।। পর্ব – ৩২।।
২০০৭-এর ১২ মার্চ, সোমবার মহাকরণের একটি নিভৃত ঘরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক বসল। সেখানে পুলিশকর্তারা হিসেব করে সরকারকে জানালেন, নন্দীগ্রামে তাঁরা যে অপারেশন চালাতে চাইছেন, সেখানে বাধ্য হয়ে পুলিশ গুলি চালালেও মৃত্যু হতে পারে খুব বেশি হলে কুড়ি জন গ্রামবাসীর। আর উত্তেজিত জনতা মারমুখী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে, সেখানে মারা যেতে পারে সর্বাধিক পাঁচ-ছ’জন পুলিশ।
এই হিসেব শুনে সরকারি কর্তারা একযোগে বললেন, গো অ্যাহেড। যত বড় ঘটনাই ঘটুক না কেন, এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হলেও, উচ্চমাধ্যমিক আর বিশ্বকাপের মরশুমে এই সব নিয়ে দু’-চার দিনের বেশি কেউ মাথা ঘামাবে না।
মহাকরণের রুদ্ধদ্বার কক্ষে অত্যন্ত গোপনে এই বৈঠক হলেও কী করে যেন সে খবর এসে পৌঁছল নন্দীগ্রামে। সে দিনই রাত্রিবেলায় নন্দীগ্রাম ও তার আশপাশ থেকে কয়েক জনের ফোন ছুটে গেল কবির সুমন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শুভাপ্রসন্ন, তরুণ সান্যাল, সুনন্দ সান্যালদের কাছে।
আতঙ্ক মেশানো গলায় কেউ বললেন, শুনছি সি পি এমের হার্মাদরা নাকি খেজুরির দিক থেকে এসে আজ রাতেই নন্দীগ্রাম আক্রমণ করবে। কেউ বললেন, আমাদের গ্রামেরই একজন আসার পথে দেখে এসেছে, একটা বিশাল পুলিশ বাহিনী আমাদের গ্রামের উলটো দিকে এসে জড়ো হয়েছে। কখন কী হবে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
একজন সাংবাদিক বললেন, বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে সন্ধ্যার অনেক আগেই আমি সোনাচূড়ায় চলে এসেছি। এখানে বিরাট বড় একটা অঘটন ঘটতে চলেছে। ব্রিজের ও পারে প্রচুর পুলিশ জড়ো হয়েছে। মাঝে মাঝেই সোনাচূড়ার ওপরে সার্চ লাইট ফেলছে। গণমুক্তি পরিষদ যদি এখনই কিছু না করে, তা হলে সামনে কিন্তু মহাবিপদ।
কেঁপে উঠলেন সুনন্দবাবু। কাকে জানাবেন এ কথা! কাউকে জানানোর চেয়ে এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরি হল, ওই পুলিশগুলোকে আটকানো। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন প্রাক্তন দুই আই পি এস অফিসারকে। একজনকে সংক্ষেপে সব জানিয়ে অনুরোধ করলেন, এক্ষুনি পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলুন। অন্য জনকে বললেন, স্বরাষ্ট্র সচিবকে পুরো ব্যাপারটা জানাতে। ওঁরা দু’জনেই বললেন, দেখছি।
কিন্তু সুনন্দবাবুর কেন জানি মনে হল, এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। কারণ, পুলিশ-প্রশাসন এখন সি পি এমের দলদাসে পরিণত হয়েছে। তাই অসহ্য এক মনোকষ্টে তিনি ছটফট করতে লাগলেন। একে ফোন করলেন। তাকে ফোন করলেন। অবশেষে রাত দশটা নাগাদ ফোনে ধরলেন দিল্লির এক প্রভাবশালী ব্যক্তিতে। তাঁকে গ্রামবাসীদের অসহায়তার কথা জানালেন। আশঙ্কার কথা জানালেন।
দিল্লিবাসী ওই ভদ্রলোক সুনন্দবাবুর ভীষণ গুণমুগ্ধ। তাই তাঁর কথা তিনি ফেলতে পারলেন না। যোগাযোগ করলেন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর সঙ্গে। রাজ্যপাল তখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সফরে চেন্নাইতে। সব শুনে তক্ষুনি সেখান থেকেই কলকাতার রাজভবনে তাঁর মুখ্যসচিবকে তিনি নির্দেশ দিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এক্ষুনি বলুন, পুলিশ যদি কোনও উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে নন্দীগ্রামে ঢোকেও, তা হলেও যেন যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দেয়। কোনও পরিস্থিতিতেই যেন একটি বুলেটও না চালায়।
