মালঞ্চা এবং: বৈশালীর আনন্দ

মালঞ্চার মাটিতে নির্ঝরের কথা শুনে খুশিতে ভরে গেল বৈশালীর মন। নির্ঝরের কথাতে আনন্দে ভরে উঠল বৈশালীর প্রাণ। সেই খুশি, সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল বৈশালীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। বৈশালীর দেহের ভেতর ‘মোহিনীআট্টম’ নাচ চলতে লাগল। ‘মোহিনী আট্টম’-এ ছেয়ে গেল বৈশালীর শরীরের মধ্যটা। বৈশালীর চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠল খুশি,আনন্দ। বৈশালীর চোখ-মুখ আনন্দে কেন ছেয়ে গেল, নির্ঝর তা বুঝে‌ উঠতে পারল না। সেটা নির্ঝরের মাথায় ঢুকল না। বৈশালীর মুখে ‘হাসি’। বর্তমানে মানুষের মুখের ‘হাসি’-র ভীষণ অভাব। এখনকার ব্যস্ততার যুগে মানুষের মুখে ‘হাসি’ দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সব ‘হাসি’ কিন্তু মঙ্গলজনক নয়। কিছু-কিছু হাসি বিপজ্জনকও হয়। নির্ঝর সেটা ভালভাবে জানে। নির্ঝরের মুখমন্ডলে দুশ্চিন্তা। চোখ-মুখ কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন। নির্ঝর চুপচাপ। মুখে কোনও কথা নেই। সে নিশ্চুপ ভাবে কেবল দাঁড়িয়ে রইল।

বেশ কিছুটা দূরে একটি শিমুল গাছ থেকে সাদা-সাদা তুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। টুকরো-টুকরো সাদা মেঘের মতো সেই তুলোগুলো বাতাসে ভাসতে লাগল। বৈশালী বলল, “নির্ঝরদা, চলো, বটগাছটির নিচে গিয়ে বসি।” নির্ঝর বৈশালীকে মন থেকে ভালবাসে। নির্ঝর বৈশালীর কথা ফেলতে পারল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। বৈশালীর চোখ-মুখে খুশির ছাপ। নির্ঝরের মুখে দুশ্চিন্তা। বৈশালী সামনে এগিয়ে চলল। নির্ঝর বৈশালীর পিছে-পিছে চলতে লাগল।

বৈশালী গিয়ে বটগাছটির বাঁধানো জায়গায় বসল। নির্ঝরকে বলল, “নির্ঝরদা, বসো।” নির্ঝর বটগাছের ইট-সিমেন্টর বাঁধানো জায়গায় গিয়ে বসল। চুপচাপ দু’জনে। শুধু বটগাছের পাতাগুলো তাদের দু’জনকে শীতল হাওয়া দিচ্ছিল। এক সময় নির্ঝর খেয়াল করল, একটি নরম হাত তার হাতের ওপর এসে পড়ল। চমকে গেল নির্ঝর। দেখল, নখে নেলপালিশ পরা বৈশালীর ফর্সা, সুন্দর, ডান হাতটি তার হাতের ওপর। নির্ঝর বৈশালীর চোখের দিকে তাকাল। বৈশালী নির্ঝরের চোখের দিকে তাকাল। দু’জনে দু’জনের চোখে চোখ রেখে একে-অপরের‌ দিকে তাকিয়ে রইল। দু’জনে হারিয়ে গেল কিছুক্ষণ। তারপর বৈশালী নির্ঝরের হাতটা‌ ভাল করে ধরল‌। নির্ঝরের চোখ-মুখের দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে গেল। খুশি ফুটে উঠল নির্ঝরের চোখ-মুখে। বৈশালী উঠে দাঁড়াল। নির্ঝরও উঠে দাঁড়াল। বৈশালী হাত ধরে নির্ঝরকে বটগাছটির নিচে সবুজ ঘাসের কাছে নিয়ে গেল। তারা দেখল,অনেক– অনেক লাল বটফল মাটিতে পড়ে রয়েছে। লাল আর লাল যেন লালবিছানা পাতা রয়েছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছিল। বটগাছটিতে অনেক পাখির ঘর ঝুলানো ছিল। পাখিগুলো একবার ঘরের ভেতরে যাচ্ছিল আবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কিছু বটফল সরিয়ে বটফলগুলোর মাঝখানে বসল বৈশালী। হাত ধরে নির্ঝরকে তার পাশে বসাল। তাদের চারপাশে লাল-বটফলের বিছানা। বৈশালী বুকের ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল। মাথার চুলে লাগানো ক্লিপগুলো খুলে মাথার চুলগুলো খুলে দিল। চুড়িদারটা দেহের সঙ্গে সেটে ছিল। চুড়িদারটা টেনে আলগা করে নিল। বড় লালের টিপের ওপর বসানো নীল রঙের টিপটি ঠিক করে নিল। তারপর বৈশালী নির্ঝরের হাঁটুর ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। হালকা বাদামি রং করা চুলগুলো এলিয়ে দিল। হাওয়া বইছিল। হাওয়াতে কিছু বাদামি চুল বৈশালীর মুখের এসে পড়েছিল। বৈশালী নির্ঝরের চোখে চোখ রাখল। স্থির দৃষ্টিতে নির্ঝরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্ঝরও তাকিয়ে থাকল বৈশালীর চোখের দিকে। এক সময় বৈশালী বলল, “নির্ঝরদা, আমি তোমাকে ভালবাসি। খুব ভালবাসি। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ।”

