁদের আপ্যায়ন করেছিলেন, এমনকি প্রেত জীবন সম্পর্কে তাঁদের বহুবিধ তথ্য জানিয়েছিলেন — তিনি আসলে বরদার রূপধারী একটি প্রেতাত্মা ছিলেন! বরদার কুকুর খোক্কসের দেহ থেকে প্রয়োজনীয় একটোপ্লাজম নিয়ে তিনি সেই রূপধারণ করেছিলেন। এই গল্পের শেষে প্রকৃত বরদার আগমনে বরদা রূপধারী প্রেতের অন্তর্ধান এবং খোক্কসের কান্নার মত একটানা দীর্ঘ সুরে ডেকে ওঠা প্রভৃতি ঘটনা বরদার প্রেত-অবিশ্বাসী বন্ধুদের মনেও যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ের সঞ্চার করেছিল। গল্পের শেষ চমকটুকু নিঃসন্দেহে উপভোগ্য। বহুরূপী গল্পটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে ‘কল্পকুহেলী’ নামক গল্প সংকলনের ভূমিকায় সুভদ্রকুমার সেনের মন্তব্যটিও এই প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ্য — “এই গল্পের প্রকাশনা doppelgaenger কল্পনাকে আশ্রয় করেনি। পক্ষান্তরে জীবিত ও অজীবিতের এই লুকোচুরির কল্পনাটি খুব চমৎকার। এবং বরদাকে impersonate করার কল্পনাটি তুলনাহীন।”
আকাশবাণী (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ): বরদা আকাশবাণীর বক্তা নন, শ্রোতা ছিলেন। ক্লাবের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তিনি একযোগে নতুন সদস্য সুধাংশুর জীবনের একটি আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন। শোনা যায় যে, সেই অভিজ্ঞতার প্রভাবেই নাকি একদা নাস্তিক সুধাংশু ভূত-বিজ্ঞানী বরদার পরম ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন। এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রিয়তোষবাবু নামের একজন বাঙালী ভদ্রলোক রয়েছেন। সুধাংশুর পল্লীতে নবাগত সেই ব্যক্তিটি বিপত্নীক ছিলেন, এবং তাঁর গৃহ নারীবিহীন ছিল। অথচ প্রতি রাত্রেই তাঁর বাড়ী থেকে রমণীকন্ঠের বাক্যালাপ শুনতে পাওয়া যেত। ফলে প্রতিবেশীরা অল্পকালের মধ্যেই তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। প্রিয়তোষবাবুর সম্পর্কে সেই জনরবের যাথার্থ্যতা বিচার করবার জন্য কৌতূহলী সুধাংশু একরাত্রে গোপনে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং প্রথমে অনুভব করেছিলেন যে, সেই ভদ্রলোকটির সম্বন্ধে প্রচলিত জনশ্রুতি আদৌ মিথ্যা নয়; কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁর কাছে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছিল। প্রিয়তোষবাবুর কাছ থেকেই তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর ঘর থেকে ভেসে আসা ঐ কণ্ঠস্বর কোনও জীবিতা রমণীর নয়, সেটা তাঁর মৃতা স্ত্রীর কণ্ঠস্বর! প্রতি রাত্রে তিনিই তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তবে উপায়টি অভিনব — আকাশবাণী বা বেতারযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তাঁর বাণী ভেসে আসে! সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বিমূঢ়, বিস্ময়াহত সুধাংশুকে প্রিয়তোষবাবু জানিয়েছিলেন — “রেডিওতে আমার স্ত্রী রোজ এইসময় আমার সঙ্গে কথা কন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এমনি হয়ে আসছে। আমার জীবনের এই একমাত্র সম্বল। উনিই সংসার চালান, উনিই সবকিছু করেন— আমি শুধু ওঁর কথামত কাজ করে যাই।” তবে সেদিন শুধু প্রিয়তোষবাবুর রেডিওতেই নয়, সুধাংশু বাড়ী ফিরে তাঁর নিজের বেতার যন্ত্রটিতেও সেই নারী কণ্ঠের তরল কৌতুকের হাসিকে এস্রাজের ধাতব মূর্ছনার মত বেজে উঠতে শুনেছছিলেন — “তারপর সেই গলার আওয়াজ, —কেমন জব্দ! আর যাবেন পরের হাঁড়িতে কাঠি