মুখ্যসচিবের কথা শুনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা থ’। তাঁদের অত্যন্ত গোপন এই পরিকল্পনার কথা রাজ্যপালের কাছে পৌঁছে গেল কী করে! না, আজ রাতে আর কিচ্ছু করা যাবে না। আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
পর দিন ১৩ মার্চ, মঙ্গলবার, সকাল সাড়ে দশটায় কোলাঘাট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অতিথি নিবাসের সভাঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে তখন সার সার গাড়ি। কোনও কোনওটার মাথায় লাল লাইট লাগানো। আর ভিতরে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পদস্থ পুলিশ অফিসারদের উপচে পড়া ভিড়। কে নেই সেখানে? তমলুকের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবাশিস বড়াল, ডি আই জি (মেদিনীপুর রেঞ্জ) এন আর বাবু, পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার গাঞ্জি অনিল শ্রীনিবাসন থেকে শুরু করে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অনিল অগ্রবাল, হলদিয়ার মহকুমাশাসক শঙ্কর হালদার, কাঁথির মহকুমাশাসক তরুণ মুখোপাধ্যায়, হলদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক সুকুমার পরশপাথ, হলদিয়ার বি ডি ও স্বরূপকুমার মৌলিক। বাদ যাননি মহিষাদলের সার্কেল ইনস্পেক্টর স্বপন দে-ও।
সেখানে আই জি অরুণ গুপ্ত তাঁদের বোঝাতে লাগলেন, কী ভাবে শুরু করতে হবে নন্দীগ্রাম অপারেশন। কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। উদ্দেশ্যটাই আসল। সেটা সফল করার জন্য যদি দশ-বিশটা লাশ পড়ে তো পড়ুক।
বিকেলে আর এক দফা বৈঠক হল তমলুক পুলিশ লাইনে। সেখানে আই জি, ডি আই জি-র সঙ্গে সি পি এমের কর্তাব্যক্তিরা মিলে ঠিক করলেন, শুধু পুলিশ নয়, পুলিশের পোশাকে তাঁদের সঙ্গে কিছু খতরনাক ক্যাডার বাহিনীও থাকবে। আত্মরক্ষার জন্য তাঁদের হাতে থাকবে আগ্নেয়াস্ত্র এবং পর্যাপ্ত বুলেট। তাঁরা সে বুলেট খরচ করলেও তার কোনও হিসেব নিতে পারবে না কেউ। না-পুলিশ। না-প্রশাসন। পুলিশকে তাঁরা দেখিয়ে দেবে, ওখানকার কাকে কাকে গ্রেফতার করতে হবে।
এই কথা শুনে কোনও কোনও পুলিশ বিবেকের তাড়নায় গাঁইগুঁই করছিল। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেই ফিসফাস করছিল, এটা ঠিক নয়, এটা অন্যায়। আর তাঁদের এই হাবভাব দেখে কর্তাব্যক্তিরা তাই আর ঝুঁকি নেননি। জলপাইগুড়ি, কৃষ্ণনগর থেকে রাতারাতি নিয়ে এসেছিলেন কিছু নির্ভরযোগ্য ফোর্স। সরকার কী চাইছে, কুঞ্জপুরের সি পি এমের পার্টি অফিসে বসে তা ছবির মতো তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অপারেশন-এর মাতব্বরেরা।
বেশিক্ষণ লাগল না, অন্যান্য খবরের মতো এই খবরটাও এসে পৌঁছল নন্দীগ্রামের ঘরে ঘরে। ব্রিজের ও পারে বিশাল পুলিশ বাহিনী দেখে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলেন, বিপদ আসন্ন। কিন্তু ভিন জেলা থেকে আসা এই পুলিশগুলো যেহেতু এখানকার রাস্তাঘাট একদমই চেনে না। তাই ওরা কেউ কেউ বলল, রাতে নয়, কাল সকালে আক্রমণ করাই ভাল।
লোক মারফত এই খবর শুনে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির লোকেরা সেই রাতেই তড়িঘড়ি একটি জরুরি সভা ডাকল। সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, কাটা রাস্তা বা বাঁধের যে দু’টি জায়গা দিয়ে পুলিশ তাঁদের গ্রামে ঢুকতে পারে, সেখানে পুজো আর কোরাণ পাঠের আয়োজন করে গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের লোককেই জড়ো করতে হবে। মহিলা আর শিশুদের রাখতে হবে একদম সামনের দিকে। পুলিশ যাতে সহজে লাঠি চার্জ করতে না পারে।