নির্ঝর বৈশালীর হাঁটুতে মাথা দিয়ে শুল। বৈশালীর খোলা চুলগুলো হাওয়াতে উড়তে লাগল। নির্ঝর বৈশালীর চোখে চোখ রাখল। নির্ঝর বলল, “বৈশালী, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। খুব, খুব। আই লাভ ইউ বৈশালী, আই লাভ ইউ।”

জোরে বাতাস বইতে লাগল। ফসলের ওপর হাওয়া খেলতে লাগল। বটগাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে জাম-পুকুরের জলে ছোট-ছোট ঢেউ খেলতে লাগল। গাছের পাতা এদিক-ওদিক দুলতে লাগল।

দত্তক-গ্রামের বটগাছের ওপর থেকে একটি লাল-বটফল বৈশালী আর নির্ঝরের দেহের ওপর পড়ল। বটফলটি ফেটে গিয়ে বটফলটির বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ল বৈশালী আর নির্ঝরের দেহের ওপর।

আরও পড়ুন: নবীন বরণ 

বৈশালী ও নির্ঝরের ছায়া ক্রমশ পূর্ব দিকে বড় হতে লাগল। বৈশালী ও নির্ঝর বটগাছতলা থেকে উঠে দাঁড়াল। একে-অপরের হাত ধরে দু’জনে দত্তক গ্রামের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বৈশালী বলল, “জানো নির্ঝর, যদি সময়কে এক জায়গায় স্থির রাখা যেত, এক স্থানে টেনে সময়কে আটকে রাখা যেত, তাহলে খুব ভাল হতো। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে জাগে সময়কে টেনে ধরতে। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে সময়কে টেনে ধরার ইচ্ছেটা মানুষের মনে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দেয়। সব মানুষের ইচ্ছে জাগে, তার পছন্দ মতো জায়গায় সময়কে বেঁধে রাখতে।” কিছু দূর যাওয়ার পর নির্ঝর বলল, “বৈশালী, আমি প্রতিদিন সকালে তিন-চার কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করি। হেঁটে-হেঁটে বাজার করি। কিন্তু হাঁটার মধ্যে যে এত আনন্দ,এত খুশি রয়েছে, তা আমি বুঝতে পারিনি।” নির্ঝর বলল, “বৈশালী,আমার কেবল মনে হচ্ছে,শুধু হাঁটি… শুধু হাঁটি…