দিতে? … স্বামী-স্ত্রীর কথা চুরি করে শুনতে গিয়েছিলেন তাই একটু ভয় দেখালুম। আর কখনও এমন কাজ করবেন না।” এই গল্পটিতে অদ্ভুত ও কৌতুকরসের মধ্যে সুন্দর একটি সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। অতীতে বেতার যন্ত্র জন-মনোরঞ্জনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। কিন্তু এই গল্পে সেটাকেই একটি বিশেষ ক্ষেত্রে ইহলোক ও পরলোকের সংযোগ-সেতুরূপে কল্পনা করে লেখক নিঃসন্দেহে তাঁর অভিনব চিন্তা ও গভীর রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: প্রেতপুরী থেকে মরণদোল: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী ১
দেহান্তর (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ): দেহান্তর গল্পে বরদা তাঁর নিজের একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বন্ধুদের কাছে বিবৃত করেছিলেন। এই গল্পের ঘটনাস্থল কোন একটি পাহাড়ী অঞ্চল ছিল, যেখানে বরদার জ্যেষ্ঠ শ্যালক বাস করতেন। তাঁরই কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে এই কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে বরদার পরিচয় ঘটেছিল। এখানে পাত্রপাত্রী মূলতঃ তিনজন, তাঁদের মধ্যে দু’জন ইহজগতের বাসিন্দা, এবং অন্যজন লোকান্তরবাসী। গল্পের নায়িকা বিধবা সাবিত্রী দাস একজন সুন্দরী তরুণী, প্রমথ নামের একজন স্থানীয় বাঙালী যুবক তাঁর প্রতি গভীরভাবে প্রণয়াসক্ত। তিনি সাবিত্রীকে বিবাহ করতে চান। কিন্তু শান্ত ও সংযত সাবিত্রীর আচরণে প্রমথর প্রতি তাঁর কোন ধরণের প্রণয়োচ্ছাস ধরা পড়ে না, তাই সাধারণ মানুষ তাঁর প্রকৃত মনোভাবকে অনুধাবন করতে না পারলেও তাঁর প্রয়াত স্বামীর অশরীরী আত্মার কাছে প্রমথকে কেন্দ্র করে সাবিত্রীর হৃদয়-দৌর্বল্য কিন্তু অজ্ঞাত থাকে না। তাই হর-জটায় সাবিত্রী দাসের বাড়ীতে এক রাত্রে প্ল্যানচেটের আসর বসানো হলে, কোমল প্রকৃতির প্রমথর কণ্ঠে কঠিন প্রকৃতির মিস্টার দাসের বক্তব্য ধ্বনিত হয়েছিল — “তুমি আবার বিয়ে করতে চাও? দেব না— দেব না— তুমি আমার—।” প্ল্যানচেটের সময়ে প্রেতাত্মা সাময়িকভাবে মিডিয়ামের ওপরে ভর করতে পারে, আবার যথাসময়ে ছেড়ে চলেও যায়; কিন্তু মিস্টার দাসের আত্মা তাঁর স্ত্রীর প্রণয়ী প্রমথর প্রতি প্রবল বিদ্বেষবশতঃ তাঁর দেহকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে নিয়েছিল। তাই এরপরে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছিল, — প্রমথর প্রকৃতি শুধু নয়, আকৃতিও গতাসু মিস্টার দাসের অনুরূপ হয়ে উঠেছিল, এমনকি চিবুকের মধ্যবর্তী খাঁজটি পর্যন্ত বাদ যায়নি! অর্থাৎ, আলোচ্য গল্পে দেখানো হয়েছিল যে, দেহ বিমুক্ত আত্মা ইচ্ছামত শরীর ধারণ করতে পারে না বটে, কিন্তু কোনও জীবিত দেহে ভর করে সেটাকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করতে পারে। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে প্রমথকে সাবিত্রীর দ্বিতীয় স্বামী বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রমথর দেহকে আশ্রয় করে মিস্টার দাসেরই অতৃপ্ত আত্মা তাঁরই স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করেছিল! এই গল্পের শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যা বরদার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল — “যদি তাই হয় তাহলে প্রমথর আত্মাটার কী হল? কোথায় গেল সে?” কিন্তু এর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই বরদার শ্রোতারা হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠেছিলেন, কারণ — “অকস্মাৎ আকাশে একটি দীর্ঘ আর্ত কর্কশ চীৎকারধ্বনি হইল। বাদুড়ের মতো একটা পাখি চাঁদের উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছে— কালো ত্রিকোণ পাখা মেলিয়া পাখিটা ক্রমে দূরে চলিয়া গেল।” অলৌকিক কাহিনীর পক্ষে এই ধরণের রহস্যময় উপসংহার অবশ্যই শিল্পসম্মত।