কারণ, ২০০৭-এর ৩ জানুয়ারি, গড়চক্রবেড়িয়ার কালীচরণপুর ৯ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি যখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে জমি অধিগ্রহণের নোটিস টাঙিয়েছিল, তখন দাবানলের মতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই খবর। সে দিন জমি অধিগ্রহণের কথা কানাঘুষোয় শুনে, কী করা যায়, সেটা আগাম আলাপ-আলোচনা করার জন্য ওখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে, ভূতার মোড়ে জমায়েত হয়েছিলেন বেশ কিছু মানুষ।
খবর পেয়ে শত-শত গ্রামবাসীর মতো তাঁরা যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছন, দেখেন, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৬-এ ইস্যু করা সেই নোটিশ।
আর ওটা পড়েই তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ পঞ্চায়েত অফিস ভাঙচুর করার জন্য তেড়ে যান।
তাঁদের ওই রুদ্রমূর্তি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন অঞ্চল-প্রধান। কারণ, তিনি জানতেন, অবিভক্ত এবং বিভক্ত বাংলায় যত বার কৃষক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, প্রত্যেক বারই তার মূল পীঠস্থান ছিল এই মেদিনীপুর।
১৯৪৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা, শেষ বড় কৃষক আন্দোলন– তেভাগা আন্দোলন। ‘তেভাগা’ মানে, জমিতে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক নয়, তিন ভাগের দু’ভাগ চাই। বর্গাদারদের এই দাবিতে রংপুর, পাবনা, খুলনা, যশোরের পাশাপাশি উত্তর বাংলার দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি থেকে শুরু করে বর্ধমান, হুগলি, চব্বিশ পরগনার মতো মেদিনীপুরের মহিষাদল, সুতাহাটা, তমলুক, ঘাটাল, কাঁথি, ভগবানপুরের সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, রাজা নন্দীগোপাল চৌধুরীর নামাঙ্কিত এই নন্দীগ্রামের মানুষও। অন্যান্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারাও বলেছিল, আধি নয়, তেভাগা চাই।
উনি আরও জানতেন, ‘তেভাগা’টার মূল হোতা কিন্তু এ দেশের কেউ নন। যাঁদের আমরা এ দেশ থেকে তাড়িয়েছি, সেই ইংরেজদেরই একজন– বেঙ্গল ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৩৮-১৯৪০) স্যার চার্লস ক্লাইড। এ দেশের গ্রামগঞ্জের চাষি-প্রান্তিক চাষিদের অসহনীয় দুর্দশা দেখে তিনি এই ‘তেভাগা আন্দোলন’ শুরু করলেও তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সি পি আই ওটা লুফে নিয়ে মাতামাতি শুরু করায় সবাই ভেবেছিল, ওটা বুঝি সি পি আই-এরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাই বর্গাদাররা তাদের দিকে ঝুঁকেছিল। সেই থেকে বরাবরই এই গ্রাম বামপন্থী এলাকা হিসেবে পরিচিত! মূলত সি পি আই এম আর সি পি আইয়ের আধিক্যই বেশি। ভোটের ফলাফলেও তার প্রমাণ মেলে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদও– ওই দুই কমিউনিস্ট পার্টির দখলে। সুতরাং সেই বামপন্থী লোকেরাই যখন এই বামফ্রন্ট জমানায়, বামফ্রন্ট সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুখর হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
তাই আর দেরি করেননি অঞ্চল-প্রধান। খবর দিয়েছিলেন থানায়। কিন্তু অত লোককে সামাল দেওয়া তো ওখানকার মতো সামান্য একটা গ্রামের অত্যন্ত ছোট্ট একটা স্থানীয় থানার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই খবর পাওয়া মাত্র নন্দীগ্রাম থানার ওসি শেখর রায় মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের থানা থেকে পুলিশ আনিয়ে, পুরো পাঁচখানা জিপ ভর্তি করে হাজির হয়ে গেলেন সেখানে।