হাত ধরাধরি করে দু’জন সমস্ত দত্তক-গ্রামটি ঘুরে বেড়াতে লাগল। বৈশালী বলল, “নির্ঝর,মানুষের মন-মস্তিষ্ক-শরীর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মন খারাপ থাকলে মস্তিষ্ক ও শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। আবার মস্তিষ্ক ভাল না থাকলে মন ও শরীর বেসামাল হয়ে পড়ে। অপরদিকে শরীর‌ অসুস্থ থাকলে মস্তিষ্ক ও মন সুস্থ থাকে না। মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও শরীর তিনটি-ই যদি ভাল থাকে, তাহলে মানুষ ভীষণ সুখ অনুভব করে। আমার মন-মস্তিষ্ক-শরীর তিনটি-ই ভাল লাগছে। খুবই সতেজ, তরতাজা লাগছে।” হাঁটতে-হাঁটতে নির্ঝর বলল, “জানো বৈশালী, সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন কোনও না কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা একে-অপরকে ‘আই লাভ ইউ’ বলছে। কেউ না কেউ একে অপরকে বলছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। সারা বিশ্বে প্রতিদিন কোনও না কোনও জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকার সুমধুর প্রেমালাপ ধ্বনিত হচ্ছে। প্রেম-ভালোবাসার ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। পৃথিবী প্রতিদিন সৌন্দর্যময় হয়ে থাকছে। আর এই প্রেম-ভালোবাসাকে নির্ভর করে বিশ্ব প্রতিদিন সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। লোকে বলে, পৃথিবীতে নাকি প্রেম নেই,ভালোবাসা নাকি উধাও হয়ে গেছে। কথাটি মোটেই ঠিক নয়। জগতে এখনও প্রেমের জন্য মানুষ পাগল হয়ে যায়, এখনও মানুষ ভালোবাসার জন্য বিয়ে না করে একা-একা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রেমের জন্য মানুষ এখনও সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত, সন্ন্যাস নিতে প্রস্তুত।

সামনের দিকে কিছুটা দূরে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ। দত্তক-গ্রামটিতে সেই একটি মাত্র কৃষ্ণচূড়া গাছ।গাছটির নিচে অনেক লাল-ফুল পড়েছিল। বৈশালী ও নির্ঝর হেঁটে গাছটির কাছাকাছি আসতেই তাদের কানে ওপর থেকে মাটিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ কানে এল। বৈশালী ও নির্ঝর সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বৈশালী দেখল, কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে মাটিতে একটি ছোট্ট পাখির বাচ্চা পড়ে। ঠিক মতো চলতে পারছে না,ঠিক মতো নড়াচড়া করতে পারছে না পাখির বাচ্চাটি। বৈশালী গাছটির ওপর দিকে তাকাল। দেখতে পেল,ওপরে গাছটিতে একটি ঝুলন্ত-ঘর লাগানো। বৈশালী বুঝতে পারল,ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছটিতে লাগানো ঝুলন্ত-পাখির-বাসা থেকে পাখির বাচ্চাটি অসাবধানবশত নিচে পড়েছে । বৈশালী ধীরে-ধীরে মাটিতে পড়া পাখির ছানাটির দিকে এগিয়ে গেল। নির্ঝরও এগিয়ে চলল। বৈশালী ও নির্ঝর পাখির বাচ্চাটির খুব কাছে পৌঁছে গেল।

জোরে বাতাস বইতে লাগল। হাওয়াতে বৈশালীর চুল উড়তে লাগল। হলুদ ওড়নাটি হাওয়ায় দোল খেতে লাগল। বৈশালী পাখির বাচ্চাটিকে পরম যত্নে হাতে তুলে নিল। পাখির ছোট্ট বাচ্চাটিকে হাতে নিয়ে বৈশালী বলে উঠল,”আহ, কি সুখ! কি আনন্দ!” নির্ঝর ছোট্ট পাখির ছানাটিকে খুব সাবধানে হাতে নিল। পাখির বাচ্চাটি হাতে নির্ঝর বলল,”আহ,কি খুশি! কি প্রশান্তি!”#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!