নীলকর (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ): নীলকর গল্পটিতে বরদার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি অতৃপ্ত প্রেতাত্মার বিস্ময়কর ক্রিয়াকলাপ বর্ণিত হয়েছে। সেই প্রেতাত্মাটি একজন নীলকর সাহেবের ছিল। অতীতে মজঃফরপুর জেলার নীলমহল অঞ্চলের জনসাধারণের কাছে যিনি ‘বিল্লি সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেই ‘বিল্লি সাহেব’ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রোগ সাহেবের স্বগোত্রীয় ছিলেন। কারণ — রোগ সাহেবের মতোই বিল্লি সাহেবের অন্তরেও প্রজাপীড়নের সাধারণ প্রবণতা ছাড়াও নারীদেহের প্রতি প্রবল আসক্তি ছিল। বহু নারীর উপরে তাঁর অকথ্য নির্যাতনের যোগ্য পুরস্কার তিনি শেষপর্যন্ত একজন রমণীর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কোৎঘরে বন্দিনী সেই কৃষক বধূই তাঁর দুই হাতের ‘কাঙনা’ দিয়ে বিল্লি সাহেবের মাথার রগে প্রবল করাঘাত করে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আর সেই আঘাতের ফলে সেখানেই বিল্লি সাহেবের মৃত্যু ঘটেছিল। অন্যান্য সাহেবেরা সেই কেলেঙ্কারীর কথা গোপন করবার জন্য কোৎঘরের মাটি খুঁড়ে সেখানেই বিল্লি সাহেবের প্রাণহীন দেহকে সমাধিস্থ করেছিলেন। তারপর থেকে সেই কোৎঘরই সাহেব ভূতের আবাসস্থল হয়ে উঠেছিল। সেই নীলমহল এবং সেখানকার কোৎঘর পরে বরদাদেরই পৈতৃক সম্পত্তির অন্তর্গত হয়েছিল। তাই সেখানে জমিজমার তদারক করতে গিয়ে বরদা নায়েব শিবসদয়-বাবুর কাছ থেকে সেই সাহেব ভূতের কাহিনী শুনে বিশেষভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। অশরারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে বরদার কোন অবিশ্বাস না থাকলেও প্রবল অনুসন্ধিৎসা অবশ্যই ছিল। তাই ভূতের প্রতি সন্দেহবশতঃ নয়, ভূতের অবস্থানের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়ার জন্যই নিজের মনকে প্রস্তুত করে বরদা বিল্লি সাহেবের ঘরে একাকী শয়ন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকেনি; কারণ — রাতের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই কোৎঘরে একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে সুরু করেছিল; যেমন — যথেষ্ট ইন্ধন থাকা সত্ত্বেও লণ্ঠন নিভে যাওয়া, ঘরের বন্ধ দরজা জানলাগুলি আপনা থেকেই খুলে যাওয়া, অদৃশ্য কোনও ব্যক্তির খিসখসে হাসির আওয়াজ, বরদার প্রজ্বলিত সিগারেটের ঘ্রাণ গ্রহণ করবার জন্য তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা, কুঁজো থেকে জল খাওয়ার শব্দ — ইত্যাদি সবই বরদা সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, তবুও তিনি নিজের সাহস হারাননি। কিন্তু হলধরের স্বৈরিনী কন্যা কবুতরী সেই ঘরে প্রবেশ করবার মুহূর্ত থেকেই সেখানে যা কিছু ঘটতে শুরু করেছিল, তাতে বরদার মত দুর্জয় মনোবলসম্পন্ন ব্যক্তিও তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। কবুতরী সেখানে তাঁর যৌবনের কুহকমন্ত্রে বরদাকে বশীভূত করতে উপস্থিত হলেও বরদা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে, একটি অদৃশ্য শক্তির বন্ধনে কবুতরী যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছিল, আর তারপরে সেই শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে আপ্রাণ প্রয়াস করলেও নারীলোলুপ বিল্লি সাহেবের প্রেতাত্মা নিজের আগ্রাসী ক্ষুধায় যেন কবুতরীকে নিঃশেষে গ্রাস করে নিতে চেয়েছিল! প্রেতের বিকৃত কামনার এমন নগ্ন প্রকাশ বরদা আর কখনও দেখেন নি। বিল্লি সাহেবের সেই খিসখসে হাসির শব্দকে বরদা — ‘অসভ্য বেয়াড়া হাসি’ — বলেছিলেন; কারণ — সেটার মধ্যে দিয়ে শুধু মৃত সাহেবের পঙ্কিল মনই প্রকাশ পায়নি, সেই হাসির শ্রোতার অন্তরেও সুপ্ত আদিম কামনা জেগে উঠে তাঁকে নৈতিকতা ও শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করবার জন্য প্ররোচিত করতে শুরু করেছিল। নীলকরদের অনেক কুকীর্তির পরিচয়ই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু একজন নীলকর সাহেবের প্রেতাত্মার পরিচয় সম্ভবতঃ শরদিন্দুর এই গল্পেই প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। আলোচ্য গল্পে ভৌতিক পরিবেশ যেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তেমনি অতীতের কলুষ পরিবেশের প্রভাব কিভাবে বর্তমানের মানুষকে অধঃপতনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে — সেটার পরিচয়ও উদ্ঘাটিত হয়েছে। বহুকাল আগে মৃত বিল্লি সাহেবের চারিত্রিক শৈথিল্যই যেন গল্পের নায়েব শিবসদয় ও ভ্রষ্টা কবুতরীর চরিত্রে সঞ্চারিত হয়েছে। সেবারে ভূতের ভয়ে নয়, নৈতিক পদস্খলনের ভয়েই বরদা উক্ত ঘটনার মাত্র দু’দিন পরেই নীলমহল ত্যাগ করেছিলেন।
আরও পড়ুন: মহান মে দিবস: আজ আমাদের সংহতির দিন
এবারে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের বরদা চরিত্রটি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে এই প্রবন্ধের সমাপ্তি করা যেতে পারে। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের মতোই ভূতান্বেষী বরদাও স্রষ্টা শরদিন্দুর আরেকটি প্রশংসনীয় সৃষ্টি। অবশ্য ব্যোমকেশকে কেন্দ্র করে শরদিন্দুর রচিত গল্পগুলির তুলনায় তাঁর বরদা কেন্দ্রিক গল্পগুলি সংখ্যায় নিতান্তই নগণ্য। অতএব স্বাভাবিকভাবেই ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা বরদার তুলনায় অনেক ব্যাপক। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা গোয়েন্দা গল্প পড়ুয়াদের কাছে ব্যোমকেশ যেমন একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র, ঠিক তেমনভাবেই ভূত-অনুরাগী পাঠক-পাঠিকাদের পক্ষে বরদাকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভবতঃ অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। ব্যোমকেশের মূল বাসস্থল ও কর্মক্ষেত্র যেখানে কলকাতা ছিল, বরদা সেখানে মুঙ্গেরের অধিবাসী ছিলেন। ব্যোমকেশ যেখানে যুক্তি ও অনুমানের প্রখর আলোকসম্পাতের মাধ্যমে রহস্যের সমস্ত কুহেলী জালকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, বরদা সেখানে অপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতের প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন, আর তাই তিনি অলৌকিক জগতের রহস্যময়তাকে অন্যের হৃদয়েও সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তবুও একজায়গায় ব্যোমকেশের সঙ্গে বরদার মিল দেখতে পাওয়া যায়, সেটা হল যে — অন্য পাঁচজন সাধারণ বাঙালীর তুলনায় তাঁরা দু’জনেই অসাধারণ হলেও তাঁদের জীবনচর্যায় ও আচারে-আচরণে বাঙালীয়ানার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে।