পুলিশকে দেখেই গ্রামবাসীরা রাগে ফেটে পড়েন। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। হম্বিতম্বি করতে থাকেন। বলতে থাকেন, আমাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটে আমরা কিছুতেই সালিমদের দেব না।
তখন জনাকতক পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে লাঠি উঁচিয়ে সেই জনতার দিকে তেড়ে যায়। বলতে থাকে, শালারা, কী দেখতে এসেছিস রে? বলেই, তাঁদের উপরে এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে শুরু করে। লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। দৌড়তে দৌড়তে তাঁরা রাস্তার ওপর ইট-পাটকেল যা পান, তা-ই ছুড়েই মারতে থাকেন।
কয়েক জন পুলিশের গায়েও সেগুলো লাগে। আর তাতেই পুলিশরা সংহারমূর্তি ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামবাসীদের ওপরে। বাঁচার জন্য গ্রামবাসীরাও পালটা আক্রমণ করেন। উপয়ান্ত না দেখে, নন্দীগ্রাম থানার ওসি শেখরবাবু শেষ পর্যন্ত নির্দেশ দেন কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার। কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে ছুড়তে পুলিশরা এগোতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে থাকে সি পি এমের বেশ কিছু সক্রিয় কর্মী। তাদের মধ্যে থেকেই কে যেন হঠাৎ গুলি চালিয়ে দেয়। তার দেখাদেখি পুলিশের পোশাক পরা অন্যান্য ক্যাডাররাও।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যদুবারিচকের পনেরো বছরের কিশোর গুরুপদ বারিক। ডান হাতে গুলি লাগে তার। বাঁ হাতে গুলি লাগে ভূতার মোড়ের জাহাঙ্গির শাহের। বাঁ পায়ের ঊরুতে গুলি লাগে গড়চক্রবেড়িয়ার সেখ সাত্তারের। বুকের ডান দিকে গুলি লাগে যদুবারিচকের সেখ মইদুলের। এ ছাড়াও পুলিশের বেধড়ক লাঠিতে গুরুতর এবং অল্পবিস্তর জখম হন আরও অনেক গ্রামবাসী।
গুলি চলার কথা চাউর হতে না হতেই গোটা নন্দীগ্রাম অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। কেন্দেমারি, ভেকুটিয়া, সামসাবাদ, গোকুলনগর, সোনাচূড়া, যদুবারিচক, জালপাই, গাংড়া, গড়চক্রবেড়িয়া, সাউদখালি-সহ নন্দীগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাঠিসোঁটা, ঝাঁটা, দা নিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ ভূতার মোড়ে ছুটে আসেন।
কোনও কথা নয়, তাঁরা এসেই পুলিশের ওপর চড়াও হন। ওই মারমুখী বিশাল জনতাকে আটকানো তাদের গুটিকয় পুলিশের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা বুঝতে পেরে, পুলিশরা তড়িঘড়ি লাফ মেরে-মেরে যে যে-জিপে করে এসেছিল, সে সেই জিপে উঠে পড়ে।
ওদের পালাতে দেখে ক্ষিপ্ত জনতা পিছু ধাওয়া করতেই, তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আরও জোরে চালাতে গিয়েই একটি জিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ভূতার মোড়ের কাছে একটি বৈদ্যুতিক স্তম্ভে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে জিপটি উলটে যায়।
পিছনে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে আসছিল পর পর বাকি চারটি জিপ। সহকর্মীদের ওই অবস্থা দেখে, জিপ থেকে ঝপাঝপ নেমে পড়ে তারা। উলটে যাওয়া জিপের তলা থেকে আহত, রক্তাক্ত পুলিশদের কোনও রকমে উদ্ধার করে। তার পর ধরাধরি করে নিজেদের জিপে তুলে প্রাণ নিয়ে দে ছুট।
উন্মত্ত গ্রামবাসীরা ওদের আর ধরতে পারেননি। ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে উলটে পড়ে থাকা ওই জিপটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। অন্য একটি জিপও সোনাচূড়ার কাছাকাছি হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়ায়, সেটিকেও মাঝপথে ফেলে পুলিশরা পালিয়ে যায়। সেই গাড়িটিতেও আগুন লাগিয়ে দেন বল্লাহীন জনতা।
পরে, গ্রামে ফিরে গ্রামবাসীরা দেখেন, চার জন গুলিবিদ্ধ। বহু মানুষ লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত। এই সব দেখে, আর মাথা ঠিক রাখতে পারেননি তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে যাঁর বাড়িতে যা ছিল, শাবল, বেলচা, কোদাল নিয়ে দলে দলে বেরিয়ে আসেন। গ্রামে ঢোকার সব ক’টা প্রধান রাস্তা, এমনকী যে সব জায়গা দিয়ে কোনও রকমে গ্রামে গাড়ি ঢুকতে পারে, সে-সব রাস্তাও বেশ কয়েক হাত গভীর করে কাটতে শুরু করেন। শুধু পুরুষরাই নন, পুরুষদের পাশাপাশি সেই কাজে যোগ দেন বাড়ির মেয়ে-বউরাও। বাদ যায় না বাচ্চারাও। তারা সবাই মিলে ভেঙে দেয় সেচের সরু খালগুলোর উপর গাড়ি চলাচলের জন্য পাতা কালভার্টগুলিও। ছোটখাটো পথগুলিও আটকে দেয় বোল্ডারের স্তূপ, গাছের গুঁড়ি আর পিচের বড় বড় ড্রাম দিয়ে। যাতে, শুধু জিপ নয়, বাইক নিয়েও পুলিশরা হুট করে গ্রামে ঢুকতে না পারে।
এলেও, ওগুলো সরাতে সরাতে ওদের যে সময় লাগবে, তার মধ্যেই গ্রামবাসীরা যাতে ওখানে জড়ো হয়ে যেতে পারেন। প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে পারেন।
এর পাশাপাশি তাঁরা স্লোগান তোলেন, ‘পুলিশের অত্যাচার মানছি না, মানব না।’ ‘পুলিশের অত্যাচার রুখছি, রুখব।’ ‘রক্ত চাইছি, রক্ত দাও।’ ‘সালিমদের সার্কুলার পুড়িয়ে দাও।’ ‘সালিমকে জমি আমরা দিচ্ছি না, দেব না।’ ‘সালিম তুমি নন্দীগ্রাম থেকে দূর-দূর-দূর হটো।’
সে দিনই আলাপ-আলোচনা করে গ্রামের লোকেরা এককাট্টা হয়ে গড়ে তোলেন, ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি।’
পর দিন গুলি চালানোর প্রতিবাদে বারো ঘণ্টার বাংলা বন্ধ পালিত হয়।
তার মাসখানেক পরে, কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির ডাকে ৪ ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রামের কলেজ ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতে এক বিশাল জনসভা হয়। সেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘আপনাদের ভয় নেই বন্ধু। আমরা আপনাদের পাশে আছি।’ মমতার সঙ্গে আসা এক বর্ষিয়ান তৃণমূল নেতা তাঁদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করে বলে যান, এর পর যদি ফের এ রকম কোনও ঘটনার আগাম খবর পান, তা হলে বাচ্চা আর মেয়েদের সামনের দিকে এগিয়ে দেবেন। তা হলে দেখবেন, পুলিশরা আর অত সহজে ও রকম কাণ্ড ঘটাতে পারবে না।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘উত্তাল’ (একত্রিশ)
উনি ঠিকই পরামর্শ দিয়েছেন, হ্যাঁ, ওঁরা সেটাই করবেন। তবু তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের চোখে-মুখে আতঙ্ক! উদ্বেগ! সে দিনের সেই ভূতার মোড়ের মতো আবার ও রকম কোনও ঘটনা ঘটবে না তো! আবার কোনও মায়ের বুক খালি হবে না তো!
তাদের এই ভয়ার্ত মুখ দেখে তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী আর থাকতে পারলেন না। মুখ্যমন্ত্রীকে এক ফ্যাক্সবার্তায় জানালেন, নন্দীগ্রামের লোকদের মনে প্যানিক সৃষ্টি করছে এখানকার পুলিশ। আপনি এক্ষুনি এ সব বন্ধ করতে বলুন।
কিন্তু সে বার্তা শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর হাতে গিয়ে পৌঁছল কি না, কেউ জানে না।
এ দিকে নন্দীগ্রামে ঢোকার মুখে ব্রিজের ও পারে জড়ো হয়েছে বিশাল এক পুলিশ বাহিনী। সঙ্গে জেল ফেরত, নানা কেসে ফেরার, ক্যাডার-নামী বেশ কিছু দাগি আসামি। তারা যে-কোনও সময় গ্রামে ঢুকতে পারে। তাদের ফোনে উপর মহল থেকে নির্দেশের পর নির্দেশ আসতে লাগল।
তারাও জানাল, আমরা একদম রেডি। যে-কোনও সময় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু কখন?