বরদার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ভৌতিক গল্পগুলি পাঠ করলে তাঁর সম্বন্ধে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য লাভ করা যায়, যেগুলি এই চরিত্রটির ব্যক্তিস্বরূপকে উপলব্ধি করবার পক্ষে একান্তভাবে সহায়ক। ‘রক্তখদ্যোত’, ‘টিকটিকির ডিম’, ‘বহুরূপী’, ‘নীলকর’ প্রভৃতি গল্পের মাধ্যমে বরদার পারিবারিক জীবনের একটি নির্ভরযোগ্য রেখাচিত্র লাভ করা যায়। ‘রক্তখদ্যোত’ গল্পটি পড়লে জানা যায় যে, বরদা কৃতদার ছিলেন এবং তাঁর পেঁচো (পাঁচু?) নামের একটি ভাইও ছিল। খুব সম্ভবতঃ সেই ভাইটি অল্পবয়স্ক ছিলেন; কারণ, পেঁচোর সম্পর্কে অমূল্যকে বরদার উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গিয়েছিল — “এই বয়স থেকেই ছোট ভাইটির মাথা খাওয়া হচ্ছে কেন?” ‘টিকটিকির ডিম’–এ বরদার মায়ের এবং ‘নীলকর’ গল্পে বরদার দাদার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বহুরূপী’ ও ‘নীলকর’ গল্প থেকে জানা যায় যে, মুঙ্গের শহর থেকে মাইল পনেরো দূরে অবস্থিত দেহাত অঞ্চলে এবং মজঃফরপুর জেলায় বরদাদের কিছু ভূ-সম্পত্তি ও কয়েকঘর প্রজা ছিল। আর্টস-স্টুডেন্ট বরদার বি. এ. পরীক্ষা দেওয়ার সংবাদ — ‘সবুজ চশমা’ গল্পে পাওয়া যায়। শ্যালক শুভেন্দুর সঙ্গে কাফি খাঁর সেতারে মালকোষ শুনতে গেলেও আসলে কিন্তু তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘মালকোষ’ গল্পে তাঁর স্বীকারোক্তিটি লক্ষ্যণীয় — “উচ্চাঙ্গ গান-বাজনার প্রতি আমার বিশেষ আসক্তি নেই; ধ্রুপদ চৌতাল ধামার দশকুশী বুঝিনা; রবীন্দ্র-সঙ্গীতেই আমার আত্মা পরিতুষ্ট।” তাই ‘আকাশবাণী’ গল্পে ফাল্গুন মাসের এক অপরূপ গোধূলিতে এই প্রসিদ্ধ ভূতপ্রেমিকেরই কণ্ঠে গুঞ্জরিত হয়েছিল — “যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি।”
বরদা ভদ্র, মার্জিত ও শিক্ষিত একজন বাঙালী যুবক ছিলেন। তাই কোন ধরণের অশালীনতাকে তিনি বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতে নারাজ ছিলেন। ‘নীলকর’ গল্পের নায়েব শিবসদয়বাবুর চারিত্রিক অধঃপতনকে তিনি যেমন আন্তরিকভাবে সমর্থন করতে পারেনি, তেমনি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য কবুতরীর নির্লজ্জ প্রয়াসকেও তিনি প্রবলভাবে উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। ফলে এই সত্যি তাঁর অনুভূতির অগোচরে থাকেনি যে, দিনের পর দিন নীলমহলের সেই দূষিত পরিবেশে অতিবাহিত করলে শেষপর্যন্ত কোন সুস্থ রুচি সম্পন্ন মানুষও সেখানে অসুস্থ কামনার শিকার হয়ে পড়তে পারে। তাই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বরদা কোন ধরণের সুলভ আমোদের মোহে প্রলুব্ধ না হয়ে দু’দিনের মধ্যেই মজঃফরপুরের সেই বিশেষ অঞ্চলটি পরিত্যাগ করে মুঙ্গেরে ফিরে গিয়েছিলেন।
বরদার প্রেত-বিশ্বাস কখনও কখনও তাঁর বন্ধুদের কাছে পরিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর আগে এই বরদাও ঘোর নাস্তিক ছিলেন। কি করে তিনি প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, সেই ঘটনাই ‘সবুজ চশমা’ গল্পে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছিল। ওই ‘সবুজ চশমা’ চোখে পরবার পর থেকেই প্রেত জগতের প্রতি তাঁর কৌতূহল জেগে উঠেছিল। মানুষের সহজাত সংস্কার বা ভয় যে তাঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না — তা কিন্তু নয়। কোনও কোনও ভয়ংকর পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ভয়ের হিমশীতল অনুভূতিতে তাঁরও স্নায়ুতন্ত্রী অবশ হয়ে গিয়েছিল। তবে সেই ভয়কে