সি পি এম নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে বসে ঠিক করল, এমন একটা সময় বাছতে হবে এবং এত কম সময়ের মধ্যে, চুপিসাড়ে পুরো ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে, যাতে রাজ্যপাল কোনও মতেই জানতে না পারেন। আর জানলেও, রাজ্যপালের কোনও নির্দেশ যাতে ওই সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে এসে না পৌঁছয়। রাজ্যপাল এখন ঠিক কোথায়?
সে দিকে নজর রাখতে শুরু করল সরকারের এক বড়কর্তা।
পর দিন ১৪ মার্চ। সকাল থেকেই সোনাচূড়ার ঘরে ঘরে মা সিংহবাহিনীর পুজো হচ্ছে। নামাজ পড়া চলছে। ঠিক তখনই ছড়িয়ে পরে খবর, সোনাচূড়ায় ঢোকার জন্য ঝাঁক ঝাঁক পুলিশ ভাঙাবেড়িয়া সেতুর দিকে এগিয়ে আসছে।
গ্রামবাসীরা জানতেন, দু’দিন আগে সুনন্দ সান্যাল কী ভাবে রাজ্যপালকে বলে তাঁদের গ্রামে পুলিশি আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁরা অন্যান্যদের ফোন করার পাশাপাশি সুনন্দবাবুকেও ফোন করলেন। বললেন, সোনাচূড়ার উপর আক্রমণ করার জন্য প্রচুর পুলিশ আর সি পি এমের ক্যাডাররা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। আপনি একটা কিছু করুন।
সুনন্দবাবু ফের ফোন করলেন দিল্লিবাসী সেই ভদ্রলোককে। গ্রামবাসীদের মুখে যা যা শুনেছেন, সব বললেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই ভদ্রলোক রাজ্যপালের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে পারলেন না। কারণ গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তখন কলকাতায় ফেরার জন্য বিমানে উঠে পড়েছেন। আর নিয়ম হল, বিমানে উঠলেই মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে দিতে হয়।
সুনন্দবাবু ফের ফোন করতে লাগলেন একটার পর একটা। যাঁদের ফোন করলেন, তাঁরা বেশির ভাগই বড় বড় নেতা-নেত্রী। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। অনেক রাত অবধি কাজ করেন। ফলে একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠেন। নিশ্চয় তাঁরা এখনও ওঠেননি। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই এই সাতসকালে তাঁদের ফোনের সুইচ অফ। কারও কারও ফোন বিজি। কারও ফোন নট রিচেবল। আর যাঁদের ফোনে পেলেন, তাঁদের জানানোর আগেই, দু’টি দলে ভাগ হয়ে কয়েকশো করে পুলিশ আর কিছু সি পি এমের ক্যাডার একই সঙ্গে বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ নন্দীগ্রামের দু’টি প্রবেশ পথ– গোকুলনগর-অধিকারী পাড়ার তেখালি ব্রিজ আর সোনাচূড়ার কাছে ভাঙাবেড়িয়া সেতুর সামনে এসে হাজির হল। দু’টি দলেই কয়েক জন করে স্থানীয় সি পি এমের মাতব্বর।
তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে মালপাড়ার দিকে পুলিশদের ঢুকতে দেখেই, গৌরাঙ্গ পুজোর জন্য জড়ো হওয়া গ্রামবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। কয়েকটা কমবয়সি ছেলেমেয়ে কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ করেই পুলিশকে লক্ষ করে ঢিল ছুড়তে লাগল। কে বা কারা ছুড়ছে বুঝতে না পেরে পুলিশরা ঘনঘন মাইকে ঘোষণা করতে লাগল, আপনারা কেউ ইট-পাটকেল ছুড়বেন না। একটু শান্ত হোন। আমাদের কথা একটু মন দিয়ে শুনুন। আপনাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমরা কাটা রাস্তা মেরামত করতে এসেছি। আপনারা আমাদের কাজ করতে দিন।
কয়েক জন গ্রামবাসী এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমরা আপনাদের কাটা-রাস্তা সারাতে দেব না। গাছের গুঁড়ি-টুরিও সরাতে দেব না। সময় হোক, আমরা নিজেরাই সব আগের মতো ঠিক করে দেব।
ওরা বলল, ঠিক করার হলে আপনারা অনেক আগেই ঠিক করতেন। এত দিনেও যখন করেননি, আর করতে হবে না। আমাদের বাধা দেবেন না। আমাদের কাজ করতে দিন। আমাদের কাছে পঞ্চায়েতের অর্ডার আছে।
– আমরা আপনাদের এখানে ঢুকতে দেব না।
– ঢুকতে দেব না মানে? আপনারা আটকানোর কে?