জয় করে রহস্যের রস আকণ্ঠ পান করবার দুঃসাহস ও কৌতূহল তাঁর মধ্যে ছিল বলেই — প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়েও তিনি সাধারণের অগম্য স্থানে দিন বা রাত্রি অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন। এই প্রসঙ্গের দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘প্রেতপুরী’ ও ‘নীলকর’ গল্পদুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: স্বঘোষিত নাস্তিক, প্রথাবিরোধী সাহিত্য স্রষ্টা হুমায়ুন আজাদ সর্বকালের আলোকিত মানুষ
বরদা ভূতকে ভয় না পেলেও তুচ্ছ প্রাণী টিকটিকির প্রতি তাঁর প্রবল বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন — “টিকটিকির দর্শন মাত্রেই আমার প্রাণে একটা অহেতুক আতঙ্কের সঞ্চার হয়, পেটের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যায়, শিরদাঁড়া সিরসির করতে থাকে।” (টিকটিকির ডিম) বরদার গল্প বলবার কৌশলটি চিত্তাকর্ষক। নিজের জীবনে তিনি শুধু নানাধরণের অলৌকিক অভিজ্ঞতাই অর্জন করেননি, সেগুলিকে গল্পের আকারে পরিবেশন করবার ক্ষেত্রেও তাঁর অসাধারণ পারদর্শিতা দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ‘কল্পকুহেলী’ নামক গল্প সংকলনের ভূমিকায় সুভদ্রকুমার সেনের মন্তব্যটি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন — “… বরদার উক্তি ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর বন্ধুরা স্থির নিশ্চয় নয়। ইংরেজী হলে বলতুম রীতিমত Sceptic। বরদার বর্ণিত কাহিনীগুলি তাঁর বন্ধুরা শুনতে অনিচ্ছুক নয়, কিন্তু বিশ্বাস করতে পরাম্মুখ, অথচ যখন গল্প বলা শেষ হয় তখন তাঁরা গল্পটিকে গঁজাখুরি বলে সরাসরি উড়িয়ে দিতেও পারেনা। ঘরে ফিরে যেতে তাঁদের গা ছমছম করে।” (শরদিন্দু অমনিবাস, পঞ্চম খণ্ড, গল্প পরিচয় অংশ দ্রষ্টব্যঃ) এই উক্তির যাথার্থ্যতা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষতঃ যখন দেখা যায় যে, অমূল্যর মত একজন প্রবল প্রতিপক্ষ বরদার গল্প সুরু হওয়ার আগে তাঁকে যতই বাধা দেওয়ার বা ব্যঙ্গ বাণে বিদ্ধ করবার চেষ্টা করুক না কেন, গল্পের শেষে প্রতিবাদের সমস্ত ভাষা ভুলে কখনও ভয়ে তো কখনও আবার বিস্ময়ে মৌন হয়ে যায় — তখন একজন সুবক্তা হিসেবে বরদার সাফল্য সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকার মনে কোনও সন্দেহই থাকে না।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সূত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বরদা সম্পর্কে অনেক তথ্যই পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়েছিলেন, কিন্তু শুধু একটি বিষয় ছাড়া! সেটা হল যে, তিনি বরদার পেশাটি কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। সত্যান্বেষণের মাধ্যমে ব্যোমকেশের যশ প্রাচুর্য ঘটলেও আর্থিক উন্নতি কিন্তু তেমনভাবে ঘটেনি; সেই কারণে একটাসময়ে অজিতের সঙ্গে তাঁকেও পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসা শুরু করতে হয়েছিল। তবুও সত্যান্বেষীর জমার খাতার হিসেব একেবারে শূন্য ছিল না, বিশেষতঃ — ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্ত হীরা’, ‘দুর্গরহস্য’ প্রভৃতি গল্পে তাঁর প্রাপ্তিযোগ দেখলে রীতিমত ঈর্ষান্বিত হতে হয়। অন্যদিকে ভূতের সান্নিধ্যে এসে বরদা প্রচুর অলৌকিক অভিজ্ঞতা অর্জন করলেও, তাঁর লৌকিক সংসার যাত্রা নির্বাহ কিভাবে হত — শুধুমাত্র পারিবারিক জমিজমার আয় থেকে কি? — পাঠক-পাঠিকার এই কৌতূহলটুকু শেষপর্যন্ত অচরিতার্থই থেকে যায়।#