কথায় কথায় উত্তেজনা বাড়তে লাগল। পুলিশের এক রগচটা কনস্টেবল কথা বলতে বলতে ধাক্কা মারল এক গ্রামবাসীকে। তখন বাকি গ্রামবাসীরাও মারমুখী হয়ে উঠলেন। ধস্তাধস্তি শুরু হল। পিছন দিকে ছিল কচিকাঁচারা। বাবা-কাকাদের সঙ্গে পুলিশদের ঝামেলা হচ্ছে দেখে তারা হাতের সামনে হট-পাথর, গাছের ভাঙা ডাল-টাল যা পেল, তাই ছুড়ে ছুড়ে মারতে লাগল পুলিশদের লক্ষ করে।
পুলিশরা গ্রামবাসীদের উদ্দেশে ঘনঘন মাইকে ঘোষণা করতে লাগল, আপনারা ঢিল ছুড়বেন না। একটু শান্ত হোন। আপনারা এখান থেকে সরে যান। আমাদের কাজ করতে দিন।
ঠিক তখনই হঠাৎ একটা আধলা ইট এসে পড়ল এক কনস্টেবলের মাথায়। মুহূর্তে রক্তে ভেসে যেতে লাগল তার জামা। এ দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে ছোট-ছোট যে ছেলেমেয়েগুলো ইট ছুড়ছিল, তাদের দিকে ধেয়ে গেলেন একটা পুলিশ। বাচ্চাগুলো ছুট দিলেও একজনকে ধরে ফেললেন তিনি। এমন এক পেল্লায় চড় কষালেন যে বাচ্চাটি ওখানেই লুটিয়ে পড়ল।
গ্রামবাসীরা ওই পুলিশটিকে ঘিরে হম্বিতম্বি করতেই বাকি পুলিশরা ভাবল, ওকে হয়তো গ্রামবাসীরা মাটিতে ফেলে মারছে, তাই ওকে উদ্ধার করার জন্য হইহই করে তেখালি ব্রিজ টপকে ওরা ঢুকে পড়ল গ্রামের ভিতরে। ওদের সঙ্গে ঢুকে পড়ল সি পি এমের লক্ষ্মণ, বাদল, অনুপ, পরশুরাম মণ্ডল, জয়দেব পাইক, বাপি ভুঁইয়া, সুকেশ সাঁকিরা।
ব্রিজের এ পারে, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা নামাজ পড়ছিলেন, পুলিশরা সেখানে ঢুকে বেধড়ক লাঠি চালাতে শুরু করল। এলোপাথাড়ি লাথি মারতে লাগল। ফের যাতে নামাজ পড়ার জন্য ওরা আর ওখানে বসতে না পারে, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেচ্ছাপ করতে লাগল।
ক’হাত দূরেই হচ্ছিল গৌরাঙ্গ পুজো। পুলিশরা সেখানেও ঢুকে পড়ল। হুঙ্কার দিয়ে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ করে বলল, এখানে বসে কী করছিস? যা, ভাগ।
তবু কেউ যাচ্ছে না দেখে, যাকে সামনে পেল, তাকেই চড়-থাপ্পড়-ঘুষি মারতে লাগল। একটা পুলিশ ছুটে গিয়ে লাথি মেরে গৌরাঙ্গের মূর্তি ভেঙে দিল। গ্রামের লোকেরা হায় হায় করে ছুটে গিয়ে বাধা দিতে যেতেই পুলিশরা টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করল। হাতের কাছে লাঠি, লোহার রড যা পেল, তাই দিয়েই মারতে লাগল। দুই সম্প্রদায়ের ছোটাছুটিতে মিলেমিশে গেল হিন্দু-মসুলমান।
তখন একজন মাঝবয়সি মহিলা ভাঙা-ঠাকুরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পুলিশদের ওই অপকর্মের জন্য নাক-মলা, কান-মলা খেতে লাগলেন। সটান শুয়ে পড়ে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে লাগলেন। আর সেটা দেখে তাঁর চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে বাইরে বার করতে করতে এক পুলিশ বলল, শালি, তোরা আন্দোলন মারাবি? জায়গা দিবি না? জায়গা তোর বাপের? তোদের গাঁড়ে জায়গা ঢুকিয়ে দেব। বলেই, হাতে-পায়ে মাথায় যেখানে পারল রুল দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাতে পেটাতে মাটিয়ে শুইয়ে দিল।
যে সব বাচ্চা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা আবার ফিরে এসে রাস্তা থেকে ইট-পাটকেল নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়তে লাগল। একটা ইট পুলিশের কপালে লেগে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতস্থানটা রুমাল দিয়ে চেপে সেই পুলিশটা ছুটে গিয়ে, কোন বাচ্চাটা ছুড়েছে না দেখেই, যে বাচ্চাটাকে হাতের সামনে পেল, তার গলা টিপে ধরল। রাগের চোটে এমন জোরে টিপল, এক মিনিটও লাগল না, তার জিভ বেরিয়ে এল। ছটফট করতে করতে সে নেতিয়ে পড়ল।
পুলিশটার হঠাৎ খেয়াল হল, রাগের বশে সে কী করে ফেলেছে। বুঝতে পেরে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বাচ্চাটিকে সঙ্গে সঙ্গে কোলপাঁজা করে তুলে, সামনের পুকুরে ছুড়ে ফেলল।
আরও ক’টা বাচ্চা ধরা পড়ে গেল অন্যান্য পুলিশের হাতে। লাঠির বাড়িতে তাদের কারও মাথা ফাটল, কারও পা ভাঙল, কেউ মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল। কেউ রুলের বাড়ি খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
একটা বউ তখন প্রাণভয়ে তার দুধের বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল। একটা পুলিশ তার বুক থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিয়ে দু’পা ধরে এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল। বউটা বুঝতেই পারল না, কী হল। সে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ওটা দেখে বাকি মেয়ে-বউরা যে যে-দিকে পারল দৌড় লাগাল। কয়েক জন ছুটে গিয়ে ঢুকল গ্রামের একটা বাড়ির ভিতরে। তাদের ধাওয়া করে পুলিশরাও পৌঁছে গেল সেখানে। দমাদ্দম লাথি মেরে ভেঙে ফেলল দরজা। তার পর হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
ও দিকে ভাঙাবেড়া ব্রিজের কাছেও শুরু হয়ে গেল পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীদের খণ্ডযুদ্ধ। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ গ্রামবাসীদের তুখোড় প্রতিরোধের মুখে পুলিশ বাহিনী যখন পর্যুদস্ত, পিছনে সরবে কি না ভাবছে, তখন আই জি অরুণ গুপ্ত মোবাইল ফোনে ধরলেন শ্যামল চক্রবতীকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করব?
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, পরিস্থিতি বুঝে এগোন।
আই জি বললেন, এখানকার পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। গুলি চালানো ছাড়া উপায় নেই।
শ্যামলবাবু বললেন, গুলি কেন? রাবার বুলেট নেই?
আই জি বললেন, রাবাট বুলেট ছুড়ছে, কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না।
ও প্রান্ত থেকে ফের ভেসে এল, ঠিক আছে। তা হলে দু’-একটা বুলেট…
আই জি বললেন, সে নির্দেশ তো এখনও…
উনি বললেন, আপনারা কি কিছু বোঝেন না, নাকি? জানেন না, নন্দীগ্রামের লোকজনদের উদ্দেশে বিনয় কোঙার কী বলেছেন? চারদিক দিয়ে ঘিরে ওদের লাইফ হেল করে দেবেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মাত্র তিন দিন আগে, গত ১১ মার্চ, ব্রিগেডের দলীয় সমাবেশে বলেছেন, ‘কার কত ক্ষমতা আছে দেখে নেব।’ এর পরেও আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে?
আই জি বললেন, তা হলে?
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, যা বললাম। বুলেট…
আই জি সঙ্গে সঙ্গে পাশের কনস্টেবলটিকে চিৎকার করে বললেন, ফায়ার।
কনস্টেবলটি শূন্যে গুলি ছোড়ার জন্য বন্দুকের নল আকাশের দিকে তাক করে টিগার টিপতে যেতেই, আই জি বন্দুকের ব্যারেল হাত দিয়ে নামিয়ে গ্রামবাসীদের দিকে তাক করে গুলি চালাতে ইশারা করলেন।
নির্দেশ পাওয়া মাত্র ওঁদের পিছন সারি থেকে বেরিয়ে এসে গুলি চালাতে চালাতে আর এক কনস্টেবল উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল, ম্যাগাজিন খালি কর দো।
মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ভয়ানক গুলিবৃষ্টি।